মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন দুনিয়াতে মানব জাতিকে প্রেরণ করেছেন নিতান্ত সীমিত সময়ের জন্য। এখানকার জীবন ক্ষণস্থায়ী। মানুষের প্রকৃত জীবন হলো আখেরাতের জীবন। নবী আদম আ. ও আদি মাতা হাওয়া আ.এর মাধ্যমে দুনিয়াতে মানব বসতি শুরু হয়েছে। এরপর আবার সবাই একে একে চলে যাবে দুনিয়াবী জীবন ছেড়ে। দুনিয়ায় এ ক্ষণস্থায়ী জীবনকে ব্যয় করতে হবে আখেরাতের জীবনের পাথেয় সংগ্রহ করার কাজে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, দুনিয়া হলো আখেরাতের জন্য ক্ষেতস্বরূপ। অর্থাৎ আখেরাতের প্রকৃত জীবনের শান্তি সুখের সাজ-সরঞ্জাম এখান থেকেই সংগ্রহ করতে হবে। তাই দুনিয়ার জীবনের প্রতিটি মুহূর্তই অত্যন্ত মূল্যবান। কেননা আখেরাতের জীবনের কোন শেষ নেই। দুনিয়া ও আখেরাতের জীবনের মধ্যে তুলনা করা যায় এভাবে যে, একজন যদি সাগরে তার একটি আঙ্গুল ডুবিয়ে তোলে, তাহলে তাতে যতটুকু পানি উঠে আসে, তাহলো দুনিয়ার জীবন। আর অবশিষ্ট জলরাশি হলো আখেরাতের জীবন। স্পষ্টতঃই এ দু’য়ের মধ্যে কোন তুলনা হতে পারে না। এক ফোঁটা পানির সাথে অকূল সমুদ্রের অথৈ জলরাশির তুলনা কোন মতেই করা চলে না।
বস্তুতঃ পার্থিব এ ক্ষণস্থায়ী জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত আখেরাতের জীবনের পাথেয় সংগ্রহের জন্য ব্যয়িত হলেই জীবনের সাফল্য অর্জিত হতে পারে। পক্ষান্তরে ভোগ-বিলাস আর আনন্দ-ফূর্তি কিংবা অনর্থক ক্রিয়াকর্মের মধ্য দিয়ে সময় কাটিয়ে দিলে সে জীবনের কোন অর্থই হয় না। আল্লাহ তাআলা দুনিয়াতে মানুষকে পাঠানোর সময়ে বলে দিয়েছিলেন, ‘তোমাদের নিকট আমার হেদায়েতের বাণী পৌঁছুলে যারা তা অনুসরণ করবে তাদের কোন ভয় নেই। দুশ্চিন্তার কোন কারণও নেই।’ মহান আল্লাহ তার সে প্রতিশ্র“তি অনুযায়ী যুগে যুগে তাঁর মনোনীত পুরুষদের পাঠিয়েছেন মানুষকে জীবনপথের সঠিক দিশা দানের জন্য। পার্থিব জীবনের মোহমুক্ত হয়ে মহান আল্লাহ তাআলার প্রতি একনিষ্ঠভাবে ধাবিত হয়ে পরকালের জীবন পাথেয় সংগ্রহের জন্য আম্বিয়ায়ে কেরাম সর্বদা মানব জাতিকে আহ্বান জানিয়েছেন। পৃথিবীর অনিত্যতা, মানব জীবনের স্বরূপ ও করণীয়, বান্দাদের প্রতি আল্লাহর অপার মেহেরবানী ইত্যাদি বিষয় নিয়ে তারা বনী আদমকে চিন্তা-ভাবনা করার আহ্বান জানিয়েছেন।
মহানবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহ তাআলার সর্বশেষ নবী ও রাসূল। সকল নবীর সেরা মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দুনিয়াতে আগমনের পর নবুওয়াতের ধারার পরিসমাপ্তি টানা হয়েছে। এখন থেকে কেয়ামত পর্যন্ত আর কোন নবীর আগমন ঘটবে না। তাই একমাত্র মুহাম্মদী মত ও পথ ব্যতীত মানব জাতির জন্য আর কোন অনুসরণীয় আদর্শ নেই। আল্লাহ তাআলা কুরআন মজীদে ঘোষণা করেছেন, ‘আল্লাহর নিকট একমাত্র দীন হলো ইসলাম।’
সুতরাং জীবনের সাফল্য লাভের একমাত্র উপায় হলো ইসলামের অনুশাসন পালন করা ও সে মোতাবেক জীবন ধারা নিয়ন্ত্রণ।
কিন্তু তাই বলে পার্থিব জীবনকে বিস্বাদ ও কষ্টকর করে তোলার কোন বিধান ইসলামে নেই। যদিও অনেকের ধারণা হলো, বান্দা নিজের ওপর যত বেশি কষ্ট আরোপ করে, আল্লাহ তার প্রতি ততবেশী সন্তুষ্ট হন। কিংবা দেহের ওপর যত কষ্ট চাপানো যাবে আধ্যাত্মিক পরিশুদ্ধি ও উন্নতি ততবেশী পরিমাণে হাসিল হবে। আসলে তা নয়। গ্রীক দার্শনিকদের মধ্যে ইশরাকিয়াত, খৃস্টানদের মতে রাহবানিয়াত এবং হিন্দুদের মধ্যে যোগ পালনের রীতি এ ধারণার ওপর ভিত্তি করেই গড়ে উঠেছিল। এদের কেউ গোশত না খাওয়ার অঙ্গীকার করত, কেউ সপ্তাহভর বা চল্লিশ দিনে একবার খাদ্য গ্রহণ করত। এছাড়া আরো অনেক প্রকারের সাধনা প্রচলিত ছিল। এসবের মাধ্যমে তারা আল্লাহর সান্নিধ্য লাভের চেষ্টা করত। কিন্তু ইসলামে এসবের কোন কিছুরই অনুমতি দেয়া হয়নি। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ইসলামে কোন বৈরাগ্য নেই।
সুপেয় ও সুস্বাদু আহার্যবস্তু ত্যাগ করলেই প্রকৃত সত্যের সন্ধান পাওয়া যাবে এ ধারণা ইসলামে স্বীকৃত নয়। মানুষের দুর্দশা ও দুশ্চিন্তা আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি লাভের কারণ নয়। মানুষকে অপরিমেয় দুঃখকষ্ট দান করতে মহান আল্লাহও ভালবাসেন না। স্ত্রী, পুত্র, বন্ধু, স্বজনদের সাথে বিরূপ আচরণ করে আল্লাহ তাআলার রহমত ও করুণা নসিব হয় না। মূলত আল্লাহর মনোনীত ধর্ম ইসলাম বান্দাদের শক্তি বহির্ভূত কোন কিছুই তাদের উপর আরোপ করে না। কুরআন মাজীদে সূরা বাকারার শেষভাগে মহান আল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহ কোন প্রাণীকে তার সাধ্যাতীত দায়িত্ব অর্পণ করেন না।’
ইসলামের সিয়াম সাধনা একটি কষ্টের কাজ। কিন্তু এতেও অনেক দিক দিয়ে সহজ উপায় অবলম্বনের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত খুব একটা দীর্ঘ সময় নয়। তথাপি নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেহরী খাওয়া সুন্নাত সাব্যস্ত করেছেন। আবার সূর্যাস্তের সাথে সাথেই ইফতার করার ওপর জোর দেয়া হয়েছে। রোযার দিনে মানুষের সংসর্গ ত্যাগ কিংবা নীরবতা পালনের কোন বিধান দেয়া হয়নি। কুরআন মজীদে আল্লাহ তাআলা বলেন, আল্লাহ তোমাদের প্রতি সহজতা চান, কোনরূপ জটিলতা আরোপ করতে তিনি চান না।’
হজ্জ পালনও একটি কষ্টের ইবাদত। ইসলামে এ সম্পর্কে বিধান হলো যার পথ অতিক্রমের সামর্থ্য আছে (শারীরিক ও আর্থিক) তার উপরই হজ্জ ফরয। সূরা হজ্জ এ আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘তিনি (আল্লাহ) তোমাদের ধর্মীয় জীবনে কোন রকম সমস্যা আরোপ করে রাখেননি।’
এ সম্পর্কে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘নিশ্চয় দীন হলো সহজ। যে ব্যক্তি তা কঠিন করবে সে পরাজিত হয়ে যাবে।’ অর্থাৎ যে ব্যক্তি দীনকে সহজভাবে পালন না করে নিজে নিজেই তাতে জটিলতা সৃষ্টি করবে। তার পক্ষে দীন পালন অসম্ভব হয়ে পড়বে।
জীবন ধর্মে বৈরাগ্য ও যোগ-সাধন যত মহৎ উদ্দেশ্যেই প্রবর্তন করা হোক না কেন, তাতে কোন সুফল বয়ে আনে না। তাই তা প্রকৃত দীনের শিক্ষা হতে পারে না। মানব প্রকৃতির সাথে তা সামঞ্জস্যও রক্ষা করতে পারে না। তাই ইসলাম এসব কার্যকলাপকে বিদআত বা ভিত্তিহীন সাব্যস্ত করেছে। খৃস্টান ধর্মে যে রাহবানিয়াত রীতি প্রচলিত ছিল সে সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা কুরআন মজীদে বলেন যে, ‘আমি তাদের জন্য সে বিধান দেইনি বরং তারাই তা আবিস্কার করে নিয়েছিল।’ (সূরা হাদীদ:৪)
উত্তম আহার ও বৈধ সৌন্দর্যমণ্ডিত পোশাক পরিহার করলে আল্লাহ তাআলা সন্তুষ্ট হবেন এ ধারণা যে নিতান্ত ভুল, কুরআন মজীদে সে কথাও উল্লেখ করা হয়েছে। সূরা আরাফের বত্রিশ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, ‘বলুন, আল্লাহর দেয়া বান্দানের জন্য পবিত্র রিযিক ও আল্লাহর পছন্দনীয় সুন্দর পোশাককে হারাম করেছে?
এ ব্যাপারে ইসলামের শিক্ষা অত্যন্ত সুস্পষ্ট। কোন হালাল বস্তুকেই নিজের জন্য হারাম সাব্যস্ত করা যাবে না। একবার নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর কোন একজন স্ত্রীর মনঃতুষ্টির জন্য মধু না খাওয়ার প্রতিজ্ঞা করেন। আল্লাহ তাআলা তাঁর প্রিয় হাবীবকে এহেন কাজের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, ‘হে নবী আল্লাহ তাআলা আপনার জন্য যা হালাল করেছেন, তা আপনি হারাম সাব্যস্ত করেছেন। কেন? আপনি কি আপনার স্ত্রীদের মনঃতুষ্টি কামনা করেন। (সূরা তাহরীম-১)
সাহাবীদের মধ্যে কেউ কেউ খৃস্টান পাদ্রীদের অনুকরণে কিংবা ব্যক্তিগত চিন্তা থেকে নিজেদের মনের প্রশান্তির জন্য একাকীত্ব বরণ, উপাদেয় খাদ্য পানীয় বর্জন ও কঠিন রিয়াযত মোজাহাদার ভেতর দিয়ে জীবন নির্বাহ করার অভিলাষ ব্যক্ত করলে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘আমি এরূপ শরীয়ত নিয়ে আগমন করিনি।’
বুখারী শরীফে বর্ণিত আছে, সাহাবী কুদামা ইবনে মাজউন রা.ও তার জনৈক বন্ধু মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম Ñএর দরবারে হাজির হয়ে আরজ করেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমাদের দু’জনের একজন চিরকুমার থাকা ও অন্যজন জীবনভর গোশত না খাওয়ার সংকল্প করেছি। একথা শুনে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করলেন, ‘আমি তো দু’টোই করছি। আমি গোশত খাই এবং বিবাহিত জীবনযাপন করি।’ প্রশ্নকারী সাহাবী দু’জন তখন তাদের সংকল্প পরিত্যাগ করেন।
আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস রা. একজন দুনিয়াবিমুখ সাহাবী ছিলেন। একবার তিনি শপথ করেন, তিনি দিনে রোযা রাখবেন ও রাতভর ইবাদত বন্দেগী করবেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তা জানতে পেরে তাকে বলেন, ‘আব্দুল্লাহ! তোমার উপর তোমার দেহের হক আছে, তোমার চোখের হক আছে, এমনকি তোমার স্ত্রীরও হক আছে। মাসে তিনদিন রোযা রাখাই যথেষ্ট।’ ওসমান ইবনে মাজউন রা. ছিলেন একজন বিশুদ্ধ চিত্তের অধিকারী দুনিয়াবিমুখ সাহাবী। তিনি দিন-রাত ইবাদত-বন্দেগীতে লিপ্ত থাকতেন, স্ত্রীর সাথে কোন সম্পর্ক রাখতেন না। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ বিষয় জানার পর ইরশাদ করেন, ‘হে ওসমান! তুমি কি আমার তরীকা থেকে সরে গেছ? ওসমান রা. বললেন, ‘আমি তো আপনার তরীকাই অনুসন্ধান করছি। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে বললেন, ‘আমি ঘুমাই, নামাযও পড়ি, মহিলাদের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধও হই। হে ওসমান! আল্লাহকে ভয় কর। তোমার পরিবার পরিজনের, মেহমানদের এবং তোমার দেহের তোমার ওপর হক রয়েছে।’
বাহেলা গোত্রের জনৈক ব্যক্তি ইসলাম গ্রহণ করে নিজ গোত্রে ফিরে যায় এবং সারা বছর রোযা রাখতে থাকে। এক বছর পর সে যখন মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর দরবারে উপস্থিত হয় তখন তার চেহারা এমন পরিবর্তিত হয়ে গেছে যে, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে চিনতে পারেননি। সে তার নাম বলায় মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বললেন, ‘তুমি তো সুঠাম দেহের অধিকারী ছিলে। তোমার চেহারা এমন হয়ে গেল কেন? সে বললো, আমি আপনার কাছ থেকে ফিরে যাবার পর থেকে রোযা রেখেছি। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘তুমি নিজের জীবনকে আযাবে নিপতিত করছ কেন? রমযান মাস ছাড়া প্রতি মাসে একটি রোযা রাখাই যথেষ্ট।’ সে এর চেয়ে বেশি পরিমাণ রোযা পালনের ইচ্ছা প্রকাশ করলে তিনি তাকে প্রতি মাসে দু’টি করে রোযা রাখার অনুমতি দিলেন। এর চেয়েও বেশি পরিমাণ রাখতে চাইলে তাকে তিনি মহররম মাসে রোযা রাখতে বললেন।
ইসলাম দুনিয়াবী জীবনের সকল চাহিদা পরিত্যাগ করে সর্বক্ষণ ইবাদত-বন্দেগীতে মশগুল থাকতে বলেনি। বরং পার্থিব জীবন নির্বাহের জন্য যা কিছু অপরিহার্য, তা অবলম্বন করতে বলেছে। অবশ্য সে সবের জন্য নিয়মনীতি ঠিক করে দেয়া হয়েছে। সে অনুযায়ী জাগতিক ক্রিয়া-কলাপ সম্পাদন করলে তাতেও ইবাদতের মতই কল্যাণ লাভের প্রতিশ্র“তি রয়েছে।
আহার, নিদ্রা, উপার্জন ইত্যাদি কাজ-কর্ম পার্থিব জীবনের অপরিহার্য অনুষঙ্গ। এগুলোকে সম্পূর্ণরূপে উপেক্ষা করে কারো পক্ষে পৃথিবীতে টিকে থাকা সম্ভব নয়। তাই ইসলামী জীবন দর্শনে কোন মানুষকেই এসব পরিহার করতে বলেনি। অবশ্য তাকে পরিমিত ও ভারসাম্য রক্ষা করতে বলেছে। আহারের ক্ষেত্রে রসনাবিলাস, নিদ্রার নামে আলসেমী আর জীবিকা উপার্জনের বেলায় হালাল হারাম পার্থক্য না করা শরীয়তের দৃষ্টিতে নিন্দনীয়।
মহানবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন মানবতার নবী, মানব প্রকৃতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ জীবন ধারাই তিনি জগতবাসীকে দেখিয়ে গেছেন। শুধু তিনি নন, তাঁর পূর্বে যত নবী রাসূল দুনিয়াতে মানব জাতির মুক্তির বাণী নিয়ে আগমন করেছিলেন, তারা কেউই মানব স্বভাবের চাহিদা ও প্রয়োজনকে উপেক্ষা করতে বলেননি। কেননা আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাঁর বান্দাদের প্রতি বড়ই মেহেরবান। তিনি তাদের জন্য এমন বিধান দিতে পারেন না যা তাদের পালন করতে জটিলতার সম্মুখীন হতে হয়। আম্বিয়ায়ে কেরামের সহজ-সরল স্বাভাবিক জীবন-যাপন করতে দেখে অবিশ্বাসীরা অনেক সময় প্রশ্ন তুলেছিল। তারা এই বলে বিস্ময় প্রকাশ করেছিল যে, ইনি কেমন করে নবী হতে পারেন? তিনি তো আমাদের মতই আহার পানীয় গ্রহণ করেন, পরিবার প্রতিপালন করেন, জীবিকা নির্বাহের জন্য হাট-বাজারেও গমন করেন। অর্থাৎ আমাদের সাথে তাঁর জীবনযাত্রার তো কোন স্বাতন্ত্র্য নেই। তাহলে তিনি নবী হলেন কি করে? আল্লাহ তাআলা তাদের এ বক্তব্যের অত্যন্ত জোরালো ভাষায় প্রতিবাদ করেছেন। তিনি বলেন, দুনিয়াতে যদি ফেরেশতা বাস করত, তাহলে আমি ফেরেশতাদের মধ্যে থেকে একজনকে রাসূল করে পাঠাতাম। অর্থাৎ যেহেতু মানুষদের কাছেই আল্লাহর দীন উপস্থাপন করতে হবে, তাই মানুষের অকৃত্রিম জীবনযাত্রার সাথে একাত্ম কোন ব্যক্তি ব্যতীত নবী-রাসূল হওয়া যৌক্তিক নয়। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর গোটা জীবনে এমন নজীর ও আদর্শ স্থাপন করে গেছেন, যা অনুসরণ করা মানুষের পক্ষে সম্ভব।
বুখারী শরীফে বর্ণিত আছে একবার কতিপয় সাহাবী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বিবিগণের নিকট উপস্থিত হয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর রাত-দিনের ইবাদত সম্পর্কে খোঁজ-খবর নিলেন। (তাঁরা হয়ত মনে করেছিলেন যে, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সারা দিনরাত একমাত্র ইবাদত-বন্দেগী ব্যতীত আর কিছুই করেন না।) তাদেরকে যখন মহানবীর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইবাদতের কথা জানানো হলো, তখন তারা যেন তা খুবই কিঞ্চিত মনে করলেন। অতঃপর তারা বললেন, তাঁর ও আমাদের অবস্থা তো এক নয়। আল্লাহ তাআলা তো তাঁর পূর্বাপর সকল ত্র“টি-বিচ্যুতি ক্ষমা করে দেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। সুতরাং তিনি যতটুকু করেন, তাই তো তাঁর জন্য অতিরিক্ত। আর আমাদের অবস্থা তো তেমন নয়। সুতরাং আমাদেরকে অবশ্যই অধিক পরিমাণে ইবাদত-বন্দেগী করতে হবে। একজন বললেন, আমি সারা রাত ইবাদত করতে থাকব, এক মুহূর্তও ঘুমুবো না। আরেকজন বললেন, আমি সারা বছর রোযা রাখব, কখনই রোযাবিহীন থাকব না। অপরজন বললেন, আমি বিবাহ-শাদী করব না। তাঁদের এরূপ কথাবার্তার মাঝখানে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এসে উপস্থিত হলেন। তিনি বললেন, তোমরাই কি এরূপ বলাবলি করছিলে? ‘আল্লাহর শপথ আমি আল্লাহ তাআলাকে সবচেয়ে বেশি ভয় করি, আমার মধ্যে আল্লাহভীতি সবচেয়ে বেশি পরিমাণেই রয়েছে। তথাপি আমি রাতে নামায পড়ি, নিদ্রাও যাই, রোযা থাকি, রোযাহীন অবস্থায়ও কাটাই এবং আমি দাম্পত্য জীবনযাপন করি। যে ব্যক্তি আমার নীতি-আদর্শ থেকে বিমুখ হবে সে আমার দলভুক্ত নয়।’ ভারসাম্যপূর্ণ জীবন নির্বাহের জন্য এ হাদীসের বক্তব্য খুবই স্পষ্ট। আল্লাহর ভয় তথা তাকওয়া পরিপূর্ণ মাত্রায় থাকলেও যে তা জাগতিক জীবনের স্বাভাবিক গতি ও প্রকৃতির কোন অন্তরায় সৃষ্টি করে না, তা এখানে অত্যন্ত দ্ব্যর্থহীন ভাষায় প্রকাশ করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, দুনিয়াবী জীবনে স্বাভাবিক নিয়মের খেলাফ করা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামেরÑএর আদর্শেরই খেলাপ করা। তাই তা অনুমোদনযোগ্য নয়। কেউ নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম Ñএর সুন্নাহ পরিহার করে তার খাঁটি উম্মত বলে দাবী করার অধিকার রাখে না।
কোন কোন সাহাবীর বিবাহ-শাদী করার মত আর্থিক সঙ্গতি ছিল না। আবার তারুণ্যের প্রাবল্যে নিজেদেরকে সংযত রাখতেও পারছিলেন না। তাই জৈবিক চাহিদা সম্পূর্ণরূপে বিনাশ করার জন্য তারা বিশেষ অঙ্গটি কেটে ফেলার মনস্থ করেন। তাই তারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট উপস্থিত হয়ে পুরোপুরি সংসার বিমুখ হবার অনুমতি প্রার্থনা করেন। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের আসল উদ্দেশ্যে বুঝতে পেরে খুবই অসন্তোষ প্রকাশ করেন। এ প্রসঙ্গে সাহাবি সাদ ইবনে আবু ওয়াক্কাস রা. বলেন, যদি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ কাজের অনুমতি দিতেন তাহলে বহু লোক এর ওপর আমল করতে প্রস্তুত ছিল।
নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজে এক সাথে কয়েক দিনের রোযা রাখতেন। অর্থাৎ মাঝখানে ইফতার করতেন না। এভাবে কয়েকদিন কেটে যেত। তাঁর অনুসরণে সাহাবীগণও এরূপে রোযা রাখার অভিলাষ ব্যক্ত করেন। কিন্তু মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে নিষেধ করলেন। অনেকেই মনে করলেন, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের প্রতি দয়া পরবশ হয়ে নিষেধ করেছেন। তাই তারা দিনের শেষে ইফতার না করে লাগাতার রোযা রাখলেন। এভাবে দু’দিন কেটে যাবার পর তৃতীয় দিনে ঈদের চাঁদ দেখা গেল। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইফতার করলেন এবং বললেন, মাস যদি দীর্ঘায়িত হত তাহলে আমার রোযাও দীর্ঘ হত। তখন দেখা যেত যারা গোঁড়ামি করছে, তাদের অবস্থা কি দাঁড়ায়। সাহাবীগণ নিবেদন করলেন, হে আল্লাহ রাসূল, আপনি যে লাগাতার রোযা রাখেন! তিনি বললেন, আমার মত তোমাদের কে আছে? আমাকে আমার প্রভু (বিশেষ ব্যবস্থায়) পানাহার করান। তত্ত্বজ্ঞানীরা বলেন, আল্লাহর নবী আপন প্রভুর প্রতি এমন নিবিষ্টচিত্ত ও ধ্যানমগ্ন থাকতেন যে, তাঁর পানাহারের কষ্ট অনুভূত হত না। আল্লাহ প্রেমের অমিয় সুধা তাঁর দৈহিক ক্ষুধাকেও নিবৃত্ত করত।
মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উপরোক্ত হাদীসের ওপর ভিত্তি করে ফকীহগণ বলেন, উম্মতের জন্য লাগাতার কয়েক দিনের রোযা রাখা (মাঝখানে ইফতার না করে) বৈধ নয়।
একদিন নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মসজিদে গিয়ে দেখলেন, একটি রশি ঝুলছে। তিনি এর কারণ জিজ্ঞেস করে জানতে পারলেন, সেটি টাঙিয়ে রেখেছে জনৈকা যয়নবের দাসী। রাতে দাঁড়িয়ে ইবাদত করতে করতে সে যখন দাঁড়াতে অপারগ হয়ে যায় তখন সে এই রশি ধরেই উঠাবসা করে। একথা শুনে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেটি খুলে ফেলতে নির্দেশ দিলেন এবং বললেন, তোমরা যতক্ষণ সুস্থ থাকবে, সচেতন থাকবে, ততক্ষণই নামায আদায় করবে। যখন পরিশ্রান্ত ও অক্ষম হয়ে পড়বে তখন বসে থাকাই উত্তম।
একবার জনৈকা মহিলা মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম Ñএর সামনে দিয়ে যাচ্ছিল। আয়েশা রা. তাকে দেখে বললেন, এতো খাওলা। লোকেরা তার সম্পর্কে বলছে, তিনি নাকি রাতভর নিদ্রা যান না, ইবাদত-বন্দেগীতে অতিবাহিত করেন। তা শুনে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, সে কি রাতে মোটেই ঘুমায় না? লোক সকল! সেই পরিমাণ ইবাদত-বন্দেগীই কর যতটুকু ক্ষমতা তোমাদের আছে।
অনেক সাহাবী আল্লাহর সান্নিধ্য ও রহমত লাভের বাসনায় রাতভর নামাযে মশগুল থাকতেন। তাদেরকে লক্ষ্য করে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, তোমরা এই পরিমাণ কাজের কষ্ট সহ্য কর যা তোমাদের সাধ্যের আওতায়। তোমরা অস্বস্তিবোধ না করা পর্যন্ত আল্লাহ তাআলা অস্বস্তিবোধ করেন না। আল্লাহ তাআলার নিকট সেই কাজ অধিক পছন্দনীয় যা তোমরা সর্বদা নিয়মিত ও নিরবচ্ছিন্ন পালন করে যাও যদিও তা পরিমাণে কম হয়। হজ্জের সময় আরবে অনেক বৈরাগ্যমূলক আচার অনুষ্ঠান প্রচলিত ছিল। কোন কোন হাজী এরূপ অঙ্গীকার করত যে, এই সফরে সে মুখে কোন কথা বলবে না অথবা কোন বাহনে আরোহণ করবে না যদিও যানবাহন সংগ্রহের সুযোগ তার আছে। আবার কেউ শপথ করত যে, কখনো ছায়ায় অবস্থান করবে না, সব সময় প্রখর রোদেই অবস্থান করবে। আবার কেউ কেউ নিজের অপরাধের কথা প্রকাশ করার জন্য নাকে রশি বেঁধে রেখে কাবা শরীফ তাওয়াফ করত। কিন্তু ইসলাম এ সকল আচার ও আচরণকে চিরতরে নির্মূল করে দিয়েছে এবং এ ঘোষণা করেছে যে, অনর্থক ও ভিত্তিহীন কষ্টবরণ আল্লাহর সন্তুষ্টির পরিচায়ক হতে পারে না।
সাহাবি ওকবা ইবনে আমের রা.Ñএর বোন এ মর্মে শপথ করেছিলেন যে, তিনি পদব্রজে হজ্জ পালন করবেন। ওকবা রা. এ ব্যাপারে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম Ñএর নিকট জিজ্ঞাসা করতে এলে উত্তরে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, তোমার বোনের এই শপথের কোন প্রয়োজনীয়তা আল্লাহ তাআলার নেই। বরং তাকে গিয়ে বলো, সে যেন যানবাহনে চড়েই হজ্জ পালন করে।
হজ্জের সফরের সময় মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক বৃদ্ধকে দেখলেন যে, সে চলতে পারছে না। তার ছেলে তাকে উভয় দিকের হাত ধরে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিজ্ঞেস করে জানতে পারলেন যে, বৃদ্ধ লোকটি পদব্রজে হজ্জ আদায় করার শপথ করেছে। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে লক্ষ্য করে বললেন, কেউ তার নিজের জীবনের প্রতি কষ্ট আরোপ করুক, এমন কাজের কোন প্রয়োজন আল্লাহর নেই। তোমরা এই বৃদ্ধ লোকটাকে যানবাহনে চড়িয়ে দাও।
মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মানব জাতির জন্য ভারসাম্যপূর্ণ ও স্বাভাবিক জীবন দর্শন রেখে গেছেন। তাই দীন পালনের অর্থ অহেতুক কষ্ট স্বীকার করা নয়। আল্লাহ তাআলা কুরআন মজীদের মাধ্যমে বনি আদমের জন্য যে জীবন দর্শন দান করেছেন এবং নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তা যেভাবে পালন করে দেখিয়ে গেছেন, সেভাবে জীবন নির্বাহ করেই মানবজাতি প্রকৃত কল্যাণ ও শান্তি অর্জন করতে পারে। অন্য কোনভাবে নয়। নিজের উদ্ভাবিত পদ্ধতি ও নিয়ম অনুসারে দীন পালন করে সাফল্য লাভের আশা করাই বৃথা। বাড়াবাড়ি ও শৈথিল্যের মাঝামাঝি ভারসাম্যপূর্ণ জীবনবোধই ইসলামের মূলনীতি। ইসলাম তাই বাস্তববাদী জীবনাদর্শ। ভাববাদী কিংবা অতিন্দ্রীয় কোন জীবনধারা ইসলামে অনুমোদিত নয়।
বস্তুতঃ পার্থিব এ ক্ষণস্থায়ী জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত আখেরাতের জীবনের পাথেয় সংগ্রহের জন্য ব্যয়িত হলেই জীবনের সাফল্য অর্জিত হতে পারে। পক্ষান্তরে ভোগ-বিলাস আর আনন্দ-ফূর্তি কিংবা অনর্থক ক্রিয়াকর্মের মধ্য দিয়ে সময় কাটিয়ে দিলে সে জীবনের কোন অর্থই হয় না। আল্লাহ তাআলা দুনিয়াতে মানুষকে পাঠানোর সময়ে বলে দিয়েছিলেন, ‘তোমাদের নিকট আমার হেদায়েতের বাণী পৌঁছুলে যারা তা অনুসরণ করবে তাদের কোন ভয় নেই। দুশ্চিন্তার কোন কারণও নেই।’ মহান আল্লাহ তার সে প্রতিশ্র“তি অনুযায়ী যুগে যুগে তাঁর মনোনীত পুরুষদের পাঠিয়েছেন মানুষকে জীবনপথের সঠিক দিশা দানের জন্য। পার্থিব জীবনের মোহমুক্ত হয়ে মহান আল্লাহ তাআলার প্রতি একনিষ্ঠভাবে ধাবিত হয়ে পরকালের জীবন পাথেয় সংগ্রহের জন্য আম্বিয়ায়ে কেরাম সর্বদা মানব জাতিকে আহ্বান জানিয়েছেন। পৃথিবীর অনিত্যতা, মানব জীবনের স্বরূপ ও করণীয়, বান্দাদের প্রতি আল্লাহর অপার মেহেরবানী ইত্যাদি বিষয় নিয়ে তারা বনী আদমকে চিন্তা-ভাবনা করার আহ্বান জানিয়েছেন।
মহানবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহ তাআলার সর্বশেষ নবী ও রাসূল। সকল নবীর সেরা মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দুনিয়াতে আগমনের পর নবুওয়াতের ধারার পরিসমাপ্তি টানা হয়েছে। এখন থেকে কেয়ামত পর্যন্ত আর কোন নবীর আগমন ঘটবে না। তাই একমাত্র মুহাম্মদী মত ও পথ ব্যতীত মানব জাতির জন্য আর কোন অনুসরণীয় আদর্শ নেই। আল্লাহ তাআলা কুরআন মজীদে ঘোষণা করেছেন, ‘আল্লাহর নিকট একমাত্র দীন হলো ইসলাম।’
সুতরাং জীবনের সাফল্য লাভের একমাত্র উপায় হলো ইসলামের অনুশাসন পালন করা ও সে মোতাবেক জীবন ধারা নিয়ন্ত্রণ।
কিন্তু তাই বলে পার্থিব জীবনকে বিস্বাদ ও কষ্টকর করে তোলার কোন বিধান ইসলামে নেই। যদিও অনেকের ধারণা হলো, বান্দা নিজের ওপর যত বেশি কষ্ট আরোপ করে, আল্লাহ তার প্রতি ততবেশী সন্তুষ্ট হন। কিংবা দেহের ওপর যত কষ্ট চাপানো যাবে আধ্যাত্মিক পরিশুদ্ধি ও উন্নতি ততবেশী পরিমাণে হাসিল হবে। আসলে তা নয়। গ্রীক দার্শনিকদের মধ্যে ইশরাকিয়াত, খৃস্টানদের মতে রাহবানিয়াত এবং হিন্দুদের মধ্যে যোগ পালনের রীতি এ ধারণার ওপর ভিত্তি করেই গড়ে উঠেছিল। এদের কেউ গোশত না খাওয়ার অঙ্গীকার করত, কেউ সপ্তাহভর বা চল্লিশ দিনে একবার খাদ্য গ্রহণ করত। এছাড়া আরো অনেক প্রকারের সাধনা প্রচলিত ছিল। এসবের মাধ্যমে তারা আল্লাহর সান্নিধ্য লাভের চেষ্টা করত। কিন্তু ইসলামে এসবের কোন কিছুরই অনুমতি দেয়া হয়নি। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ইসলামে কোন বৈরাগ্য নেই।
সুপেয় ও সুস্বাদু আহার্যবস্তু ত্যাগ করলেই প্রকৃত সত্যের সন্ধান পাওয়া যাবে এ ধারণা ইসলামে স্বীকৃত নয়। মানুষের দুর্দশা ও দুশ্চিন্তা আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি লাভের কারণ নয়। মানুষকে অপরিমেয় দুঃখকষ্ট দান করতে মহান আল্লাহও ভালবাসেন না। স্ত্রী, পুত্র, বন্ধু, স্বজনদের সাথে বিরূপ আচরণ করে আল্লাহ তাআলার রহমত ও করুণা নসিব হয় না। মূলত আল্লাহর মনোনীত ধর্ম ইসলাম বান্দাদের শক্তি বহির্ভূত কোন কিছুই তাদের উপর আরোপ করে না। কুরআন মাজীদে সূরা বাকারার শেষভাগে মহান আল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহ কোন প্রাণীকে তার সাধ্যাতীত দায়িত্ব অর্পণ করেন না।’
ইসলামের সিয়াম সাধনা একটি কষ্টের কাজ। কিন্তু এতেও অনেক দিক দিয়ে সহজ উপায় অবলম্বনের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত খুব একটা দীর্ঘ সময় নয়। তথাপি নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেহরী খাওয়া সুন্নাত সাব্যস্ত করেছেন। আবার সূর্যাস্তের সাথে সাথেই ইফতার করার ওপর জোর দেয়া হয়েছে। রোযার দিনে মানুষের সংসর্গ ত্যাগ কিংবা নীরবতা পালনের কোন বিধান দেয়া হয়নি। কুরআন মজীদে আল্লাহ তাআলা বলেন, আল্লাহ তোমাদের প্রতি সহজতা চান, কোনরূপ জটিলতা আরোপ করতে তিনি চান না।’
হজ্জ পালনও একটি কষ্টের ইবাদত। ইসলামে এ সম্পর্কে বিধান হলো যার পথ অতিক্রমের সামর্থ্য আছে (শারীরিক ও আর্থিক) তার উপরই হজ্জ ফরয। সূরা হজ্জ এ আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘তিনি (আল্লাহ) তোমাদের ধর্মীয় জীবনে কোন রকম সমস্যা আরোপ করে রাখেননি।’
এ সম্পর্কে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘নিশ্চয় দীন হলো সহজ। যে ব্যক্তি তা কঠিন করবে সে পরাজিত হয়ে যাবে।’ অর্থাৎ যে ব্যক্তি দীনকে সহজভাবে পালন না করে নিজে নিজেই তাতে জটিলতা সৃষ্টি করবে। তার পক্ষে দীন পালন অসম্ভব হয়ে পড়বে।
জীবন ধর্মে বৈরাগ্য ও যোগ-সাধন যত মহৎ উদ্দেশ্যেই প্রবর্তন করা হোক না কেন, তাতে কোন সুফল বয়ে আনে না। তাই তা প্রকৃত দীনের শিক্ষা হতে পারে না। মানব প্রকৃতির সাথে তা সামঞ্জস্যও রক্ষা করতে পারে না। তাই ইসলাম এসব কার্যকলাপকে বিদআত বা ভিত্তিহীন সাব্যস্ত করেছে। খৃস্টান ধর্মে যে রাহবানিয়াত রীতি প্রচলিত ছিল সে সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা কুরআন মজীদে বলেন যে, ‘আমি তাদের জন্য সে বিধান দেইনি বরং তারাই তা আবিস্কার করে নিয়েছিল।’ (সূরা হাদীদ:৪)
উত্তম আহার ও বৈধ সৌন্দর্যমণ্ডিত পোশাক পরিহার করলে আল্লাহ তাআলা সন্তুষ্ট হবেন এ ধারণা যে নিতান্ত ভুল, কুরআন মজীদে সে কথাও উল্লেখ করা হয়েছে। সূরা আরাফের বত্রিশ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, ‘বলুন, আল্লাহর দেয়া বান্দানের জন্য পবিত্র রিযিক ও আল্লাহর পছন্দনীয় সুন্দর পোশাককে হারাম করেছে?
এ ব্যাপারে ইসলামের শিক্ষা অত্যন্ত সুস্পষ্ট। কোন হালাল বস্তুকেই নিজের জন্য হারাম সাব্যস্ত করা যাবে না। একবার নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর কোন একজন স্ত্রীর মনঃতুষ্টির জন্য মধু না খাওয়ার প্রতিজ্ঞা করেন। আল্লাহ তাআলা তাঁর প্রিয় হাবীবকে এহেন কাজের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, ‘হে নবী আল্লাহ তাআলা আপনার জন্য যা হালাল করেছেন, তা আপনি হারাম সাব্যস্ত করেছেন। কেন? আপনি কি আপনার স্ত্রীদের মনঃতুষ্টি কামনা করেন। (সূরা তাহরীম-১)
সাহাবীদের মধ্যে কেউ কেউ খৃস্টান পাদ্রীদের অনুকরণে কিংবা ব্যক্তিগত চিন্তা থেকে নিজেদের মনের প্রশান্তির জন্য একাকীত্ব বরণ, উপাদেয় খাদ্য পানীয় বর্জন ও কঠিন রিয়াযত মোজাহাদার ভেতর দিয়ে জীবন নির্বাহ করার অভিলাষ ব্যক্ত করলে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘আমি এরূপ শরীয়ত নিয়ে আগমন করিনি।’
বুখারী শরীফে বর্ণিত আছে, সাহাবী কুদামা ইবনে মাজউন রা.ও তার জনৈক বন্ধু মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম Ñএর দরবারে হাজির হয়ে আরজ করেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমাদের দু’জনের একজন চিরকুমার থাকা ও অন্যজন জীবনভর গোশত না খাওয়ার সংকল্প করেছি। একথা শুনে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করলেন, ‘আমি তো দু’টোই করছি। আমি গোশত খাই এবং বিবাহিত জীবনযাপন করি।’ প্রশ্নকারী সাহাবী দু’জন তখন তাদের সংকল্প পরিত্যাগ করেন।
আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস রা. একজন দুনিয়াবিমুখ সাহাবী ছিলেন। একবার তিনি শপথ করেন, তিনি দিনে রোযা রাখবেন ও রাতভর ইবাদত বন্দেগী করবেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তা জানতে পেরে তাকে বলেন, ‘আব্দুল্লাহ! তোমার উপর তোমার দেহের হক আছে, তোমার চোখের হক আছে, এমনকি তোমার স্ত্রীরও হক আছে। মাসে তিনদিন রোযা রাখাই যথেষ্ট।’ ওসমান ইবনে মাজউন রা. ছিলেন একজন বিশুদ্ধ চিত্তের অধিকারী দুনিয়াবিমুখ সাহাবী। তিনি দিন-রাত ইবাদত-বন্দেগীতে লিপ্ত থাকতেন, স্ত্রীর সাথে কোন সম্পর্ক রাখতেন না। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ বিষয় জানার পর ইরশাদ করেন, ‘হে ওসমান! তুমি কি আমার তরীকা থেকে সরে গেছ? ওসমান রা. বললেন, ‘আমি তো আপনার তরীকাই অনুসন্ধান করছি। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে বললেন, ‘আমি ঘুমাই, নামাযও পড়ি, মহিলাদের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধও হই। হে ওসমান! আল্লাহকে ভয় কর। তোমার পরিবার পরিজনের, মেহমানদের এবং তোমার দেহের তোমার ওপর হক রয়েছে।’
বাহেলা গোত্রের জনৈক ব্যক্তি ইসলাম গ্রহণ করে নিজ গোত্রে ফিরে যায় এবং সারা বছর রোযা রাখতে থাকে। এক বছর পর সে যখন মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর দরবারে উপস্থিত হয় তখন তার চেহারা এমন পরিবর্তিত হয়ে গেছে যে, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে চিনতে পারেননি। সে তার নাম বলায় মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বললেন, ‘তুমি তো সুঠাম দেহের অধিকারী ছিলে। তোমার চেহারা এমন হয়ে গেল কেন? সে বললো, আমি আপনার কাছ থেকে ফিরে যাবার পর থেকে রোযা রেখেছি। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘তুমি নিজের জীবনকে আযাবে নিপতিত করছ কেন? রমযান মাস ছাড়া প্রতি মাসে একটি রোযা রাখাই যথেষ্ট।’ সে এর চেয়ে বেশি পরিমাণ রোযা পালনের ইচ্ছা প্রকাশ করলে তিনি তাকে প্রতি মাসে দু’টি করে রোযা রাখার অনুমতি দিলেন। এর চেয়েও বেশি পরিমাণ রাখতে চাইলে তাকে তিনি মহররম মাসে রোযা রাখতে বললেন।
ইসলাম দুনিয়াবী জীবনের সকল চাহিদা পরিত্যাগ করে সর্বক্ষণ ইবাদত-বন্দেগীতে মশগুল থাকতে বলেনি। বরং পার্থিব জীবন নির্বাহের জন্য যা কিছু অপরিহার্য, তা অবলম্বন করতে বলেছে। অবশ্য সে সবের জন্য নিয়মনীতি ঠিক করে দেয়া হয়েছে। সে অনুযায়ী জাগতিক ক্রিয়া-কলাপ সম্পাদন করলে তাতেও ইবাদতের মতই কল্যাণ লাভের প্রতিশ্র“তি রয়েছে।
আহার, নিদ্রা, উপার্জন ইত্যাদি কাজ-কর্ম পার্থিব জীবনের অপরিহার্য অনুষঙ্গ। এগুলোকে সম্পূর্ণরূপে উপেক্ষা করে কারো পক্ষে পৃথিবীতে টিকে থাকা সম্ভব নয়। তাই ইসলামী জীবন দর্শনে কোন মানুষকেই এসব পরিহার করতে বলেনি। অবশ্য তাকে পরিমিত ও ভারসাম্য রক্ষা করতে বলেছে। আহারের ক্ষেত্রে রসনাবিলাস, নিদ্রার নামে আলসেমী আর জীবিকা উপার্জনের বেলায় হালাল হারাম পার্থক্য না করা শরীয়তের দৃষ্টিতে নিন্দনীয়।
মহানবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন মানবতার নবী, মানব প্রকৃতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ জীবন ধারাই তিনি জগতবাসীকে দেখিয়ে গেছেন। শুধু তিনি নন, তাঁর পূর্বে যত নবী রাসূল দুনিয়াতে মানব জাতির মুক্তির বাণী নিয়ে আগমন করেছিলেন, তারা কেউই মানব স্বভাবের চাহিদা ও প্রয়োজনকে উপেক্ষা করতে বলেননি। কেননা আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাঁর বান্দাদের প্রতি বড়ই মেহেরবান। তিনি তাদের জন্য এমন বিধান দিতে পারেন না যা তাদের পালন করতে জটিলতার সম্মুখীন হতে হয়। আম্বিয়ায়ে কেরামের সহজ-সরল স্বাভাবিক জীবন-যাপন করতে দেখে অবিশ্বাসীরা অনেক সময় প্রশ্ন তুলেছিল। তারা এই বলে বিস্ময় প্রকাশ করেছিল যে, ইনি কেমন করে নবী হতে পারেন? তিনি তো আমাদের মতই আহার পানীয় গ্রহণ করেন, পরিবার প্রতিপালন করেন, জীবিকা নির্বাহের জন্য হাট-বাজারেও গমন করেন। অর্থাৎ আমাদের সাথে তাঁর জীবনযাত্রার তো কোন স্বাতন্ত্র্য নেই। তাহলে তিনি নবী হলেন কি করে? আল্লাহ তাআলা তাদের এ বক্তব্যের অত্যন্ত জোরালো ভাষায় প্রতিবাদ করেছেন। তিনি বলেন, দুনিয়াতে যদি ফেরেশতা বাস করত, তাহলে আমি ফেরেশতাদের মধ্যে থেকে একজনকে রাসূল করে পাঠাতাম। অর্থাৎ যেহেতু মানুষদের কাছেই আল্লাহর দীন উপস্থাপন করতে হবে, তাই মানুষের অকৃত্রিম জীবনযাত্রার সাথে একাত্ম কোন ব্যক্তি ব্যতীত নবী-রাসূল হওয়া যৌক্তিক নয়। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর গোটা জীবনে এমন নজীর ও আদর্শ স্থাপন করে গেছেন, যা অনুসরণ করা মানুষের পক্ষে সম্ভব।
বুখারী শরীফে বর্ণিত আছে একবার কতিপয় সাহাবী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বিবিগণের নিকট উপস্থিত হয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর রাত-দিনের ইবাদত সম্পর্কে খোঁজ-খবর নিলেন। (তাঁরা হয়ত মনে করেছিলেন যে, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সারা দিনরাত একমাত্র ইবাদত-বন্দেগী ব্যতীত আর কিছুই করেন না।) তাদেরকে যখন মহানবীর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইবাদতের কথা জানানো হলো, তখন তারা যেন তা খুবই কিঞ্চিত মনে করলেন। অতঃপর তারা বললেন, তাঁর ও আমাদের অবস্থা তো এক নয়। আল্লাহ তাআলা তো তাঁর পূর্বাপর সকল ত্র“টি-বিচ্যুতি ক্ষমা করে দেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। সুতরাং তিনি যতটুকু করেন, তাই তো তাঁর জন্য অতিরিক্ত। আর আমাদের অবস্থা তো তেমন নয়। সুতরাং আমাদেরকে অবশ্যই অধিক পরিমাণে ইবাদত-বন্দেগী করতে হবে। একজন বললেন, আমি সারা রাত ইবাদত করতে থাকব, এক মুহূর্তও ঘুমুবো না। আরেকজন বললেন, আমি সারা বছর রোযা রাখব, কখনই রোযাবিহীন থাকব না। অপরজন বললেন, আমি বিবাহ-শাদী করব না। তাঁদের এরূপ কথাবার্তার মাঝখানে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এসে উপস্থিত হলেন। তিনি বললেন, তোমরাই কি এরূপ বলাবলি করছিলে? ‘আল্লাহর শপথ আমি আল্লাহ তাআলাকে সবচেয়ে বেশি ভয় করি, আমার মধ্যে আল্লাহভীতি সবচেয়ে বেশি পরিমাণেই রয়েছে। তথাপি আমি রাতে নামায পড়ি, নিদ্রাও যাই, রোযা থাকি, রোযাহীন অবস্থায়ও কাটাই এবং আমি দাম্পত্য জীবনযাপন করি। যে ব্যক্তি আমার নীতি-আদর্শ থেকে বিমুখ হবে সে আমার দলভুক্ত নয়।’ ভারসাম্যপূর্ণ জীবন নির্বাহের জন্য এ হাদীসের বক্তব্য খুবই স্পষ্ট। আল্লাহর ভয় তথা তাকওয়া পরিপূর্ণ মাত্রায় থাকলেও যে তা জাগতিক জীবনের স্বাভাবিক গতি ও প্রকৃতির কোন অন্তরায় সৃষ্টি করে না, তা এখানে অত্যন্ত দ্ব্যর্থহীন ভাষায় প্রকাশ করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, দুনিয়াবী জীবনে স্বাভাবিক নিয়মের খেলাফ করা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামেরÑএর আদর্শেরই খেলাপ করা। তাই তা অনুমোদনযোগ্য নয়। কেউ নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম Ñএর সুন্নাহ পরিহার করে তার খাঁটি উম্মত বলে দাবী করার অধিকার রাখে না।
কোন কোন সাহাবীর বিবাহ-শাদী করার মত আর্থিক সঙ্গতি ছিল না। আবার তারুণ্যের প্রাবল্যে নিজেদেরকে সংযত রাখতেও পারছিলেন না। তাই জৈবিক চাহিদা সম্পূর্ণরূপে বিনাশ করার জন্য তারা বিশেষ অঙ্গটি কেটে ফেলার মনস্থ করেন। তাই তারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট উপস্থিত হয়ে পুরোপুরি সংসার বিমুখ হবার অনুমতি প্রার্থনা করেন। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের আসল উদ্দেশ্যে বুঝতে পেরে খুবই অসন্তোষ প্রকাশ করেন। এ প্রসঙ্গে সাহাবি সাদ ইবনে আবু ওয়াক্কাস রা. বলেন, যদি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ কাজের অনুমতি দিতেন তাহলে বহু লোক এর ওপর আমল করতে প্রস্তুত ছিল।
নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজে এক সাথে কয়েক দিনের রোযা রাখতেন। অর্থাৎ মাঝখানে ইফতার করতেন না। এভাবে কয়েকদিন কেটে যেত। তাঁর অনুসরণে সাহাবীগণও এরূপে রোযা রাখার অভিলাষ ব্যক্ত করেন। কিন্তু মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে নিষেধ করলেন। অনেকেই মনে করলেন, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের প্রতি দয়া পরবশ হয়ে নিষেধ করেছেন। তাই তারা দিনের শেষে ইফতার না করে লাগাতার রোযা রাখলেন। এভাবে দু’দিন কেটে যাবার পর তৃতীয় দিনে ঈদের চাঁদ দেখা গেল। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইফতার করলেন এবং বললেন, মাস যদি দীর্ঘায়িত হত তাহলে আমার রোযাও দীর্ঘ হত। তখন দেখা যেত যারা গোঁড়ামি করছে, তাদের অবস্থা কি দাঁড়ায়। সাহাবীগণ নিবেদন করলেন, হে আল্লাহ রাসূল, আপনি যে লাগাতার রোযা রাখেন! তিনি বললেন, আমার মত তোমাদের কে আছে? আমাকে আমার প্রভু (বিশেষ ব্যবস্থায়) পানাহার করান। তত্ত্বজ্ঞানীরা বলেন, আল্লাহর নবী আপন প্রভুর প্রতি এমন নিবিষ্টচিত্ত ও ধ্যানমগ্ন থাকতেন যে, তাঁর পানাহারের কষ্ট অনুভূত হত না। আল্লাহ প্রেমের অমিয় সুধা তাঁর দৈহিক ক্ষুধাকেও নিবৃত্ত করত।
মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উপরোক্ত হাদীসের ওপর ভিত্তি করে ফকীহগণ বলেন, উম্মতের জন্য লাগাতার কয়েক দিনের রোযা রাখা (মাঝখানে ইফতার না করে) বৈধ নয়।
একদিন নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মসজিদে গিয়ে দেখলেন, একটি রশি ঝুলছে। তিনি এর কারণ জিজ্ঞেস করে জানতে পারলেন, সেটি টাঙিয়ে রেখেছে জনৈকা যয়নবের দাসী। রাতে দাঁড়িয়ে ইবাদত করতে করতে সে যখন দাঁড়াতে অপারগ হয়ে যায় তখন সে এই রশি ধরেই উঠাবসা করে। একথা শুনে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেটি খুলে ফেলতে নির্দেশ দিলেন এবং বললেন, তোমরা যতক্ষণ সুস্থ থাকবে, সচেতন থাকবে, ততক্ষণই নামায আদায় করবে। যখন পরিশ্রান্ত ও অক্ষম হয়ে পড়বে তখন বসে থাকাই উত্তম।
একবার জনৈকা মহিলা মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম Ñএর সামনে দিয়ে যাচ্ছিল। আয়েশা রা. তাকে দেখে বললেন, এতো খাওলা। লোকেরা তার সম্পর্কে বলছে, তিনি নাকি রাতভর নিদ্রা যান না, ইবাদত-বন্দেগীতে অতিবাহিত করেন। তা শুনে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, সে কি রাতে মোটেই ঘুমায় না? লোক সকল! সেই পরিমাণ ইবাদত-বন্দেগীই কর যতটুকু ক্ষমতা তোমাদের আছে।
অনেক সাহাবী আল্লাহর সান্নিধ্য ও রহমত লাভের বাসনায় রাতভর নামাযে মশগুল থাকতেন। তাদেরকে লক্ষ্য করে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, তোমরা এই পরিমাণ কাজের কষ্ট সহ্য কর যা তোমাদের সাধ্যের আওতায়। তোমরা অস্বস্তিবোধ না করা পর্যন্ত আল্লাহ তাআলা অস্বস্তিবোধ করেন না। আল্লাহ তাআলার নিকট সেই কাজ অধিক পছন্দনীয় যা তোমরা সর্বদা নিয়মিত ও নিরবচ্ছিন্ন পালন করে যাও যদিও তা পরিমাণে কম হয়। হজ্জের সময় আরবে অনেক বৈরাগ্যমূলক আচার অনুষ্ঠান প্রচলিত ছিল। কোন কোন হাজী এরূপ অঙ্গীকার করত যে, এই সফরে সে মুখে কোন কথা বলবে না অথবা কোন বাহনে আরোহণ করবে না যদিও যানবাহন সংগ্রহের সুযোগ তার আছে। আবার কেউ শপথ করত যে, কখনো ছায়ায় অবস্থান করবে না, সব সময় প্রখর রোদেই অবস্থান করবে। আবার কেউ কেউ নিজের অপরাধের কথা প্রকাশ করার জন্য নাকে রশি বেঁধে রেখে কাবা শরীফ তাওয়াফ করত। কিন্তু ইসলাম এ সকল আচার ও আচরণকে চিরতরে নির্মূল করে দিয়েছে এবং এ ঘোষণা করেছে যে, অনর্থক ও ভিত্তিহীন কষ্টবরণ আল্লাহর সন্তুষ্টির পরিচায়ক হতে পারে না।
সাহাবি ওকবা ইবনে আমের রা.Ñএর বোন এ মর্মে শপথ করেছিলেন যে, তিনি পদব্রজে হজ্জ পালন করবেন। ওকবা রা. এ ব্যাপারে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম Ñএর নিকট জিজ্ঞাসা করতে এলে উত্তরে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, তোমার বোনের এই শপথের কোন প্রয়োজনীয়তা আল্লাহ তাআলার নেই। বরং তাকে গিয়ে বলো, সে যেন যানবাহনে চড়েই হজ্জ পালন করে।
হজ্জের সফরের সময় মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক বৃদ্ধকে দেখলেন যে, সে চলতে পারছে না। তার ছেলে তাকে উভয় দিকের হাত ধরে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিজ্ঞেস করে জানতে পারলেন যে, বৃদ্ধ লোকটি পদব্রজে হজ্জ আদায় করার শপথ করেছে। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে লক্ষ্য করে বললেন, কেউ তার নিজের জীবনের প্রতি কষ্ট আরোপ করুক, এমন কাজের কোন প্রয়োজন আল্লাহর নেই। তোমরা এই বৃদ্ধ লোকটাকে যানবাহনে চড়িয়ে দাও।
মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মানব জাতির জন্য ভারসাম্যপূর্ণ ও স্বাভাবিক জীবন দর্শন রেখে গেছেন। তাই দীন পালনের অর্থ অহেতুক কষ্ট স্বীকার করা নয়। আল্লাহ তাআলা কুরআন মজীদের মাধ্যমে বনি আদমের জন্য যে জীবন দর্শন দান করেছেন এবং নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তা যেভাবে পালন করে দেখিয়ে গেছেন, সেভাবে জীবন নির্বাহ করেই মানবজাতি প্রকৃত কল্যাণ ও শান্তি অর্জন করতে পারে। অন্য কোনভাবে নয়। নিজের উদ্ভাবিত পদ্ধতি ও নিয়ম অনুসারে দীন পালন করে সাফল্য লাভের আশা করাই বৃথা। বাড়াবাড়ি ও শৈথিল্যের মাঝামাঝি ভারসাম্যপূর্ণ জীবনবোধই ইসলামের মূলনীতি। ইসলাম তাই বাস্তববাদী জীবনাদর্শ। ভাববাদী কিংবা অতিন্দ্রীয় কোন জীবনধারা ইসলামে অনুমোদিত নয়।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন