তাফহীমুল







 


মওদূদী (রহ:) : ইসলামের আলোয় আলোকিত এক নেতা
“আল্লাহর দ্বীন সিংহ শার্দুলের ন্যয় বাহাদুর মানবের জন্য অবর্তীর্ণ, বাতাসের গতিকে পাল্টে দেয়ার হিম্মত রয়েছে যাদের বুকে, যারা অল্লাহর রঙকে প্রাধান্য দেয় ধরার সকল রঙের উপরে, ভালোবেসে অল্লাহর রঙে রাঙাতে চায় বসুন্ধরা। নদীর গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসানোর জন্য মুসলমানকে সৃষ্টি করা হয় নি বরং জীবনের বহমান স্রোতধারার দিক সিরাতুম মুস্তাকিমের পানে ঘুরিয়ে দেয়ার হিম্মত রয়েছে যার, সেইতো মুসলমান”।—-সাইয়্যেদ আবুল আ’লা মওদূদী (রহঃ)
অন্ধকার যুগের পরিসমাপ্তি টেনে যে মুসলিম জাতি পৃথিবীর প্রতিটি প্রান্তর সত্যের আলোয় আলোকিত করেছিল, গাঢ় অমানিষার বুক চিরে যারা ছিনিয়ে এনেছিল সুবেহ সাদেকের স্বর্গীয় আভা, এনেছিল সোনালী সূর্যোদয়, যারা অজ্ঞতা আর মূর্খতার কফিনে পেরেক ঠুকে জ্বালিয়েছিল জ্ঞানের আলো, তারাই একসময় আবার হারিয়ে যায় অন্ধকারে। যাদেরকে শ্রেষ্ঠ জাতির মর্যাদা দেয়া হয়েছিল তারাই পদে পদে লাঞ্ছনা, গঞ্জনা, অত্যাচার, নীপিড়নের শিকার হয়ে ধুকে ধুকে কীটপতঙ্গের মতো প্রাণ হারাতে শুরু করে। মুসলমানদের অবস্থা এতো সঙ্গীন হয়ে পড়ে যে অনেকেই নিজেদেরকে মুসলিম পরিচয় দিতে লজ্জা পেতে শুরু করে, অনেকেই ধর্মান্তরিত হয়ে ফিরে যায় পৌত্তলিকতার দিকে। নিজেদের অজ্ঞতা আর অক্ষমতার ঝাল মেটাতে ইসলামকেই তারা তাদের টার্গেটে পরিনত করে দোষারোপ করা শুরু করে, তাদের কাছে মনে হয় দূনিয়ার তাবৎ সমস্যার মূল ইসলাম। ইসলামের নাম নিশানা পৃথিবীর ইতিহাস থেকে মুছে ফেলতে পারলেই পৃথিবী হয়ে উঠবে পূতঃপবিত্র, থাকবে না কোন লাঞ্ছনা, গঞ্জনা, হতাশা। অথচ অতীতের দিকে একবারও ফিরে তাকানোর সাহস হয় না তাদের, অতীত থেকে শিক্ষা নিয়ে পৃথিবীতে আলোর মশাল জ্বালানোর হিম্মত, সে তো দূরের কথা।
এমন এক পরিস্থিতিতে পৃথিবীর দুটো প্রাচীন সভ্যতার লীলাভূমি মিশর ও ভারত থেকে ইসলামের পূনর্জাগরণের জন্য আলোর মশাল নিয়ে এগিয়ে আসেন জমিয়ত আল-ইখওয়ান আল-মুসলিমুন (মুসলিম ব্রাদারহুড) নামে ইসলামী আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা সাইয়্যে কুতুব শহীদ (রহঃ) এবং জামায়াতে-ইসলামীর প্রতিষ্ঠাতা সাইয়্যেদ আবুল আ’লা মওদূদী (রহঃ)।
ভারতীয় উপমহাদেশে যখন ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন তুঙ্গে, বিশ্বের দিকে দিকে বাজছে যুদ্ধের দামামা, তেমন এক সময়ে ইসলামী আন্দোলনের পূনর্জাগরণ নিয়ে চিন্তা করা এবং মুসলমানদের হারানো ঐতিহ্য ফিরিয়ে এনে অধ:পতিত মুসলিম সমাজকে আবার জ্ঞান রাজ্যে ফিরিয়ে আনার জন্য জামায়াতে ইসলামী প্রতিষ্ঠার যে মহৎ উদ্যোগ সাইয়্যেদ আবুল আ’লা মওদূদী গ্রহণ করেছিলেন তা ইতিহাসে তাঁকে অমরত্ব দান করেছে।
তার রচিত ১২০টিরও বেশি গ্রন্থ ও প্যামপ্লেট, একহাজারেরও বেশি ভাষণের সংরক্ষিত সাতশত ভাষণ ইসলামী আন্দোলনের জন্য অমূল্য সম্পদ। আজো বিশ্বের লক্ষ লক্ষ ইসলামপ্রিয় জ্ঞানপিপাসু জনতাকে ইসলামের সঠিক দিক-নির্দেশনা দিয়ে যাচ্ছে চলি্লশেরও বেশি ভাষায় অনুদিত তাঁর অমর সাহিত্যকর্ম।

বাংলা তাফহীমুল কোরআন
সকল সূরা একসাথে পেতে এখানে ক্লিক করুন

 

আলোকিত নেতা মওদূদী (রহ:) : লেখালেখিতে হাতেখড়ি

“শহীদের রক্তের চেয়ে জ্ঞানীর কলমের কালি উত্তম”। মওদূদী (রহঃ) তার জীবনে হাদীসের এ বাণীকে এতো গুরুত্ব দিতেন যে কলমকেই তার জিহাদের প্রধান হাতিয়ার বানিয়ে নেন। তিনি তার জীবনের অধিকাংশ সময় ব্যয় করেন জ্ঞানার্জনে এবং গ্রন্থ রচনায়। দিনের শেষে যখন সমগ্র পৃথিবী ঘুমের কোলে মাথা লুকায়, তখন তিনি বসে পড়তেন বইপত্র আর কাগজ-কলম নিয়ে। রাতের পর রাত তিনি পার করেছেন অধ্যয়ন করে, দ্বীনের খেদমতে ইসলামের বিভিন্ন বিষয় ও সমসাময়িক সমস্যাবলী নিয়ে মৌলিক গ্রন্থ রচনায়।
তিনি নিছক কল্পনাপ্রসুত বিষয়াদি নিয়ে লেখালেখির পক্ষপাতি ছিলেন না, তিনি লিখতেন কোরআন-হাদীস অধ্যয়ন করে, পূর্ববর্তী মনিষীদের ইসলামী বিভিন্ন বিষয় নিয়ে লেখা প্রামাণ্য গ্রন্থ পড়ে এককথায় প্রচুর সহায়ক পুস্তক অধ্যয়ন করে। আর এ কারনেই তার যেকোন বই পাঠ করলে শতাধিক গ্রন্থের রেফারেন্স পাওয়া যায়।
তার ক্ষুদ্র জীবনে বারবার তিনি কারা নির্যাতন ভোগ করেন, কিন্তু কারাগারকেই তিনি তার স্টাডিরুমে পরিনত করেন। তার অনেক মৌলিক গ্রন্থ এমনকি তাফহীমুল কোরআনের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ তিনি জেলখানাতে বসেই লিখে ফেলেন। আর জীবনের শেষ দিকে আমেরিকার বাফেলো হাসপাতালে বসে তিনি লিখতে থাকেন “সিরাতে সরওয়ারে আলম” নামের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সীরাত গ্রন্থ।
লেখালেখির ক্ষেত্রে তিনি এতো সতর্কতা অবলম্বন করেন যে গবেষণার ক্ষেত্রে তিনি নতুন দিগন্তের সৃষ্টি করেন। তাফহীমুল কোরআন রচনার ক্ষেত্রে তিনি এটা অনুভব করেন যে কোরআন যে পরিবেশে যে পরিস্থিতিতে নাজিল হয় তা না জেনে কোরআনের ব্যাখ্যা করলে অনেক কিছুই অস্পষ্ট থেকে যায়। এজন্য তিনি তাফহীমুল কুরআন রচনার ক্ষেত্রে সৌদি আরব সফর করে কোরআন নাজিলের বিভিন্ন স্থান স্বচক্ষে ঘুরে ঘুরে দেখেন, অনুধাবক করেন ভৌগলিক অবস্থান, স্থানীয় অধিবাসীদের উপর আবহাওয়া ও ভৌগলিক প্রভাব ইত্যাদি। এমনকি যে সকল ক্ষেত্রে চিত্রের প্রয়োজন হয় তিনি মানচিত্র একে সে চিত্রগুলো পাঠকের সামনে তুলে ধরার চেষ্টা চালান।
মওদূদী (রহঃ) জীবনের শুরুতেই ১৯২০ থেকে ২৮ সালের মধ্যে একটি আরবী, তিনটি ইংরেজী গ্রন্থের অনুবাদ করে তার লেখালেখিতে হাতেখড়ি দেন। তবে এ সময়ে তার সমচেয়ে মৌলিক কাজ হলো !@খ!১ রচনা। গ্রন্থ রচনার ইতিহাসটি জানলে বুঝা যায় চবি্বশ বছরের টগবগে যুবক ইসলাম নিয়ে কতটা ভাবতেন, ইসলামের দুর্দিনের চিন্তায় কতটা কাতর ছিলেন।
ভারতীয় ইতিহাসে ১৯২৬ সাল মুসলমানদের জন্য এক দুযের্াগপূর্ণ সময়। এ বছরের ডিসেম্বরের শেষ দিকে শুদ্ধি আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা স্বামী শ্রদ্ধানন্দ আততায়ীদের হাতে মারা যান। দুর্ভাগ্যজনকভাবে একজন মুসলিম এ কাজের জন্য অভিযুক্ত হয়ে গ্রেফতার হয়। চারিদিকে হা রে রে রে রবে ইসলাম বিদ্বেষীরা ইসলামের শ্রাদ্ধ করার জন্য উঠে পড়ে লাগে। ইসলাম একটি সন্ত্রাসী ধর্ম, কোরান সন্ত্রাসবাদের জন্মদাতা, যতদিন কোরআন থাকবে ততদিন বিশ্বে শান্তি আসতে পারে না ইত্যাদি ইত্যাদি অপবাদে ইসলামকে বিদ্ধ করা হলো। প্রচার করা হয় শ্রদ্ধানন্দকে ইসলামে শত্রু সাব্যস্ত করে বেহেস্তের আশায় মুসলমানরা এ হত্যাকান্ড চালিয়েছে। অর্থাৎ বিধর্মীদের হত্যা করে মুসলমানরা বেহেস্তে যাওয়ার জন্য সন্ত্রাসী কার্যক্রম শুরু করেছে বলে চারিদিকে হৈচৈ শুরু হয়।
অবস্থা এতটা নাজুক আকার ধারন করে যে, অহিংস রাজনীতির প্রবক্তা এবং হিন্দু ধর্মের সবচেয়ে পরিপক্ক বুদ্ধির অধিকারী হিসেবে তৎকালীন সমাজে পরিচিত গান্ধীজীও মন্তব্য করে বসেন, “ইসলাম এমন পরিবেশে জন্মলাভ করেছে যে, তার চুড়ান্ত শক্তির উৎস আগেও তরবারী ছিল, এখনও তরবারীই আছে”। মোট কথা ইসলাম ও সন্ত্রাসবাদকে একাকার করে ঘোলাপানিতে মাছ শিকারে নেমে পড়ে ইসলামবিরোধীরা।
এমন এক পরিবেশে ২৪ বছরের যুবক মওদূদী দিল্লী জামে মসজিদে জুমুয়ার নামাজে ইমাম সাহেবের আবেগময় খুৎবা শুনে অস্থির হয়ে পড়েন। ইমাম সাহেব বলেন, “হায় খোদা, ভারতবর্ষে আজ যদি এমন কোন আল্লাহর বান্দা ইসলামের জিহাদ নীতির উপর প্রামাণ্য গ্রন্থ রচনা করতো, ইসলাম বিরোধী অপপ্রচারের দাতভাঙ্গা জবাব দিয়ে ইসলামের প্রকৃত রূপ সবার সামনে তুলে ধরতো তবে কতই না ভালো হতো।” যুবকটি নামাজ শেষে মনস্থির করে ফেললো, বুকভরে নির্মল বাতাস টেনে নিয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললো যে আল্লাহ এই নির্মল বাতাস দিয়ে আমার অন্তরকে ভরিয়ে দেন, আমি কেন তার মহিমা ঘোষণার জন্য তার পক্ষে কলম ধরবো না।
২৪ বছরের এ টগবগে যুবক লিখে ফেললেন “আল জিহাদ ফিল ইসলাম” নামের এক অসাধারন পুস্তক যা ইসলামে জিহাদের প্রকৃত পরিচয় অমুসলিমদের কাছে স্পষ্ট করে তোলে। বইটি এতোটা তথ্যপূর্ণ ও গুরুত্বপূর্ণ ছিল যে আল্লামা ইকবাল তার এ বইটি পাঠ করে অত্যন্ত আবেগাপ্লুত হয়ে ভূয়সি প্রশংসা করেন, “জিহাদ, যুদ্ধ ও সন্ধি সম্পর্কে ইসলামী আইন-কানুন সম্বলিত এ গ্রন্থটি অসাধারণ ও চমৎকার। প্রত্যেক জ্ঞানী ও সুধীকে গ্রন্থটি পাঠ করার জন্য অনুরোধ করছি”।
যে সময়ে মুসলমানরা বিধর্মীদের অপপ্রচারে ছিল দিশেহারা, সেসময়ে ২৪ বছরের এ যুবক অসীম সাহসে এ গ্রন্থ রচনা করে ইসলামের পক্ষে যে ভূমিকা রেখেছিল তা আজো অবিস্মরণীয়।

আলোকিত নেতা মওদূদী (রহ:) : রাজনৈতিক ময়দানে পদচারণা

যে মুসলিম জাতি দোর্দান্ত প্রতাপের সাথে রাজনীতির ঘোড়া দাবড়িয়ে বেরিয়েছে চতুর্দিকে, যাদের নেতা সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব, সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী হয়রত মুহাম্মাদ (সাঃ) রাজনীতিকে রাঙিয়েছেন আদর্শিক রঙে, নিজে নেতৃত্ব দিয়েছেন সত্যের সমরে ইসলামের সূর্য যখন পশ্চিমাকাশে ঢলে পড়তে শুরু করে তখন তাঁরই অনুসারীরা “ইসলামে রাজনীতি হারাম” বলে ফতোয়া দিয়ে নিজেদের পিঠ বাঁচাতে মসজিদের কোনে খিল এটে ইসলামকে অবরুদ্ধ করে ফেলে।
মাওলানা মওদূদী (রহঃ) উপলব্দি করেন যে মুসলমানদের মাথা উচু করে চলতে হলে কুরআনকে গেলাফের কারাগার থেকে মুক্ত করে সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে স্বাধীনভাবে চলার সুযোগ দিতে হবে। কুরআন ঝাড়ফুঁক বা তাবিজ হিসেবে ভুত তাড়ানোর জন্য কিংবা রোগব্যাধি সাড়াতে পৃথিবীতে নাজিল করা হয় নি বরং কোরআনের মূল কাজ হলো সমাজের রন্ধে রন্ধে যে অসুখ দানা বেঁধেছে তার মূলোচ্ছেদ করা। আর এ জন্য কুরআনকে শেলফ থেকে মুক্ত করে সমাজে ছড়িয়ে দেয়ার জন্য মওদূদী রাসূলের (সাঃ) অনুসরণে আদর্শিক রাজনীতির পুর্ণজাগরণের প্রয়োজনীয়তা ব্যাপকভাবে উপলব্ধি করেন।
১৯২০ সালের দিকে মওদূদী (রহঃ) রাজনীতির ময়দানে পদচারনা শুরু করেন। শুরুতে তিনি খেলাফত আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত হন এবং তাহরীক-ই-হিজরতের সঙ্গে জড়িয়ে পরেন। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন তাহরীক-ই-হিজরত তৎকালীন সময়ে ভারতীয় মুসলমানদের সদলবলে আফগানিস্তান হিজরতের জন্য উৎসাহিত করে। কিন্তু তার কাছে সংগঠনের পরিকল্পনা ও কর্মকৌশল আরো বাস্তবসম্মত হওয়া উচিত বলে মনে হয় এবং এক্ষেত্রে তিনি সংগঠনের নেতৃত্বে সন্তুষ্ট হতে পারেন নি। ফলে তিনি এ আন্দোলন থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেন এবং ব্যক্তিগত শিক্ষা ও জীবিকার কাজে বেশি নিমগ্ন হন।
মাওলানা সাইয়্যেদ আবুল আ’লা মওদূদী (রহঃ) ইতোমধ্যে তার রাজনৈতিক ও সাংবাদিকতা জীবনের বাস্তব অভিজ্ঞতা, নীবিড় অধ্যয়ন ও জ্ঞান সাধনার মাধ্যমে অর্জিত জ্ঞানের আলোকে তার রাজনৈতিক চিন্তাচেতনাকে ঢেলে সাজান এবং জামায়াতে ইসলামী নামে একটি আদর্শ ইসলামিক সংগঠনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। এ সংগঠনে তিনি প্রতিষ্ঠাতা আমীর নির্বাচিত হন এবং ১৯৭২ সাল পর্যন্ত আমীর হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে হয়। শারীরিক অনুস্থতার কারনে তিনি এ বছরই আমীরে জামায়াতের দায়িত্ব থেকে অব্যহনি নেন।