সোমবার, ২০ ডিসেম্বর, ২০১০

শহীদ আইয়ুব আলী

শহীদ নং-৩
নাম: মো: আইয়ুব আলী
সাংগঠনিক মান: সাথী
শহীদ হওয়ার তারিখ: ১২ মার্চ ১৯৮২ রাত ১০ টা ৪৫ মিনিট
পিতার নাম: মো: আইজুদ্দীন
সর্বশেষ পড়াশুনা: অনার্স পরীক্ষার্থী, উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগ।
জীবনের লক্ষ্য: বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়া।
আহত হওয়ার স্থান: বি.এন.সি.সি ভবন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
অস্ত্রের ধরন: ইট,ছুরি, রামদা, বল¬াম, রড ও লাঠি।
কাদের আঘাতে শহীদ: ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্রলীগ(ক-চু), ছাত্রলীগ (মু-হা), ছাত্রমৈত্রী।
শহীদ হওয়ার স্থান: রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল।
স্থায়ী ঠিকানা: গ্রাম: ডাউকি, ডাক: বেলগাছি, থানা: আলমডাঙ্গা, জেলা: চুয়াডাঙ্গা।
ভাইবোন : ৮ জন।
ভাই-বোনদের মােঝ অবস্থান: সবার বড়।
পরিবারের মোট সদস্য: ৯ জন।
পিতা: জীবিত, পেশা: কৃষি।
মাতা: জীবিত, পেশা: গৃহিণী।
শহীদ হওয়ার পূর্বে স্মরণীয় বাণী: শাহাদতের পূর্বে শহীদ আইয়ুব আলী তার পিতাকে বলেছিলেন, “আমাদেরকে দুনিয়া থেকে যাওয়া উচিত মানুষের মত মানুষ হয়ে।” কথা শুনে পিতা বলেছিলেন, “আমরা তো মানুষই আবার কী রকম মানুষ হতে বলছো?” পিতার কথা শুনে আইয়ুব আলী বলেছিলেন, “যে মানুষ মারা গেলে সবাই তার জন্য চোখের পানি ফেলে আর সে হাসে।”
শাহাদতের পর শহীদের পিতার প্রতিক্রিয়া: মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এসে শহীদ আইয়ুবের অবস্থা দেখে ডুকরে কেঁদে ওঠেন তাঁর পিতা। শোকাহত পিতার কণ্ঠে চিৎকার উঠলো- ‘কী অপরাধ করেছিলো আমার ছেলে? আমি ওর মাকে গিয়ে কী বলব? ওর মা তো এ খবর শুনে বাঁচবে না।’
শহীদ আইয়ূব ভাইয়ের আব্বা, আম্মা, ছোট ভাই সহ পরিবারের অন্যান্য সদস্যবৃন্দ
শহীদ আইয়ূব আলী ভাইয়ের আব্বা-আম্মা নিজ বাড়িতে

আইয়ুব আমার বড় ছেলে

মো: আইজুদ্দিন

আইয়ুব আমার বড় ছেলে। ছোট বেলা থেকেই তার স্বভাব ছিল নম্র। ছোট ভাই-বোনদের সে খুব স্নেহ এবং আদর করত। আইয়ুবের শিক্ষা জীবন শুরু হয় পার্শ্ববর্তী গ্রামের বাদেমাজু স্কুলে। আইয়ুব ছিল অত্যন- মেধাবী। প্রাইমারী জীবনে সে বরাবরই ক্লাসে ফার্স্ট ছিল। প্রাইমারী শিক্ষা জীবন শেষ করে আলমডাঙ্গা পাইলট হাইস্কুলে ভর্তি হয়। এখানে এসেও ওর প্রতিভার স্বাক্ষর রাখে। ক্লাস টেন পর্যন- সে প্রত্যেক ক্লাসেই ফার্স্ট হয়। কিন' এস.এস.সি. পরীক্ষায় অসুস্থতার কারণে দ্বিতীয় বিভাগে উত্তীর্ণ হয়। ছোটবেলা থেকেই সে অত্যন- ধার্মিক হয়ে গড়ে ওঠে। ক্লাস সিক্স-এ ওঠার পর থেকেই নিয়মিত নামাজ পড়া শুরু করে। এসময় থেকেই সে অন্যের বাড়ির জিনিস খাওয়া বন্ধ করে দেয়। তার সামনে কোন খাবার দিলে সে জিজ্ঞাসা না করে খেত না। এস.এস.সি. পরীক্ষার পর আলমডাঙ্গা ডিগ্রী কলেজে ভর্তি হয়। কলেজ জীবন থেকেই তার সাংগঠনিক কাজ শুরু হয়। সংগঠনে যোগ দেয়ার পর থেকেই সে নিয়মিত কুরআন হাদীস অধ্যয়ন করত। মাঝে মধ্যে গ্রামের ছাত্রদের নিয়ে প্রোগ্রাম করত এবং ইসলামের কথা তাদেরকে বুঝাত। এ অবস্থা দেখে আমি বুঝতে পারলাম যে সে একটা দল করছে। তখন থেকেই আমি একটু চিনিন্ত হয়ে পড়লাম এবং আইয়ুবের আম্মাকে বললাম, ও যেভাবে ইসলামের কাজ করা শুরু করেছে তাতে আমার ঘরে ওর জন্ম নেয়া ঠিক হয়নি। কারণ আমরা তখন ঠিকমত নামাজ কালাম পড়তাম না। এমন অবস্থায় হঠাৎ একদিন পাশের বাড়ির মকবুল হোসেন মুন্সি আমাকে বলল,
আইয়ুব যে পথে নেমেছে তাতে তো ওকে ঠেকিয়ে রাখাই মুশকিল। কারণ চারদিকে বিরোধিতা। এরপর আমি তাকে বললাম, তুমি তো এ পথে নেমেছ। কিন্তু কবে যে কে তোমাকে মেরে ফেলবে! তখন আইয়ুব উত্তর দিল, আল্লাহর পথে এসে মরাও ভাল। আপনি লেখাপড়া শিখাতে পারেন কিনা মৃত্যুতো ঠেকাতে পারেন না। আইয়ুব এতই ধার্মিক ছিল যে, কঠিন শীতের রাত্রে উঠে নামাজ পড়ত। আমার জানা মতে সে কখনও নামাজ কাযা করেনি। এভাবেই তার কলেজ জীবন সমাপ্ত হয়। এইচ.এস.সি. পরীক্ষায় সে দ্বিতীয় বিভাগে উত্তীর্ণ হয়। এরপরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে ভর্তি হয়। পার্শ্বের বাড়ির সেই মকবুল মুন্সী ওকে রাজশাহীতে ভর্তি করে দিয়ে আসে। রাজশাহীতে পড়াকালে একদিন বাড়িতে এসে ওর বাল্য বন্ধু হান্নানকে সাথে করে মাঠ ভ্রমণে যায়। হান্নান একটি আখ ভাঙ্গে খাওয়ার জন্য। তখন আইয়ুব তাকে বাধা দিয়ে বলে, জমির মালিকের কাছ থেকে মাফ না নিয়ে আখ খাওয়া যাবে না। ঠিক সেই মুহূর্তে জমির মালিকের সাথে ওদের দেখা হয়। তখন আইয়ুব বলল, ‘হান্নান আপনার জমি থেকে একখানা আখ ভেঙ্গেছে। দয়া করে মাফ করে দিবেন।’ মাফ নেয়ার পর হান্নান আখ খাওয়ার জন্য গেলে আইয়ুব বলল, ‘বিনা পারমিশনে ভাঙ্গার যে অপরাধ হয়েছে সেই অপরাধের ক্ষমা চাওয়া হয়েছে কিন্তু খাওয়ার জন্য কোন অনুমতি দেয়া হয়নি সুতরাং খাওয়া যাবে না।’
রাজশাহীতে এক বছর থাকার পর সে একদিন বলল, ‘আব্বা, সংগঠনের ভাইয়েরা আমাকে নির্বাচন করার জন্য বলছে।’ তখন আমি বললাম, ‘তুমি সবেমাত্র বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে ভর্তি হয়েছো, আর এক্ষুণি তোমাকে নির্বাচন করতে হবে কেন?’ এরপর আমি নামাজ পড়ে দোয়া করলাম ভোটে ফেল করার জন্য। নির্বাচনের পর দেখা গেল সে দুই ভোটে ফেল করেছে। রাজশাহী থাকা অবস্থায় ঈদে মিলাদুন্নবী (সা:) উপলক্ষ্যে বক্তৃতা প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। এই প্রতিযোগিতায় আইয়ুব ফার্স্ট হয়। রাজশাহীতে থাকা অবস্থায় সে কলেজ লাইব্রেরীর সেক্রেটারী ছিল। এরপরেও একবার বাড়িতে এসে আমার কাছে বই কেনার জন্য টাকা চাইল, তখন আমি বললাম, ‘তুমি যে লাইব্রেরীর দায়িত্ব নিয়েছ সেখান থেকে ফ্রি বই নিয়ে পড়া যায় না?’ তখন সে উত্তর দিল, ‘আমি যদি ঐ লাইব্রেরীর বই পড়ি তাহলে গরীব মানুষের ছেলেরা কী করবে?’ আইয়ুব বাড়িতে আসলে একটু ঘুমাত বেশি। আমি বেশি ঘুমাবার কারণ জিজ্ঞেস করলে সে বলত, ‘রাজশাহীতে অফিসে সারারাত জেগে জেগে পোস্টার লিখতে হয়।’ আইয়ুব কলেজ জীবন থেকেই আর্ট শিক্ষা করে।
১৯৮২ সালে রাজশাহীতে যখন নবীন বরণ অনুষ্টিত হয় সেদিন নবীন বরণ অনুষ্ঠানে মারামারি হওয়ার পর পরই ২-৩ টা ছেলে আসে আমার বাড়িতে। ওরা বাড়িতে এসে বলল, আইয়ুব ভাই অসুস্থ; হাসপাতালে আছে। তখন ওর আম্মা কিছু নারিকেল, চিড়া, মুড়ি সাজিয়ে আমার হাতে দিল রাজশাহীতে যাওয়ার জন্য। ট্রেনের মধ্যে আমাকে একা একা একটা সিটে বসিয়ে রেখে ছেলেগুলো দূরে আরেকটা সিটে বসল। তখনই আমার মনে সন্দেহ হল। রাজশাহীতে পৌঁছলে ঘটনা জানতে পারলাম। আইয়ুবকে দেখার জন্য হাসপাতালে ঢুকার চেষ্টা করলাম। কিন্তু পুলিশ আমাকে ঢুকতে দিল না। আমি যখন খুবই পীড়াপীড়ি করতে লাগলাম তখন কর্তব্যরত পুলিশ অফিসার আমাকে বলল, আপনাকে ঢোকার অনুমতি দিতে পারি তবে শর্ত হল আপনি কোন কথা বলতে পারবেন না। আমি তাতেই রাজি হয়ে গেলাম। আইয়ুবকে দেখেই আমার চোখের পানি শুকিয়ে গেল এবং বাকশক্তি রুদ্ধ হয়ে গেল। রাত্রে আমাকে একটা মেসে রাখা হল। এই মেসেই আইয়ুবের সিট। আইয়ুবের রুমের পাশেই আমি সারারাত ছিলাম। সকাল ৮টার দিকে কয়েকজন আইয়ুবের রুমে এসে সব কিছু গভীর মনোযোগ সহকারে দেখতে লাগলো । জিজ্ঞাসা করে জানতে পারলাম তারা আইয়ুবের কাছে প্রাইভেট পড়ত। ওরা রুম থেকে বের হয়ে যাবার সময় সকলেই কান্নাকাটি করতে করতে চলে গেল। তখন আমার আর কিছুই বুঝতে বাকি রইল না। আমার আইয়ুব কোথায়।
(লেখক: শহীদ আইয়ুব আলীর গর্বিত পিতা)

মুকুলের স্কুলে যাওয়া হয়না কেন?

আনোয়ার হোসেন লুলু

সংগঠনে আসার পর থেকেই শহীদদের জীবনী, তাদের কর্মতৎপরতা, ব্যক্তিত্বসহ বিভিন্ন বিষয়ে জানার ইচ্ছা আমার প্রবলভাবে জেগে ওঠে। শহীদ আজিবর ভাইয়ের বাড়ি ছাড়া অন্য কোন শহীদের বাড়ি যাওয়া সম্ভব হয়ে ওঠেনি। এই প্রথম নতুন করে একজন শহীদের বাড়ি যাচ্ছি, ভাবতে ভালই লাগছে। ২ নভেম্বর ৯৭ রবিবার ট্রেন যোগে চুয়াডাঙ্গা স্টেশনে পৌঁছুলাম। তারপর রিক্সা নিয়ে সোজা গুলশান পাড়া চুয়াডাঙ্গা জেলার শিবির সভাপতি আসাদ ভাইয়ের ওখানে উঠলাম। দুপুরের খাবার শেষে একজন ভাইকে নিয়ে আলমডাঙ্গার উদ্দেশে রওয়ানা হলাম। মাগরিবের একটু পরেই আলমডাঙ্গা থানার শিবিরের সভাপতি মঈন উদ্দীন সিরাজী ভাইকে নিয়ে শহীদ আইয়ুব আলীর গ্রামের বাড়ি পৌঁছুলাম। শহীদের পিতা বাড়ি ছিলেন না। গ্রামেই এক মিলাদ মাহফিলে গিয়েছেন। সিরাজী ভাই রাতে থাকবেন না, তাই তাড়াতাড়ি করছেন চলে যাওয়ার জন্য। এজন্য শহীদের আম্মা তড়িঘড়ি করে খাবারের ব্যবস্থা করলেন। সবাই মিলে খেলাম। সিরাজী ভাই চলে গেলেন। আমি নিজের ভাল লাগার জন্যে অনেক জায়গা ঘুরেছি, বিশেষ করে কক্সবাজার থেকে শুরু করে দেশের অন্যান্য স্থানে। যাওয়ার আগে যে কৌতূহল, যে ভাল লাগা, উদ্দীপনা নিয়ে গেছি যাওয়ার পর আর অতটা ভাল লাগেনি। মানুষের স্বভাব হয় তো এরকমই হয়। ব্যতিক্রম হলো শহীদ আইয়ুব ভাইয়ের বাড়ি এসে। এখানে ভাল লাগবে এটা পূর্বেই আশা করেছিলাম কিন্তু এত যে ভাল লাগবে ভাবিনি। মনে মনে ভাবলাম আজকের
রাতটা যদি দুই রাতের সমান হতো তাহলে শহীদের আব্বা-আম্মার সাথে প্রাণ খুলে আরো বেশি গল্প করা যেত। প্রকৃতির নিয়ম বড় কঠিন। আমার ভাললাগাকে দাম দিচ্ছে না। তরতর করে সময় এগুচ্ছে। সত্যি বলতে কি আমার আটাশ বছরে জীবনে নিজের মাও এত কাছ থেকে, এত আদর করে আমাকে খাওয়ায়নি যেভাবে শহীদ আইয়ুব ভাইয়ের আম্মা সেই দিন রাতের খাবার খাওয়ালেন। আমি মনে মনে ভাবলাম হায়রে। শহীদ জননী জাহানারা ইমাম, আপনিও শহীদের জননী, আর শহীদ আইয়ুব আলীর মাও শহীদ জননী। মনের অজানে-ই প্রিয় মনিবকে বললাম, “হে রাজাধিরাজ, শহীদ আইয়ুবের জননীকে বেহেসে-র এমন নিকুঞ্জে স্থান দিও যা দেখে দুনিয়ার মিথ্যা দাবিদার তথা কথিত শহীদদের জননীরা নিজেদের ভুল বুঝতে পারে। শহীদের পিতা হাতে হারিকেন নিয়ে বাড়ি ফিরে এলেন। সালাম দিলাম। রাজশাহী থেকে এসেছি শুনে খুশি হলেন। চুল-দাড়ি পাকা শহীদ আইয়ুব আলীর পিতা পুত্রশোক বুকে চেপে এখনও বেঁচে আছেন। মৃত্যু ব্যাপারটা মনে হয় এরকমই, বয়সের সাথে সম্পর্ক নেই, সম্পর্ক নেই দাঁত পড়া, চুল পাকার সাথে।
শহীদ আইয়ুব আলীর স্মৃতি নিয়ে কখনও শহীদের পিতা কখনও বা মাতার সাথে কথা হচ্ছে। শহীদ আইয়ুবেরা চার ভাই চার বোন। সবার বড় শহীদ আইয়ুব। শহীদ আইয়ুবের পরে তিন ভাই যথাক্রমে তৈয়ব, গোলাপ আর সবার আদরের ছোট মুকুল। সময় যত যাচ্ছে বাড়ির সবার সাথে সখ্যতা ততই বাড়ছে। আম্মার আবেগের সকল স্নায়ুগুলি তার চোখ আর গলাকে চিপে ধরেছে। চোখ থেকে পানি গণ্ডদেশ বেয়ে অঝোরে ঝরছে। কথাগুলো কাঁপা গলায় এলোমেলো হচ্ছে। আমি এখনও দেখতে পাচ্ছি সে করুণ দৃশ্যটি। মাটির বারান্দায় বসে আছি, সামনে কুপির আলো বাতাসে দোল খাচ্ছে। শহীদের আম্মার দুঃখগুলি অন্ধকারের ইথারে দ্রবিভূত হচ্ছে। এ দুঃখের শেষ নেই, কেউ খবর রাখে না। আমি পরিবেশ সহনশীল করার চেষ্টা করছি। শহীদের আম্মা শহীদ আইয়ুব আলীর স্মৃতিচারণ শুরু করলেন।
খুব ছোটতে আইয়ুব আলীকে নিয়ে ওর নানার বাড়ি গিয়েছিলাম। তখন ওর বয়স মাত্র আড়াই বছর। আখ খাবে বলে খুব বায়না ধরল। ওকে উপেক্ষা করা সম্ভব হল না। বাধ্য হয়ে ওর নানার জমি দেখিয়ে দিলাম। জমির কাছে ওর ছোট নানা বসে ছিল। পরে আখ নিয়ে বাড়ি এল। আখ আনতে গিয়ে কী ঘটেছিল তা পরে ওর ছোট নানা আমাকে বললেন, “ও আইয়ুবের মা, তোমার আইয়ুব আখ আনতে মাঠে গেছে। আমি ওরে হাতে আখ দিতেই আইয়ুব বলল, আমি আমার নানার জমির আখ খাব। কিছুতেই আমার জমির আখ হাতে নিল না। বাধ্য হয়ে ভায়ের জমি থেকে আখ কেটে দেই।”
আনুগত্যশীল বালক আইয়ুব আলী কিভাবে মায়ের কথাকে পালন করেছিল! মা যা বলেছে তাই করেছে। সুতরাং কেন খাবে অন্যের জমির আখ! মনে হয় শহীদেরা এভাবেই নিষ্পাপ থাকে খোদার তত্ত্বাবধানে। আখ খাওয়া নিয়ে দ্বিতীয় ঘটনাটি হল শহীদ আইয়ুব আলীর ইমিডিয়েট ছোট ভাই তৈয়বকে নিয়ে। তৈয়ব ছোটতে একবার অন্যের জমির আখ কেটেছিল। বিষয়টি আইয়ুব আলী জানতে পেরে তৈয়বকে বেশ মেরেছিল। তাতে বাড়ির অনেকেই বিশেষ করে মরহুমা দাদীমা আইয়ুব আলীকে বেশ বকাঝকা করেছিলেন। যার কারণে শহীদ আইয়ুব আলী বাড়ি থেকে রাগ করে চলে যাচ্ছিলেন। বলেছিলেন, “অন্যায় করবে আর তাকে শাসন করা যাবে না যে বাড়িতে সে বাড়িতে আমি থাকব না।” সবাই তাকে বুঝাবার চেষ্টা করল। তারপর শহীদের আম্মা যা বললেন তা সত্যিই আমাকে বিস্মিত করল। তিনি (শহীদের আম্মা) বললেন, “সেই শাসনের পর থেকে শুধু তৈয়ব কেন তার কোন ভাই-ই আজ পর্যন- কারো জিনিস স্পর্শ করা শেখেনি।” একটা অন্যায় আরেকটা অন্যায়কে প্রশ্রয় দেয়। সে কথাটি শহীদ আইয়ুব আলী ভাল করেই জানতেন। শহীদ আইয়ুব বেঁচে নেই কি্ন্তু তার স্নেহমাখা শাসন এখনও সেই ছোট্ট পরিবারে বেঁচে আছে।
চাল-চলন, স্বভাব-চরিত্রে শহীদ আইয়ুব আলী ছিলেন অমায়িক। মানুষের দুঃখ-কষ্টে কাতর হতেন। তিনি ছাত্র হিসাবে খুবই মেধাবী ছিলেন। ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্র হয়ে অষ্টম শ্রেণীর অংক করতে পারতেন। সব সময় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকতেন। থালা বাটি কাপড় চোপড় একটুও এমন তেমন কিংবা নোংরা হওয়ার উপায় ছিল না। শহীদের পিতা বললেন, “ওর মা থালা বাটি পরিষ্কার করে দিলেও আইয়ুব আবার প্ল্লেট পরিষ্কার করে নিতো। খাদ্যের মধ্যে ডিমটাই বেশি পছন্দ করত। গাছ লাগানো, বাগান করতে ভালবাসত। ওর লাগানো গাছ এখন অনেক বড় হয়েছে।” কথা বলতে বলতে ভাবনার সমুদ্রে ডুব দিলেন। হারিয়ে গেলেন দেড় যুগ আগের জীবনে। তার চোখে মুখে তখন ক্লানি-র ছাপ স্পষ্ট। মনে হচ্ছে সারা দিনের হাড় ভাঙ্গা পরিশ্রমে তার শরীর ক্লানি-তে নেতিয়ে পড়ছে। এখনই তার ঘন্টা পাঁচেক ঘুমের দরকার।
পিতা-মাতা বুক ভরা আশা নিয়ে শহীদ আইয়ুবকে সেই ছোট থেকে কোলে পিঠে করে মানুষ করেছেন। নিজেরা শত কষ্ট করে চলেছেন তবুও ছেলেকে কষ্ট বুঝতে দেননি। নিজেরা সব সময় কম খরচে চলার চেষ্টা করেছেন। কেননা তারা জানতেন না কখন তাদের ছেলের কোন প্রয়োজন হয়। তাদের আশা ভরসার কেন্দ্রবিন্দু ছিল শহীদ আইয়ুব। ছেলে লেখাপড়া শিখে চাকরি করবে, সংসারের হাল ধরবে, ছোট ভাইদের মানুষ করবে, দুঃখের দিনের অবসান হয়ে সোনার সংসার উজ্জ্বল হবে। কিন্তু পিতা-মাতার সেই স্বপ্ন পূরণ হয়নি। ১৯৮২ সালে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ সে স্বপ্নকে ভেঙ্গে চুরমার করে দিয়েছে। তাই আজও অগোছালো শহীদের পরিবার। লক্ষ্য করে দেখলাম, আম্মার চোখ থেকে পানি ঝরছে। এ পানি শুকাবে না। চোখের পানিই ওদের সান-্বনা, চোখের পানিই ওদের সুখ। আম্মা আবারও তাদের দুঃখের দিনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বললেন, “১৯৮২ সালের প্রথম দিকের কথা। আইয়ুব আলীর একটা চাদর ছিল। ওটা গায়ে দিয়ে আইয়ুব কলেজে যেতে পারত না। বাড়িতে এসে যখন চাদর কেনার কথা বলল তখন ওর আব্বা চাদর কিনতে উদ্যত হল। আইয়ুব আলী বলল, এবার শীত তো চলেই গেল, সামনেবার কিনলেই হবে। সামনের বার আর ফিরে এলো না।” এভাবেই শহীদের অজানা অধ্যায় শেষ হল। শহীদের পিতা একবার আইয়ুব আলীর আম্মার জন্য একটা ভাল শাড়ি কিনে এনেছিল। কিন্তু কিছুতেই শহীদের আম্মা ঐ শাড়ি নেয়নি। কেঁদে কেঁদে আম্মা বলেছিলেন, “আমি ভাল শাড়ি পরবো আর আমার আইয়ুব রাজশাহীতে কষ্ট করবে তা হয় না। ও পড়ালেখা শেষে যখন চাকরি করবে তখন ভাল শাড়ি পরবো।”
১৯৮২ সালের ১১ মার্চ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি কালো অধ্যায়। মানবতার মুক্তির সনদ বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির ইসলামের ঝাণ্ডাবাহী কাফেলা আল্লাহর বাণীকে সেদিন ক্যাম্পাসের হাজার হাজার ছাত্র-ছাত্রী, শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীর সামনে বুলন্দ আওয়াজে পৌঁছে দিতে চেয়েছিল, কিন্তু ছাত্র নামের কলঙ্ক ইসলামের শত্রুরা তা সহ্য করতে পারলো না। খুনের নেশায় মেতে উঠল সন্ত্রাসীরা। চারিদিক থেকে আক্রমণ শুরু করল মানুষ খেকো হায়েনারা। রক্তে রঞ্জিত হল মতিহারের সবুজ চত্বর। আহত হল শত শত, আর শাহাদাতের কাউছার পান করলেন চারজন। কালের সাক্ষী বহন করছে আজও সারিবাঁধা দেবদারু আর ইউক্যালিপটাস বৃক্ষগুলি। কারও চোখের শোকাশ্রুকে ফাঁকি দিতে পারেনি সেদিন। শহীদদের সাথীরা আজও গভীর শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে তাদের প্রিয়জনদের। শহীদী কাফেলা দিনটিকে ‘শহীদ দিবস’ ঘোষণা করে সারা দেশে যথাযোগ্য মর্যাদা ও ভাবগাম্ভীর্যের সাথে পালন করে থাকে।
গুরুতর আহত অবস্থায় আইয়ুব আলীকে রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হল। কিন' মারাত্মক আঘাত প্রাপ্ত আইয়ুব আলী এ পৃথিবীকে আর সময় দিতে চাইলেন না। তার প্রিয় মনিবের ডাকে সাড়া দিয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। ১২ মার্চ ’৮২ শহীদের পিতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে এসে ডুকরে কেঁদে ওঠেন। তিনি শোকাহত কণ্ঠে চিৎকার করে বললেন, “কী অপরাধ করেছিল আমার আইয়ুব? আমি ওর মাকে গিয়ে কী বলবো! ওর মা তো এ খবর শুনে বাঁচবে না।” শহীদ আইয়ুব সত্যিই কি কোন অপরাধ করেছিল? এর উত্তর কে দেবে তার পিতা-মাতাকে?
রাজশাহীর উত্তপ্ত ময়দান কখন কী হয় ভেবেই অশান- পিতা যখন শহীদ আইয়ুব আলীকে সাবধান করে কিছু বলতেন তখন আইয়ুব আলী বলতেন, আল্লাহ মৃত্যু চাইলে আপনি কিছুতেই আমাকে রাখতে পারবেন না। দোয়া করবেন যাতে মানুষ হয়ে মরতে পারি।’
টেবিলে মাথা রেখেই ঘুমাতেন আইয়ুব আলী পড়ার ক্লান্তি দূর করার জন্য। মা বলতেন, “বাবা বিছানায় ঘুমা।” কিন্তু তিনি পড়াকেই খুব গুরুত্ব দিতেন। সংসারের কষ্ট দূর করার জন্য কষ্ট করেই পড়াশুনা করতেন তিনি। শহীদ আইয়ুব আলীর পিতা দুঃখ করে সেই কথাগুলো শেষে বললেন, “আইয়ুব শহীদ হয়ে তেমন কোন ক্ষতি হয়নি। কিন্তু কাউকে আর পড়াশুনা করানো হল না। মুকুলেরও স্কুলে যাওয়া হচ্ছে না।” মুকুলের স্কুলে যাওয়া হচ্ছে না কেন, সাহস হল না জানতে আমার। পৃথিবীতে অনেক প্রশ্নের উত্তর অজানা থাকে। তার মধ্যে একটা হল: কেন ছোট ভাই মুকুলের স্কুলে যাওয়া হচ্ছে না? যদি কেউ উত্তর জানেন তাহলে বলবেন কি, কেন মকুলের পড়াশুনা হচ্ছে না?
(লেখক: ব্যবস্থাপনা শেষ বর্ষ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়)

কোন মন্তব্য নেই: