শুক্রবার, ১৮ ফেব্রুয়ারী, ২০১১

মানবতার ধর্ম ইসলাম

প্রথম পর্ব
ইসলাম একটি পরিপূর্ণ এবং সামগ্রিক জীবন বিধান হিসেবে ইতোমধ্যেই বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। বিশেষ করে জ্ঞানী গুণী বিশেষজ্ঞগণ মহান এই ধর্ম নিয়ে পড়ালেখা করতে গিয়ে এই ধর্মের প্রকৃত শিক্ষা ও স্বরূপের সাথে পরিচিত হবার সুযোগ পান। যার ফলে শত্রুদের তাবৎ ষড়যন্ত্র সত্ত্বেও বিশ্বব্যাপী ইসলামের বিকাশ ব্যাপক বৃদ্ধি পেয়েছে। আসলে ইসলামের নীতিমালা এবং শিক্ষাগুলো জুলুম অত্যাচার নিপীড়নের বিরোধী হবার কারণে বিশ্বের বলদর্পী শক্তিগুলোর স্বার্থের পথে তা মারাত্মক অন্তরায়। যার ফলে আধিপত্যবাদী শক্তিগুলো ইসলামের প্রকৃত স্বরূপ এবং তার বিকাশের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করার জন্যে তাদের সর্বপ্রকার সামর্থ ও শক্তিকে কাজে লাগাচ্ছে। আমরা তাই এই আসরে ইসলামের প্রকৃত স্বরূপ ও বিভিন্ন দিক তুলে ধরার চেষ্টা করবো।

সূচনালগ্ন থেকেই ইসলাম শত্রুতার মুখে পড়েছিল। আজও সেই শত্রুতা অব্যাহত আছে। তবে বর্তমানে পশ্চিমা বলদর্পী শক্তিগুলো ইসলামের বিরুদ্ধে শত্রুতার নতুন কৌশল অবলম্বন করেছে। তারা এখন বিশ্বব্যাপী ইসলামভীতি ছড়ানোর চেষ্টা করছে। তারা ইসলামকে যুদ্ধ ও সহিংসতার ধর্ম এবং মানবাধিকার উপেক্ষাকারী বলে প্রচার করার চেষ্টা করছে। এসব করে তারা বিশ্ববাসীকে ইসলাম বিমুখ করে রাখতে চায়। তবে নামসর্বস্ব কিছু মুসলমানের কাজকর্ম পশ্চিমাদের ঐসব প্রচারণার অনুকূলে গেছে। যেমন- আল কায়েদা ও তালেবান। এই গোষ্ঠিগুলো সহিংসতাকামী,নির্দয় এবং সন্ত্রাসী কাজে লিপ্ত থেকেও নিজেদের মুসলমান বলে পরিচয় দেয়। এদিকে গণমাধ্যমগুলো তাদের ভয়াবহ কর্মকাণ্ডগুলোকে ফলাও করে প্রচার করছে,যেসব দেখলে যে কোনো মানুষই মুসলমানদের ব্যাপারে ঘৃণ্য ও অবজ্ঞাপূর্ণ মনোভাব পোষণ করবে। পশ্চিমাদের ব্যাপক অপপ্রচারণার ফলে যে-কোনো সাধারণ মানুষ বা অসচেতন মানুষ ঐসব সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডকে ভুল করে ইসলাম এবং মুসলমানদের কার্যক্রম বলে ভাবতে পারে।
তবে সুখকর ব্যাপারটি হলো,বিশ্বের প্রকৃত মুসলমানদের বিশাল অংশটি মুসলিম নামধারী ঐসব সন্ত্রাসী গোষ্ঠির কার্যক্রমে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন এবং ঐসব গোষ্ঠিকে বিচ্যুত বলে মত দিয়েছেন। পশ্চিমারা যেহেতু ইসলামের শক্তিশালী ও উন্নত সংস্কৃতিকে যুক্তি দিয়ে মোকাবেলা করতে সক্ষম নয় সেহেতু তারা ইসলামের অগ্রগতিতে শঙ্কিত হয়ে ইসলামের বিরুদ্ধে অপপ্রচারণার আশ্রয় নিয়েছে। বিশেষ করে যারা ইসলামের ব্যাপারে আগ্রহী তাদেরকে ফিরিয়ে রাখার স্বার্থে ইসলামকে সন্ত্রাসী বলে প্রচারণা চালাচ্ছে। সেজন্যে এখন সবার মনেই একটি প্রশ্ন দেখা দিয়েছে-ইসলাম কি আসলেই সন্ত্রাসী বা সহিংসতার ধর্ম?ধারাবাহিক এই আসরে আমরা এ প্রশ্নের জবাব দেওয়ার চেষ্টা করবো। সেইসাথে প্রেম ভালোবাসা স্নেহ ও কল্যাণ আর মানবতার মুক্তির ধর্ম ইসলামের বিশেষ কিছু দিক ও তাৎপর্য তুলে ধরার চেষ্টা করবো।

পবিত্র কোরআন নিয়ে সামান্য পড়ালেখা করলেই অসংখ্য উদাহরণ পাওয়া যাবে যা থেকে বোঝা যাবে ইসলাম একটি দয়া,অনুগ্রহ ও কল্যাণের ধর্ম।আল্লাহর অনুগ্রহের কথা,করুণার কথা দয়ার কথায় কোরআন পরিপূর্ণ। কোরআনের প্রতিটি সূরা শুরু করতে হয় এমনকি মুসলমানদের প্রতিটি কাজ শুরু করতে হয় বিসমিল্লাহ বলে। এর অর্থই হলো সেই আল্লাহর নামে শুরু করছি যিনি পরম করুণাময় এবং দয়াবান।কোরানের ১১৪ টি সূরার মধ্যে ১১৩ সূরা এই বিসমিল্লা বলে শুরু হয়েছে। কোরআনের অসংখ্য আয়াতে বলা হয়েছে আল্লাহ তাঁর বান্দাদের প্রতি অসম্ভব দয়ালু,তিনি ক্ষমাকারী এবং মেহেরবান ইত্যাদি। তো যেই ধর্মের মূল গ্রন্থটির সূচনা হয়েছে আল্লাহর দয়া আর রহমতের ঘোষণা দিয়ে সেই ধর্ম কি সহিংস হতে পারে?
কোরআনের আয়াতগুলোর প্রতি মনোযোগী হলে দেখা যাবে আল্লাহর অনুগ্রহ,করুণা এবং দয়ার্দ্রতার বিষয়টি চমৎকারভাবে ফুটে উঠেছে। সেখানে লক্ষ্য করা যাবে আল্লাহর এই দয়ার ব্যাপারটি কেবল যে ইসলাম ধর্মের অনুসারীদের জন্যে তা নয়, বরং সমগ্র মানব জাতির জন্যেই প্রযোজ্য। এ কারণে ইসলাম ধর্মও কেবল মুসলমানদেরই নয় বরং সমগ্র মানব জাতির ধর্ম।সূরায়ে জাসিয়ার চৌদ্দ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছেঃ "হে নবী! আপনি মুমিনদেরকে বলুন, তারা যেন তাদেরকে ক্ষমা করে,যারা কিয়ামত বা পুনরুত্থান দিবসের প্রতি বিশ্বাস রাখে না, যাতে তিনি কোন সম্প্রদায়কে তাদের কৃতকর্মের প্রতিফল দেন ।"আল্লাহ রাব্বুল আলামিন এই আয়াতে মুসলমানদের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছেন তারা যেন অমুসলমানদের ব্যাপারে সহানুভূতিশীল হয় এবং তাদের মন্দ দিকগুলোকে না দেখার ভান করে বা উপেক্ষা করে যায়। তো এরকম একটি ধর্মকে কী করে সহিংস বলা যায়!

আসলে আল্লাহর রহমত বা দয়ার ভাণ্ডার অফুরন্ত,অসীম। কিন্তু কিছু কিছু লোক বিচ্যুতির পথে পা বাড়িয়ে নিজেদের মনুষ্যত্বকে ধ্বংস করে ফেলে আল্লাহর রহমতের ব্যাপার হতাশ কিংবা বঞ্চিত হয়ে পড়েছে। তাদেরকে সঠিক পথ দেখানোর জন্যেই আল্লাহ নবী রাসূলদের পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। এরকমই একজন নবী হলেন ইব্রাহিম (আ)।তিনি লুতের কওমকে আসন্ন বিপদ থেকে মুক্তি দেওয়ার জন্যে ব্যাপক চেষ্টা চালান। আল্লাহর কাছে তাদের জন্যে ক্ষমা প্রার্থনা করেন। সাধারণত নবীরা আল্লাহর পক্ষ থেকে মানব জাতিকে সুসংবাদ এবং সতর্কতা প্রদানকারী হিসেবেই আবির্ভূত হন। ঐ সতর্কতাও আল্লাহর পক্ষ থেকে দয়া ও অনুগ্রহ,যাতে তারা বিচ্যুতি থেকে সঠিক পথে ফিরে আসেন এবং সৌভাগ্যের প্রশস্ত পথে অগ্রসর হয়। এই সতর্কতাও অনুগ্রহ। সেজন্যেই রাসূলের পরিচয় সম্পর্কে কোরআনে বলা হয়েছেঃ ‘আমি আপনাকে বিশ্ববাসীর জন্যে রহমত স্বরূপই প্রেরণ করেছি।' সেজন্যেই আমরা লক্ষ্য করবো মূর্তিপূজকরা পর্যন্ত যখন নবীজীকে বিশ্রি ভাষায় গালিগালাজ করতো তখনো তিনি ধৈর্যের সাথে বরণ করতেন কখনোই তাদেরকে পাল্টা গালি দেন নি,তাদেরকে অভিশাপ দেন নি। কোরআনে তাই বলা হয়েছে ‘নিশ্চয়ই আপনি সবোর্ত্তম চরিত্রের অধিকারী।

সূরা আল-ইমরানের একশ' উনষাট নম্বর আয়াতে রাসূলের এই কোমল ও সহৃদয় হবার প্রতি ইঙ্গিত করে বলা হয়েছেঃ ‘আল্লাহর রহমতেই আপনি তাদের জন্য কোমল হৃদয় হয়েছেন পক্ষান্তরে আপনি যদি রাগ ও কঠিন হৃদয় হতেন তাহলে তারা আপনার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতো।'এটা ছিল সত্যিকারের এক অলৌকিক ব্যাপার। কেননা নবীজীর আবির্ভাবের আগে আরবের লোকেরা যেখানে খুনখারাবি ছাড়া কিছুই বুঝতো না, সেখানে নবীজীর আগমনের পর তাঁর এই ধৈর্যশীলতা ও কোমল হৃদয়ের আকর্ষণে মানুষ তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হয়, ঝুকেঁ পড়ে। এ জন্যে অতি দ্রুত তিনি একটি শক্তিশালী উম্মাত গঠন করতে সক্ষম হন। অসম্ভব ভালোবাসা আর পারস্পরিক আন্তরিকতাপূর্ণ এই উম্মাত গঠনের পেছনে সহিংসতা কিংবা শক্তির বিন্দুমাত্র প্রয়োগ ছিল না। সেই ভালোবাসা আর আন্তরিক একতাপূর্ণ ধর্ম ইসলামকে কি সহিংসতার ধর্ম বলা যায়?
দ্বিতীয় পর্ব
কোরআনের শিক্ষাগুলোর দিকে একটু দৃষ্টি দিলে দেখা যাবে মানুষের মাঝে ভ্রাতৃত্ব এবং শান্তি প্রতিষ্ঠাই ইসলামের লক্ষ্য। পবিত্র কোরআনের সূরা বাকারার দুই শ' আট নম্বর আয়াতে বলা হয়েছেঃ হে ঈমানদারগণ! তোমরা পরিপূর্ণভাবে শান্তি ও ভ্রাতৃত্বের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাও এবং শয়তানের পদাংক অনুসরণ করো না। নিশ্চিয়ই সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু। আল্লাহর আমাদের এই আয়াতের তাৎপর্য উপলব্ধি করার যোগ্যতা দিন।
যেই আয়াতটি আমরা উল্লেখ করেছি তাতে ‘ফিস সিল্‌মি' শব্দটি এসেছে। সাল্ম্ এবং সালামের আভিধানিক অর্থ হলো শান্তি,সমঝোতা ও স্বস্তি। কোরআনের আয়াত থেকে আমরা জানতে পারছি মানব সমাজে দৃঢ় সমঝোতা এবং স্বস্তি নিশ্চিত হতে পারে বা বাস্তবায়িত হতে পারে কেবল আল্লাহর প্রতি ইমান আনার মধ্য দিয়ে। অন্যভাবে বলা যেতে পারে বিশ্বব্যাপী মানুষের মাঝে ভৌগোলিক, আঞ্চলিক, বর্ণ, গোত্র এবং ভাষাগত দিক থেকে হাজারো পার্থক্য বা ব্যবধান থাকা সত্ত্বেও তাদের মাঝে সামাজিক সংযোগের বৃত্তটি রচিত হতে পারে কেবল এই আল্লাহর প্রতি ইমানের ভিত্তিতে।
এই আয়াতটির আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে কোরআনে মাজিদের বক্তব্য অনুযায়ী যারা এই শান্তি ও সমঝোতার পথ পরিহার করে যুদ্ধ ও সংঘাতের পথ বেছে নিয়ে আগুণের লেলিহান শিখা জ্বালিয়ে দেয়, তারা শয়তানের অনুসারী। তার মানে হলো সমঝোতা ও শান্তি হচ্ছে দয়াময় আল্লাহর কাজ আর সমাজে যুদ্ধ ও সংঘাতের আগুন জ্বালিয়ে দেওয়া বর্বর শয়তানের কাজ। সমঝোতা ও শান্তি সম্পর্কে কোরআনের আরেকটি আয়াতেও ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে। আল্লাহ বলেছেন যদি শত্রুরা ন্যায়সঙ্গত সমঝোতা বা সন্ধি করতে চায় তাহলে তা গ্রহণ করো। তবে অন্যায়, অসত্যের কাছে মাথানত করে কিংবা সত্যকে বিসর্জন দিয়ে সমঝোতা করা যাবে না। ঔদাসীন্য, ভয় ও আপোসের মানসিকতা নিয়ে সমঝোতা করা হলে ইসলাম তা সমর্থন করে না। পবিত্র কোরআনে এ ধরনের সমঝোতাকে তিরস্কার করা হয়েছে। সেইসাথে হুঁশিয়ার করে দেওয়া হয়েছে যে, শত্রুদের সাথে সমঝোতা হতে হবে মুমিনদের সম্মান ও মর্যাদা রক্ষার স্বার্থে।
ইমাম আলী (আ)মালেক আশতারকে মিশরের গভর্নর করে পাঠানোর পর এক চিঠিতে লিখেছেনঃ ‘শত্রুরা যদি তোমাকে সমঝোতা বা সন্ধির দিকে আহ্বান জানায় এবং তাতে যদি আল্লাহর সন্তুষ্টি থাকে তাহলে তা প্রত্যাখ্যান করো না। কেননা সন্ধি হচ্ছে,তোমার সেনাদের প্রশান্তির কারণ এবং তোমার নিজের জন্যেও ঝামেলামুক্তির কারণ, অপরদিকে তোমার শাসিত অঞ্চলের নিরাপত্তাও তার মধ্যে নিহিত। তবে সমঝোতার পর শত্রুদের ব্যাপারে খুব সতর্ক থাকবে। কারণ, হতে পারে শত্রুরা ঘনিষ্ট হয়ে বা তোমার কাছে ভিড়ে তোমাকে কিংকর্তব্যবিমূঢ় করে বা বোকা বানিয়ে হঠাৎ আক্রমণ করে বসতে পারে।' ইমাম আলী (আ) এর দৃষ্টিতে ইসলাম হচ্ছে ঔদার্য ও মহানুভবতার সমষ্টি।আর আল্লাহ এই দ্বীনকে ইসলামে দীক্ষিতদের জন্যে সুস্থতা ও সংহতির আধার হিসেবে দিয়েছেন।

কোরআনে উল্লেখিত একটি বিষয় হলো ‘বন্ধুত্ব ও হৃদ্যতা'। আল্লাহর বৈশিষ্ট্য হিসেবে এগুলোর কথা উল্লেখ করা হয়েছে। আল্লাহর এই মহান মর্যাদা সম্পর্কে পবিত্র কোরআনের সূরা রোমের একুশ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছেঃ ‘আর এক নিদর্শন এই যে, তিনি তোমাদের জন্যে তোমাদের মধ্য থেকে তোমাদের সংগিনীদের সৃষ্টি করেছেন,যাতে তোমরা তাদের কাছে শান্তিতে থাক এবং তিনি তোমাদের মধ্যে পারস্পরিক সম্প্রীতি ও দয়া সৃষ্টি করেছেন। নিশ্চয় এতে চিন্তাশীল লোকদের জন্যে নিদর্শনাবলী রয়েছে।'এইসব বর্ণনা থেকে একটি প্রশ্ন নিশ্চয়ই চিন্তাশীলদের মাথায় আসবে তা হলোঃ যেই ধর্ম বা আদর্শ নিজেকে দয়া এবং প্রেমের ধর্ম বলে পরিচয় দেয় এবং তার অনুসারীদের মাঝে সেই প্রেম ও দয়ার বীজ রোপন করে, সেই ধর্ম বা সেই আদর্শ কি সহিংস হতে পারে?
বলছিলাম যে আল্লাহ হচ্ছেন রহমত ও দয়ার আধার। পবিত্র কোরআনে তাঁর গুণ ও মর্যাদার কথা খুবই সুন্দরভাবে বর্ণিত হয়েছে। এদিক থেকে ইসলামের ভিত্তিটাই হলো রহমত ও দয়ার মূলে। এই দয়া এতো বেশি এবং এতো বিস্তৃত যে যুদ্ধ কিংবা সংঘর্ষের সময়ও এই দয়াশীলতার বিষয়টি লক্ষ্য করা যায়। ইসলামের নবী (সা)মুশরিকদের সাথে মুখোমুখি হবার সময় তাদেরকে ইসলামের দাওয়াত দিতেন কিংবা তিনি চাইতেন তারা যেন মুসলমানদের ওপর আগ্রাসন বন্ধের ব্যাপারে চুক্তিবদ্ধ হয়। এ সম্পর্কে নবীজী বলেছেন,তাদেরকে প্রথমে ইমানের দাওয়াত না দিয়ে তাদের সাথে যুদ্ধে জড়াবে না। তারা যদি তা গ্রহণ না করে তবু তোমরা যুদ্ধ করো না যতোক্ষণ পর্যন্ত না তারা নিজেরাই যুদ্ধ শুরু না করে।

মুশরিকদের সাথে যুদ্ধ শুরু হয়ে যাবার পরও শত্রুদের সাথে,শত্রু পক্ষীয় বন্দীদের সাথে,আহতদের সাথে এবং বেসামরিক লোকজনের সাথে যেন মানবীয় নীতি নৈতিকতাগুলো মেনে চলা হয় সেজন্যে নবীজী তাঁর অনুসারীদের লক্ষ্য করে আদেশ দিতেন। ইসলামের বিভিন্ন বর্ণনায় যুদ্ধে কী ধরনের শিষ্টাচার এবং নীতি নৈতিকতা মেনে চলা উচিত সে সম্পর্কে চমৎকার কিছু দিক উল্লেখ করা হয়েছে। ইমাম সাদেক (আ) বলেনঃ ‘রাসূলে আকরাম (সা) যখন মুসলমান সেনাদেরকে যুদ্ধের ময়দানে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিতেন,তাদেরকে ডেকে পাঠাতেন এবং তাদেরকে স্পষ্টভাবে বলতেন,যুদ্ধের ময়দানের দিকে অগ্রসর হও তবে কামনা বাসনা চরিতার্থ করার লক্ষ্যে নয় বরং আল্লাহকে স্মরণ করতে করতে এবং তাঁরি সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে ইসলামের নীতিমালা অনুযায়ী আমল করতে করতে আল্লাহর রাস্তায় পা বাড়াও।'যুদ্ধের ময়দানের আদব বা শিষ্টাচার বলতে নবীজী যেটা বুঝিয়েছেন তাহলো:যুদ্ধের ময়দানে কখনোই শিষ্টাচার লঙ্ঘন করা যাবে না,প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করা যাবে না। খেয়ানতের পথে পা মাড়ানো যাবে না,বিশেষ করে গনিমতের মালামাল বণ্টনের ব্যাপারে কোনোরকম খেয়ানত করা যাবে না।

কোরআনে বলা হয়েছে,যখন গনিমতের মালামাল হাতে আসে তখন নেতৃত্ব আর হুকুমাতের ব্যাপারে দেওয়া প্রতিশ্রুতির কথা মনে থাকে না। তবে যা কিছু যোদ্ধাদের সাথে সম্পর্কিত সেগুলো তাদের মাঝে বণ্টন করে ফেলা ভালো যাতে নিজেদের প্রকৃত সত্যের কাছাকাছি পৌঁছা যায় এবং গনিমতে কোনোরকম খেয়ানত করা না হয়। না কেবল যুদ্ধের গনিমতের ব্যাপারেই নয় বরং যুদ্ধের সকল দিক নিয়েও যেন কোনোরকম খেয়ানত করা না হয়। নবীজী তাঁর বক্তব্যের ধারাবাহিকতায় আরো বলেনঃ অলা তুমাসসিলু। শত্রুদেরকে পরাস্ত করার পর তাদের নিষ্প্রাণ দেহগুলোর ওপর আক্রমণ করো না এবং লাশকে টুকরো টুকরো করো না।‘অলা তাগদিরু'ষড়যন্ত্রকারী,প্রতারক কিংবা চুক্তিভঙ্গকারী হয়ো না।' আরো বলেছেন ‘অক্ষম, দুর্বল কিংবা যুদ্ধে যাদের কোনোরকম হাত নেই তাদের ওপর হামলা করো না। অক্ষম বৃদ্ধ, শিশু এবং নারীদের হত্যা করো না।' এমনকি তিনি বলেছেন একান্ত নিরুপায় না হলে ‘বৃক্ষ পর্যন্ত কাটবে না।'শত্রু পক্ষের বন্দীরা মুসলমানদের হাতে নিরাপদ। সে যদি ইসলাম গ্রহণ করে তাহলে তো মুসলমানদের কাতারবন্দী হবে,আর যদি ইসলাম গ্রহণের ব্যাপারে অস্বীকৃতি জানায় কিংবা চিন্তা ভাবনা করার সুযোগ চায় তাহলে নিরাপত্তার সাথে তাকে তার স্বদেশে ফেরার ব্যবস্থা করতে হবে, তাকে কোনোরকম বিরক্ত করার অধিকার কারো নেই।' এই ইসলাম কি কখনো সহিংস হতে পারে?
তৃতীয় পর্ব
ইসলামের অনুগ্রহ কেবল সকল মানবজাতির জন্যেই নয় বরং অন্যান্য সৃষ্টি এবং প্রাণীকূলের ক্ষেত্রেও সমানভাবে প্রযোজ্য। সেজন্যে প্রাণীকূলের অধিকার সম্পর্কেও বহু বর্ণনা রয়েছে। সে সম্পর্কে খানিকটা ইঙ্গিত দেওয়ার চেষ্টা করবো আজকের আসরে।
গত আসরে আমরা রণাঙ্গনে ইসলামী শিষ্টাচার সম্পর্কে বলেছিলাম যে প্রকৃতি জগতের ক্ষতি করা এমনকি গাছগাছালি তথা উদ্ভিদরাজিও ধ্বংস করা যাবে না। রাসূলে খোদা (দ.)পোষা প্রাণীর অধিকার সম্পর্কে বলেছেনঃ কোনো পোষা প্রাণীর মালিক যখন বাসায় ফেরে,তখন তার উচিত প্রথমেই প্রাণীটির পানাহারের ব্যবস্থা করে তার ক্ষুধা মেটানো, তারপর নিজের খাবারের চিন্তা করা। সফরকালে পথিমধ্যে পানির সন্ধান পাওয়া গেলে পোষা প্রাণীদেরকে পানি খাওয়াতে হবে,তারপর প্রয়োজন হলে নিজের তৃষ্ণা মেটাতে হবে। প্রাণীটিকে যদি আরো দ্রুততার সাথে চালাতে হয় তাহলে তার মাথায় কিংবা মুখে চাবুক মারা যাবে না কেননা পশুরাও আল্লাহর জিকির-তাসবিহতে মশগুল থাকে। পশুর পিঠে তার সাধ্যের চেয়ে বেশি বোঝা চাপানো যাবে না। আজকের পৃথিবীতে প্রাণীদের ব্যাপারে এইসব শিষ্টাচার খুব কমই মেনে চলা হয়। অথচ মানবতার ধর্ম ইসলাম তার অনুসারীদেরকে এইসব সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিষয়ও মেনে চলার আহ্বান জানায়।
আমরা নামায পড়ার সময় কিংবা রোযা পালনের সময় বিপদাপদ মুক্তির লক্ষ্যে আল্লাহর দরবারে দু'হাত তুলে মুনাজাত করি। মুনাজাতে আমরা যেসব দোয়া করি তার কিছু অংশ লক্ষ্যণীয়ঃ "হে খোদা! সকল কবরবাসীর ওপর আনন্দ ও খুশি নাযিল করো!অভাবগ্রস্তদের সকল অভাব অভিযোগ দূর করে দাও!বিশ্বের সকল ক্ষুধার্তের ক্ষুধা তৃষ্ণা তুমি মিটিয়ে দাও!হে খোদা!সকল ঋণগ্রস্তকে ঋণমুক্ত করে দাও!শোকার্ত,বেদনার্তদের সকল কাজের জটিল গ্রন্থি তুমি খুলে দাও! হে আল্লাহ!স্বদেশ থেকে যারা দূরে রয়েছে তাদেরকে তুমি সুস্থতার সাথে নিজের দেশে ফেরার ব্যবস্থা করে দাও!হে খোদা!বন্দীরা যেখানেই থাকুক না কেন তাদের মুক্তি পাবার ব্যবস্থা করে দাও!হে আল্লাহ!সকল রোগগ্রস্তকে তুমি আরোগ্য লাভের ব্যবস্থা করে দাও!"

আচ্ছা! এই দোয়াগুলো কি ইসলামের মানবতা ও দয়াশীলতার নমুনা নয়!এইসব দোয়ায় কেবল মুসলমানরাই নয় বরং পৃথিবীর সকল মানুষই অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। মানব প্রেমের এই অপূর্ব নিদর্শন দেখে কে মুগ্ধ না হয়ে পারে!
নবীজীর আহলে বাইতের ইমামগণের জীবনীর মধ্যেও এই দয়াশীলতার নিদর্শন পাওয়া যাবে। ইমাম আলী (আ)র মাথায় বিষাক্ত তরবারির আঘাত হেনে তাকেঁ শহিদ করেছিল ইবনে মুলজাম মুরাদি। সেই মুরাদির সাথে সদয় আচরণ করার নিদর্শন স্থাপন করে গেছেন ইমাম আলি। ইবনে মুলজামকে ধরার পর থেকে মৃত্যু পর্যন্ত তার প্রতি সদয় আচরণ করা হয়েছে। তিনি বলেছেনঃ "হে আমার সন্তানেরা!আমার হত্যাকারী শুধুমাত্র ইবনে মুলজাম। আমার পরে সুবিধাবাদী একটা দল তাদের তলোয়ার কোষমুক্ত করতে চাইবে,আমার হত্যাকারীর সাথে হাত থাকার অজুহাত দেখিয়ে কিংবা নিজেদের ব্যক্তিগত রেষারেষির ঝাল মেটাতে খুনাখুনি করতে পারে...এরকম যেন না হয়, সাবধান থেকো! আমার প্রিয় সন্তানেরা!আমার জন্যে যে খাবার তৈরি হবে,একই খাবার আমার হত্যাকারীকেও দেবে। আমি যদি বেঁচে থাকি,তাহলে কাতেলের সাথে যা করার আমিই করবো,আর যদি আল্লাহর সান্নিধ্যে চলে যাই তাহলে কেসাসের অধিকার তোমাদের রয়েছে। তবে যেভাবে সে আমার ওপর তরবারির একটিমাত্র আঘাত হেনেছে, তেমনি একটিমাত্র আঘাত হানবে তার ওপর, বেশি নয়।"

ইসলামের এরকম উদারতা আর দয়ার উদাহরণ সমগ্র পৃথিবীতে আর মিলবে!
অনেকে না জেনে ইসলামকে সহিংসতার ধর্ম বলে প্রমাণ করার জন্যে কেসাসের বিষয়টি উল্লেখ করে থাকে। পবিত্র কোরআনে কেসাস শব্দটি মাত্র চারবার এসেছে। কিন্তু রহমত শব্দটি এসেছে উনআশি বার,রাহমান শব্দটি এসেছে একশ' ষাট বার,রাহিম শব্দটি এসেছে একশ'আটানব্বুই বার। এতেই প্রমাণিত হয় যে ইসলামে রহমত এবং দয়ার পাল্লা অন্য সবকিছুর চেয়ে ভারি। সূরা বাকারার একশ'আটাত্তর নম্বর আয়াতে কেসাসের বিধান দেওয়ার পরপরই বলা হয়েছেঃ "অতঃপর তার দ্বীনী ভাইয়ের পক্ষ থেকে যদি মাফ করে দেয়া হয় অর্থাৎ কেসাসকে যদি রক্তমূল্যে রূপান্তরিত করা হয়,তবে গ্রহণযোগ্য নিয়মের অনুসরণ করবে এবং হত্যাকারীও রক্তমূল্যের অনুগ্রহকে মৃত ব্যক্তির অভিভাবককে প্রদান করবে। এটা তোমাদের পালনকর্তার পক্ষ থেকে বিশেষ ছাড় এবং দয়া......।"

এই আয়াত অনুযায়ী কেসাস কিন্তু ফরজ নয় এমনকি মুস্তাহাবও নয়। তবে অপরাধ বিস্তার রোধকল্পে কিংবা একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঠেকাতে মৃত ব্যক্তির অভিভাবককে কেসাসের অধিকার যেমন দেওয়া হয়েছে তেমনি রক্তমূল্যের বিনিময়ে হত্যাকারীকে ক্ষমা করে দেওয়ারও অধিকার দেওয়া হয়েছে।
পৃথিবীর সকল দেশেই অপরাধের শাস্তির ব্যবস্থা রয়েছে। ইসলামেরও নীতি আদর্শের প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে অপরাধ দমনের কর্মসূচি গৃহীত হয়েছে। ইসলামসহ প্রত্যেক ধর্মই চায় মানুষ যাতে পাপের পথে পা না বাড়ায়। ইরানের বিশিষ্ট আলেম আয়াতুল্লাহিল উজমা মাকারেম শিরাযি কেসাসের বিধান সম্পর্কে বলেছেনঃ সমাজে ফেৎনা ফাসাদ বন্ধ করার জন্যে এবং অন্যদের নিরাপত্তা বিধানের জন্যে এটা এক ধরনের চিকিৎসা। সমাজের সামগ্রিক কল্যাণের স্বার্থে কেসাসের ব্যবস্থাটা আল্লাহর পক্ষ থেকে এক ধরনের রহমত। কেসাসের দর্শনকে কোরআনে জীবন বলে উল্লেখ করা হয়েছে। বলা হয়েছেঃ "হে বুদ্ধিমানগণ! কেসাসের মধ্যে তোমাদের জন্যে রয়েছে জীবন,যাতে তোমরা তাকওয়াবান হতে পার।"

এ আয়াত থেকে পরিস্কার বোঝা যাচ্ছে যে,কেসাসের বিধানের মধ্যে প্রতিহিংসার লেশমাত্র নেই বরং এতে রয়েছে আল্লাহর রহমত,যাতে অন্যরা প্রশান্তিতে নিজেদের জীবন অতিবাহিত করতে পারে। এদিক থেকে কেসাসের মধ্যে ঠিকই জীবন রয়েছে,একইভাবে মানুষ হত্যার মতো অপরাধ থেকে ফিরিয়ে রাখার উপাদানও রয়েছে।
কোনো রোগীর আঙুলে যদি এমন কোনো রোগ হয় যা ঔষধ দিয়ে কোনোভাবেই সারিয়ে তোলা যায় না,একজন চিকিৎসক যখন নিরুপায় হয়ে ঐ আঙুলটি কেটে ফেলেন,তাকে কি তখন সহিংসতা বলা যায়,কিংবা ডাক্তারকে কি সহিংসতাকামী বলা যায়?একটি আঙুল কেটে ফেলার ফলে পুরো শরীরটা মুক্তি পায় অর্থাৎ জীবন পায়। বৃক্ষের যে শাখাটি নষ্ট হয়ে যায় ঐ শাখাটিকে কেটে ফেলে দিলে বৃক্ষ জীবন ফিরে পায়। সমাজের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। কেননা সমাজটাও একটা দেহের মতো। সমাজদেহের কোনো অঙ্গে যদি প্রতিকার অযোগ্যরকমভাবে নষ্ট হয়ে যায় তাহলে সে অঙ্গ কেটে ফেলা হলে পুরো সমাজদেহ আক্রান্ত হওয়া থেকে বেঁচে যায়। সেজন্যেই আল্লাহ কেসাসের মধ্যে ‘জীবন' রয়েছে বলে উল্লেখ করেছেন। মজার ব্যাপার হচ্ছে, মানবাধিকারের বুলি আওড়িয়ে যারা কেসাসের ব্যাপারে উদ্দেশ্যমূলকভাবে নেতিবাচক কথা বলে, তারাই ফিলিস্তিন, আফগানিস্তান, লেবানন, ইরাকসহ পৃথিবীর আরো বহু দেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ব্যাপারে টু-শব্দটিও করছে না। আল্লাহ কেসাসের বিধানটি দিয়েছেন বুদ্ধিমানদের সম্বোধন করে। তার মানে এর মধ্যে যে সামাজিক প্রাণ নিহিত রয়েছে তা বুদ্ধিমানরাই উপলব্ধি করতে পারে। আল্লাহ সবাইকে বুদ্ধি ও বিচক্ষণতা দান করুন, তাকওয়াবান হবার সুযোগ দিন। #

কোন মন্তব্য নেই: