সোমবার, ২০ ডিসেম্বর, ২০১০

শাহাদাত মুমিন জীবনের কাম্য

মুমিনের নিকট ঈমানের অপরিহার্য দাবী শাহাদাত। সৃষ্টির আদি হতে এ যাবৎ কাল পর্যন- নিয়ন্ত্রণহীন ধারাবাহিকতা, সত্য ও মিথ্যার চিরন-ন সংঘাত, কল্যাণ ও অকল্যাণের রশি টানাটানি, আলো ও আঁধারের বৈপরীত্য সুন্দরের আরোহী কাঠিন্যতার প্রাচীর মাড়িয়ে ফুলের উৎসব অসুন্দরের আস্ফালন ও হীনতার অতল গহ্বরে পতন ঠেকাতে একজন মুমিনের সমগ্র জীবনের প্রকাশ জীবনাচার হবে শাহাদাতের তামান্নায় উজ্জীবিত। তার জীবনের একান- ব্যক্তিগত ও গোপনীয় বিষয়; হৃদয়ের আবেগ অনুভূতির প্রকাশ, সামাজিক তৎপরতায় অংশগ্রহণ, অর্থনৈতিক লেনদেন, রাজনৈতিক প্রতিপত্তি, সাংস্কৃতিক রুচিবোধ ও মননশীলতা, অবসর ও বিনোদন, শয়ন ও জাগরণ সব কিছুই বিল্পবী ঘোষণা দেবে শাহাদাতের চূড়ান্ত- প্রত্যাশা, মুমিনের জীবন চলার প্রতিটি কদম, তাদের প্রতিটি স্পর্শ, চাহনীর প্রতিটি পলক, জিহ্বার প্রতিটি বুলি, লেখনীর প্রতিটি আঁচড়, ব্যয়ের প্রতিটি কপর্দক, সময়ের প্রতিটি মুহূর্ত, রক্তের প্রতিটি ফোঁটা এবং হৃদয়ের সবগুলো অনুভূতি শাহাদাতের অমিয় সুধা পান করার জন্য থাকে সতত নিবেদিত।

শাহাদাত বা শাহাদাহ শব্দটি অতি ব্যাপক ও তাৎপর্যপূর্ণ একটি আরবী শব্দ, ??? মূল শব্দ থেকে এর উৎপত্তি। আর এ শব্দ থেকেই নির্গত হয়েছে শহীদ (????) শাহিদ (????) শুহূদ (????) মাশহূদ (?????) মুশাহাদাহ (??????) তাশাহহুদ (????) প্রভৃতি শব্দ।
এগুলো খুবই প্রচলিত শব্দ। শাহাদাত শব্দের অর্থ হলো সাক্ষ্য। এ থেকে শহীদ
ও শাহেদ শব্দ এসেছে। শাহেদ মানে যে দেখেছে বা সাক্ষ্য দিয়েছে। সাক্ষী সেই দেয় যে নিজে স্বচক্ষে দেখেছে। আশ-শাহিদ মানে আমি দেখার জন্য ঐ স'ানে উপসি'ত ছিলাম, আমি নিজে দেখেছি, এভাবেই দেখা, সাক্ষ্য দেয়া অর্থে শাহাদাত শব্দ ব্যবহার করা হয়।
ইমাম রাগিব ইসপাহানী এবং অন্যান্য আরবী ভাষাতত্ত্ববিদ (????) শব্দটির অর্থ মোটামুটি একইরূপ লিখেছেন।
কেউ লিখেছেন শহদ মানে উপসি'ত হয়ে স্বচক্ষে দেখে কিংবা অন-র দৃষ্টি দিয়ে উপলব্ধি করে সাক্ষ্য দেয়া। আবার কেউ বলেছেন- শাহাদাত হচ্ছে এমন জ্ঞান বা জ্ঞানের বিবরণ যা চোখে দেখে বা অন-র দৃষ্টির মাধ্যমে অর্জিত হয়। সুতরাং আমরা দেখতে পাচ্ছি শাহাদাত শব্দের অর্থের সাথে জড়িত রয়েছে নিুাকে্ত শব্দগুলোঃ উপস্থিতি, জানা, দেখা, দর্শন, অন-র্দৃষ্টি, জ্ঞান কিংবা (স্বচক্ষে অথবা জ্ঞান চক্ষু দ্বারা অর্জিত) জ্ঞানের বিবরণ বা সাক্ষ্য প্রদান, মন মগজ ও বিবেক বুদ্ধি দ্বারা উপলব্ধি করা প্রভৃতি।
কুরআনে শাহাদাত শব্দের অর্থ/ব্যবহার: আল্লাহর রাহে জীবন উৎসর্গ করার ক্ষেত্রে প্রেরণাদাত্রী মহাগ্রন' আল কুরআনের ভূমিকা অপরিসীম। শাহাদাত শব্দটি তাই ব্যবহৃত হয়েছে বিভিন্নভাবে। আমরা এখানে বিভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত কয়েকটি আয়াত নিুে উপস্থাপন করছিঃ
ক) আদর্শের সাক্ষ্য (নমূনা গড়ফবষ ) অর্থে
“হে নবী। আমরা তোমাকে প্রেরণ করেছি সাক্ষী, সুসংবাদদাতা এবং ভয় প্রদর্শনকারী হিসেবে।” (আল-আহযাবঃ ৪৫)
“আর এভাবেই আমরা তোমাদেরকে একটি মধ্যপন'ী উম্মাহ করেছি, যাতে করে তোমরা মানব জাতির উপর সাক্ষী হতে পারো।” (বাকারা ১৪৩)
“যেন রাসূল তোমাদের উপর সাক্ষী হতে পারেন, এবং তোমরা গোটা মানব জাতির উপর সাক্ষী হতে পারো।” (আল-হাজ্জ ৭৮)
খ) আল্লাহর পথে নিহত হবার অর্থেঃ
“তোমাদের উপর এ দুরবস'া এ জন্য চাপানো হয়েছে যে, আল্লাহ তায়ালা এভাবে জেনে নিতে চান তোমাদের মধ্যে কারা সাচ্চা ঈমানদার এবং এইজন্যে যে তিনি তোমাদের কিছু লোককে শহীদ হিসেবে গ্রহণ করতে চান।” (আলে-ইমরানঃ ১৪০)
“যে ব্যক্তি আল্লাহ এবং তাঁর রাসুলের আনুগত্য করবে সে ঐসব লোকদের সংগী হবে যাদের নিয়ামত দান করা হয়েছে, তারা হলো-নবী, সিদ্দীক, শহীদ এবং সালেহ, আর তাদের সান্নিধ্যই হলো উত্তম।” (আন-নিসাঃ ৬৯)
গ) উপসি'ত থেকে স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করা অর্থেঃ
“আর তাদেরকে শাসি- দেয়ার সময় একদল ঈমানদার লোক যেন উপসি'ত থেকে প্রত্যক্ষ করে।” (আল-নূরঃ ২)
ঘ) জ্ঞান, অবগতি ও জানা অর্থেঃ
“আল্লাহ প্রতিটি জিনিসের উপর সাক্ষ্য অর্থাৎ প্রতিটি বিষয়ে তিনি অবগত, তার জ্ঞানের বাইরে কোনো কিছু নেই।” (আহযাবঃ ৫৫)
ঙ) আদালতের সাক্ষ্য অর্থেঃ
“আর যারা পবিত্র চরিত্রের নারীদের সম্পর্কে মিথ্যা দোষারোপ করবে অতপর (দাবীর সপক্ষে) চারজন সাক্ষী উপসি'ত করতে পারবে না তাদের আশিটি কড়া মারো এবং এ ধরণের লোকদের সাক্ষ্য আর কখনো গ্রহণ করোনা।” (আন-নূরঃ ৪)
“হে ঈমানদারগণ, তোমরা ন্যায় বিচারের ধারক হও এবং আল্লাহর জন্যে সাক্ষী হও, তোমাদের এই সুবিচার ও সাক্ষ্য যদি তোমাদের নিজেদের, তোমাদের পিতামাতার এবং তোমাদের আত্মীয় স্বজনদের বিপক্ষেও যায়।” (আন-নিসাঃ ১৩৫)
এমনি করে বহু জায়গায় আল-কুরআনে শাহাদাত শব্দের প্রয়োগ হয়েছে।
শাহাদাত ঈমানের অপরিহার্য দাবী: মুমিনের নিকট “শাহাদাত” ঈমানের অপরিহার্য দাবী। শাহাদাতের কামনা যদি কোন মুমিন জীবনে থাকে তাহলে সে আল্লাাহর পথে লড়াইয়ে কোন সময় গাফেল হতে পারে না। কারণ জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ ছাড়া শাহাদাতের দ্বিতীয় কোন পথ নেই। একজন ভাল ছাত্র যেমন ভাবে ফলাফলের প্রমাণ দেবার জন্য পরীক্ষা কামনা করে তেমনি একজন মুমিন শাহাদাতের মাধ্যমে বিজয়ী হবার জন্য বাতিলের বিরুদ্ধে হকের সংগ্রামে আপোষহীনভাবে লড়াই করে যাবে। আন্দোলনের কর্মকাণ্ডে বাতিলের বিরুদ্ধে সংগ্রামে যদি সে উৎসাহ পায় মৃত্যু অথবা অন্যান্য প্রতিকূলতা তাকে গাফেল করে না রাখে তাহলে বুঝতে হবে শাহাদাতের কামনা তার মধ্যে উপসি'ত রয়েছে। পবিত্র কুরআনে আল্লাহর পথে লড়াই প্রসঙ্গে বলা হয়েছে,
“আল্লাহর পথে লড়াই করা কর্তব্য সেই সব লোকেরই যারা পরকালের বিনিময়ে দুনিয়ার জীবন বিক্রয় করে দেয়, আল্লাহর পথে যে লড়াই করে ও নিহত হয়, কিংবা বিজয়ী হয়, তাকে আমরা অবশ্যই বিরাট ফল দান করব।” (আন-নিসাঃ ৭৪)
শাহাদাতের মর্যাদা: একজন মু’মিনের শাহাদাতের তামান্নায় সততঃ উজ্জীবিত, শাহাদাতের এই অমিয় সূধা পান করতে কেন এই তীব্র আকাঙক্ষা? কেন জীবনের শেষ রক্ত বিন্দু দিয়ে হলেও তার এই পরম চাওয়া-পাওয়ার শাহাদাত চাই-ই? সব রকম নেকীর উপর আরেকটা নেকী থাকে। সকল কুরবাণীর উপরই কুরবাণী আছে। সকল ত্যাগের উপরই ত্যাগ আছে। কিন' আল্লাহর পথে শহীদ হবার চেয়ে বড় কোন নেকী, এর চেয়ে বড় কোন ত্যাগ ও কুরবাণী হতে পারে না, এটাই মানব জীবনের সকল নেকী ও পুণ্যের চূড়ান- শিখর। আর এ কারণেই আল্লাহ তায়ালা শহীদকে অকল্পনীয় উচ্চ মর্যাদা ও সম্মান দান করেন, শাহাদাতের এই দরজা নবুয়্যতের দরজার চেয়ে বড় না হলেও শহীদ হবার জন্য স্বয়ং নবীও তীব্র আকাঙক্ষা পোষণ করেন। এ সর্বোচ্চ ত্যাগের জন্যেই আল্লাহ রাব্বুল আলামীন পবিত্র কুরআনের বিভিন্ন জায়গায় এবং বহু সংখ্যক হাদীসে বর্ণিত আছে শহীদদের মহা পুরস্কার ও সম্মান মর্যাদার ব্যাপারে। আমরা দেখব শাহাদাতের এ মর্যাদা সম্পর্কে আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল (সা) কী বলেনঃ
১। শহীদরা অমর
ইহলৌকিক এ জীবন থেকে শহীদরা বিদায় নিয়েও পৃথিবীতে তারা অমরত্ব লাভ করেন। আর পরজগতে যাওয়ার সাথে সাথে আল্লাহ তায়ালা তাদের জীবিত করে নিজের মেহমান হিসেবে জান্নাতে থাকতে দেন। আলে-ইমরানের ১৬৯ নং আয়াতে আল্লাহ বলেন,
“আর যারা আল্লাহর পথে নিহত হয় তাদের মৃত বলো না, প্রকৃত পক্ষে তারা জীবন-, কিন' তাদের জীবন সম্পর্কে তোমরা অনুভব করতে পারো না।” (আল-বাকারাঃ ১৫৪) হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা) বলেন, “তাদের প্রাণ সবুজ পাখীর মধ্যে ঢুকিয়ে দেয়া হয়। আল্লাহর আরশের সাথে ঝুলন- রয়েছে তাদের আবাস। ভ্রমণ করে বেড়ায় তারা গোটা জান্নাত, অতঃপর ফিরে আসে আবার নিজ নিজ আবাসে।” (মুসলিম, তিরমিযী, ইবনে মাজাহ)
২। শহীদরা নিহত হবার কষ্ট অনুভব করে না
আপন মালিককে সন'ষ্ট করার জন্য যারা সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করে, দয়াময় মালিক তাদের শাহাদাতের আঘাতকে ব্যথাহীন বেদনাহীন করে দেন। শহীদ করার জন্য যতো বড় আঘাতই তাদের উপর হানা হোক না কেন, তাতে তাদের কোন কষ্ট হয় না। তারা পায় না কোন যন্ত্রণা। প্রিয় রাসূল (সা) বলেছেনঃ
“শাহাদাত লাভকারী ব্যক্তি নিহত হবার কষ্ট অনুভব করে না। তবে তোমাদের কেউ পিঁপড়ার কামড়ে যতোটুকু কষ্ট অনুভব করে, কেবল ততোটুকুই অনুভব করে মাত্র।” (তিরমিযী- আবু হোরায়রা)
৩। শহীদের লাশ পচে না
মুয়াত্তায়ে ইমাম মালিকের সূত্রে কুরতুবীতে আলোচিত হয়েছে এভাবেঃ হযরত ইবনে জামুহ (রা) এবং আবদুল্লাহ্‌ ইবন আমর (রা) উভয় আনসার সাহাবীই উহূদের যুদ্ধে শাহাদাত বরণ করেন। তাদের উভয়কে একই কবরে সামাধিস' করা হয়। এর চল্লিশ বছর পর একবার প্রবল বেগে পানি প্রবাহিত হওয়ায় তাদের কবর ভেঙ্গে যায়। পানির প্রবল চাপ দেখে যখন অন্যত্র সমাধিস' করার জন্য তাদের কবর খনন করা হলো তখন তাদের ঠিক সে অবস'ায় পাওয়া গেল যে অবস'ায় তাদেরকে দাফন করা হয়েছিল। মুয়াবিয়া (রা) তার শাসনামলে মদীনায় কূপ খনন করতে মনস' করলেন। কূপ খননের আওতায় উহুদ যুদ্ধের শহীদের কবর পড়ে গেল। মুয়াবিয়া (রা) ঘোষণা দিলেন তোমরা তোমাদের আত্মীয় স্বজনের মৃত দেহ অন্যত্র নিয়ে যাও। এ ঘোষণার পর শবদেহ উঠিয়ে ফেলা হলো। দেখা গেল তারা যে অবস'ায় নিহত হয়েছিলেন ঠিক সেই অবস'ায়ই রয়েছেন। খনন কাজের কোন এক পর্যায়ে হযরত হামজার (রা) পায়ে কোদালের আঘাত লেগে গেলে সাথে সাথে তা থেকে রক্ত ক্ষরণ শুরু হয়। এ ঘটনা ঘটে উহুদ যুদ্ধের পঞ্চাশ বছর পর।
বস'ত এসব ঘটনা দ্বারা একথাই প্রমাণিত হয় যে আল্লাহ তায়ালা শহীদদের লাশ পচতে দেন না।
৪। কিয়ামতের দিন শহীদরা তাজা রক্ত নিয়ে উঠবে
যে ব্যক্তি যুদ্ধ ক্ষেত্রে শাহাদাত বরণ করেন তাকে রক্ত ভেজা কাপড়ে রক্তাক্ত দেখে কোন প্রকার গোসল ছাড়াই দাফন করা হয়। তাকে নতুন কাপড়ের কফিন পরানো হয় না। শাহাদাতের সময় তার দেহে যে কাপড় থাকে সে কাপড়েই তাকে দাফন করা হয়। শহীদদের ব্যাপারে ইসলামের বিধান এটাই। এবং এ অবস'ায়ই তারা হাশরের ময়দানে উঠবে। ক্ষতস'ান থেকে তখনও রক্ত বের হতে থাকবে। রসুলে খোদা (সা) বলেছেন, “যে ব্যক্তি আল্লাহর রাস-ায় আঘাত প্রাপ্ত হয়েছে কিয়ামতের দিন সেই আঘাত নিয়েই সে উঠবে আর তার ক্ষতস'ান থেকে রক্ত প্রবাহিত হতে থাকবে এবং রং হবে রক্তের মতই, কিন' গন্ধ হবে মিশকের মত।” (বুখারী ও মুসলিমঃ আবু হোরায়রা (রা)। অন্য হাদীসে উল্লেখ রয়েছে, নবী পাক (সা) বলেন, “কসম সেই সত্তার মুহাম্মদের প্রাণ যার হাতের মুঠোয়, কেউ আল্লাহর পথে কোনো আঘাত পেলে কিয়ামতের দিন সে আঘাত নিয়ে হাজির হবে। আর সে আঘাতের অবস'া হবে ঠিক মিশকের মতো” (বুখারী ও মুসলিম)। এটা শহীদদের কত বড় সৌভাগ্য যে, সে দিন তারা রক্তাক্ত দেহ এবং রক্ত ভেজা কাপড় চোপড় নিয়ে হাশর ময়দানে আল্লাহর দরবারে হাযির হবে।
৫। কবর আযাব থেকে রেহাই এবং সুপারিশ করার অধিকার লাভ
মহান আল্লাহ শহীদদের জন্যে অসংখ্য পুরস্কারের ব্যবস'া রেখেছেন। তাদের জন্যে নির্ধারিত ক্ষমা, মর্যাদা ও বিরাট পুরস্কারের কথা শুনে কার না ঈর্ষা হবে? আমার প্রিয় রাসূল (সা) বলেছেন, আল্লাহর নিকট শহীদদের জন্যে ছয়টি পুরস্কার রয়েছে। সেগুলো হচ্ছেঃ
ক) প্রথম রক্ত বিন্দু ঝরতেই তাকে মাফ করে দেয়া হয় এবং জান্নাত যে তার আবাসস'ল তা চাক্ষুষ দেখানো হয়।
খ) তাকে কবরের আযাব থেকে রেহাই দেয়া হয়।
গ) সে ভয়ানক আতঙ্ক থেকে নিরাপদ থাকে।
ঘ) তাকে সম্মানের টুপি পরিয়ে দেয়া হবে, যার এক একটি ‘ইয়াকুত’ পৃথিবী এবং পৃথিবীর মধ্যে যা কিছু আছে তা থেকেও উত্তম।
ঙ) তাকে উপঢৌকন স্বরূপ আয়ত নয়না হূর প্রদান করা হবে এবং
চ) তাকে সত্তর জন আত্মীয় স্বজনের জন্যে সুপারিশ করার ক্ষমতা প্রদান করা হবে (তিরমিযী, ইবনে মাজাহ, মেকদাম ইবনে মা’দীকরব)।
আবু আইয়ুব আনসারী (রা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রসুলে করীম (সা) বলেছেন, “যে ব্যক্তি শত্রুর সম্মুখীন হলো এবং তার মুকাবেলায় অটল অবিচল এমনকি এমন অবস'ায় নিহত হয়ে গেল তাকে কবরে কোন প্রকার চিন-ার সম্মুখীন হতে হবে না।” (তাবরানী)
৬। শহীদের জন্য রিয্‌কে হাসানা ও সনে-াষজনক জান্নাত: শহীদের বিভিন্ন নিয়ামত এবং অনুগ্রহ রাজির ব্যাপারে আল কুরআনে বহু প্রমাণ মেলে। তাদের সুসংবাদের কোন শেষ নেই। আল্লাহ বলেন,
“যে সব লোক আল্লাহর পথে হিজরত করেছে, পরে নিহত হয়েছে কিংবা মরে গেছে আল্লাহ তাদেরকে রিযকে হাসানা দান করবেন। নিঃসন্দেহে আল্লাহ উৎকৃষ্টতম রিযকদাতা। তিনি তাদের এমন স'ানে পৌঁছাবেন যাতে তারা সন'ষ্ট হয়ে যাবে।” (আল-হজ্জঃ ৫৮-৫৯)
“তোমরা যদি আল্লাহর পথে নিহত হও কিংবা মরে যাও তবে আল্লাহর যে রহমত ও দান তোমাদের নসীব হবে, তা এইসব লোকেরা যা কিছু সঞ্চয় করেছে তা থেকে অনেক উত্তম।” (আলে ইমরানঃ ১৫৭) যারা শাহাদাতের জযবা নিয়ে আল্লাহর পথে সংগ্রাম করে অতপর এ সংগ্রামে তারা শহীদ হোক কিংবা গাজী হিসেবে মৃত্যু বরণ করুক উভয় অবস'াতেই আল্লাহর নিকট থেকে তারা সমান প্রতিদান পাবে বলে এ আয়াতগুলোতে উল্লেখ করা হয়েছে।
৭। শহীদদের জন্যে রয়েছে মহা পুরস্কার: মুজাহিদরা খোদাদ্রোহীদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়ে শহীদ কিংবা গাজী উভয় অবস'াতেই আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা তাদের জন্য মহা পুরস্কারের কথা ঘোষণা করেছেন। এই মহা পুরস্কার তারাই লাভ করবে যারা আখিরাতের বিনিময়ে দুনিয়ার জীবনকে বিক্রি করে দেবার মতো সৎ সাহস রাখে। আল্লাহ ঘোষণা করেন-
“সেইসব লোকদেরই আল্লাহর পথে লড়াই করা কর্তব্য যারা পরকালের বিনিময়ে দুনিয়ার জীবনকে বিক্রয় করে দেয়, যারা আল্লাহর পথে লড়াই করে এবং নিহত কিংবা বিজয়ী হয়। আমরা তাকে অবশ্যই বিরাট পুরস্কার দান করবো।” (আন-নিসাঃ ৭৪)
সূরা আলে ইমরানে শহীদদের প্রাপ্য পুরস্কারসমূহ সম্পর্কে আল্লাহতায়ালা ঘোষণা করেন-“তাদের সকল অপরাধ আমি ক্ষমা করে দেব। আর এমন জান্নাত তাদের দান করবো যার তলদেশে রয়েছে সদা প্রবাহমান ঝর্নাধারা; এ হচ্ছে আল্লাহর নিকট তাদের পুরস্কার আর আল্লাহর নিকট রয়েছে সর্বোত্তম পুরস্কার।” (আলে-ইমরানঃ ১৩৬)
৮। আল্লাহর সান্নিধ্য এবং যা খুশী তাই পাবার অধিকার লাভ: কুরআন মজীদে বলা হয়েছে কোন দৃষ্টিই আল্লাহর দর্শন লাভ করতে সক্ষম নয়। কোন নবীও আল্লাহকে দেখতে পাননি কিন' শহীদরা মৃত্যুর পর পরই আল্লাহর দর্শন লাভ করেন। ওহুদ যুদ্ধে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনে হারাম শাহাদাত লাভ করেন। যুদ্ধের পর রাসূল করীম (সা) শহীদের পুত্র প্রখ্যাত সাহাবী হযরত জাবির ইবনে আবদুল্লাহকে সান-্বনা দিতে গিয়ে বলেন- “হে জাবির, আমি কি তোমাকে তোমার পিতার সঙ্গে আাল্লাহ রাব্বুল আলামীনের সাক্ষাতের সুসংবাদ দেব না? জাবির বললেন অবশ্যই দিন হে আল্লাহর রাসূল। তখন তিনি বলেন ঃ আল্লাহ্‌ কখনো অন-রালবিহীন মুখোমুখি কথা বলেন নি। তিনি বলেন ঃ হে আমার গোলাম তোমার যা খুশী আমার নিকট চাও। আমি তোমায় দান করবো।” তিনি জবাবে বলেছেন, “হে আমার মনিব। আমাকে জীবিত করে আবার পৃথিবীতে পাঠিয়ে দিন আবার আপনার পথে শহীদ হয়ে আসি।” তখন আল্লাহ তাকে বলেন, “আমার এ ফয়সালা তো পূর্বেই জানিয়ে দিয়েছি যে, মৃত লোকেরা ফিরে যাবে না।” তখন তোমার পিতা আরজ করেন, “আমার মনিব তবে অন-ত আমাকে যে সম্মান ও মর্যাদা আপনি দান করেছেন, তার সুসংবাদ পৃথিবীবাসীদের জানিয়ে দিন।” তখন আল্লাহ নিুাকে্ত আয়াতটি নাযিল করেন।
“যারা আল্লাহর পথে নিহত হয়েছে তাদের মৃত মনে করো না, তারা জীবিত।” (জামে আত্‌-তিরমিযী, সুনানে নাসায়ী ঃ জাবির ইবনে আবদুল্লাহ্‌)
৯। শহীদ পরিবারের গৌরব: তিরমিযী, ইবনে মাজাহ হাদীস গ্রনে' মেকদাম ইবনে মাদীকরব বর্ণনা করেন যে, রাসূল (সা) বলেছেন, “একজন শহীদকে তার সত্তর জন আত্মীয় স্বজনের জন্য সুপারিশ করার অধিকার দেয়া হবে।”
তাই আল্লাহ তায়ালা যদি কারো সন-ানকে শাহাদাতের মর্যাদা প্রদান করেন তবে তারা শহীদের পিতামাতা হবার গৌরব অর্জন করেন। তাদের জন্য এর চেয়েও খুশীর বিষয় হলো তারা তাদের শহীদ সন-ানের সুপারিশ লাভের আশা পোষণ করতে পারেন। একজন শহীদ যেমন তার বংশে, পরিবারে এক শাশ্বত ঐতিহ্য সৃষ্টি করে যান তেমনি আবার তার অনুসারীদেরকে ছাড়াও তার আপন বংশের লোকদেরকে চিরদিন জিহাদের জন্য অনুপ্রাণিত করে থাকেন। সুতরাং মুমিনদের দৃষ্টিতে শহীদ পরিবার অত্যন- সম্মানীয় এক আদর্শ পরিবার। শহীদের পিতা-মাতা মুমিনদের নিকট শ্রদ্ধাস্পদ, শহীদের সন-ান, স্ত্রী, ভাই-বোন ও আত্মীয়-স্বজনকে সকল মুমিন নিজেদেরই আত্মীয়-স্বজন মনে করে। এসব দিক থেকেই শহীদ পরিবার গৌরবান্বিত।
১০। শাহাদাত উচ্চ মর্যাদার মডেল: শহীদের অফুরন- মর্যাদার আরেক বিশেষ দিক হচ্ছে মহাগ্রন' আল কুরআনে শহীদদেরকে উচ্চ মর্যাদার এক বিশেষ মডেল হিসেবে নির্ণয় করা হয়েছে। যেমন কুরআনে ঘোষণা করা হয়েছে,
“যে ব্যক্তি আল্লাহ এবং রাসূলের আনুগত্য করবে, সে ঐসব লোকদের সংগী হবে, যাদের প্রতি আল্লাহ তায়ালা নিয়ামত দান করেছেন। তারা হচ্ছেন নবী, সিদ্দীক, শহীদ এবং সালেহ লোকগণ। ........প্রকৃত অবস'া জানার জন্যে আল্লাহর জ্ঞানই যথেষ্ট।” (নিসাঃ ৬৯-৭০)
এ আয়াতে পরকালীন উচ্চ মর্যাদার কয়েকটি স-রের কথা উল্লেখ করা হয়েছে -
অর্থাৎ (১) নবীগণের স-র, (২) সিদ্দীকগণের স-র, (৩) শহীদগণের স-র, (৪) সালেহ বান্দাদের স-র।
রাসূলে খোদা (সা) নিজেও কিছু সংখ্যক লোককে উপরোক্ত লোকদের সাথীত্ব লাভে সক্ষম হবার সুসংবাদ দিয়ে গেছেন। যেমনঃ এ বার এক ব্যক্তি নবী পাকের (সা) নিকট এসে বললো, “ওগো আল্লাহর রাসূল, আমি সাক্ষ্য দিয়েছি আল্লাহ্‌ ছাড়া আর কোন ইলাহ্‌ নেই এবং আপনি আল্লাহর রাসূল। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করি, আমার মালের যাকাত পরিশোধ করি এবং রমযান মাসের রোযা রাখি।” তার বক্তব্য শুনে নবী পাক (সা) বললেন, “তুমি যা বললে এর উপর কায়েম থেকে যে মারা যাবে কিয়ামতের দিন সে নবী, সিদ্দীক ও শহীদগণের সাথে থাকবে” (মুসনাদে আহমদ, আমর ইবনে মুররাহ আল জুহহানী)। এখন আমাদের কাছে একথা পরিষ্কার হলো, শাহাদাত এমন একটি উচ্চ মর্যাদা, যে পর্যায়ে উপনীত হওয়া প্রকৃত ঈমানদার মাত্রেরই কাম্য। সিদ্দীক ও শহীদের চাইতে উচ্চ মর্যাদায় উপনীত হবার আর কোন অবকাশই নেই। সুতরাং শাহাদাত উচ্চ মর্যাদার মডেল।
এ সকল সম্মান ও মর্যাদার কারণেই সাহাবায়ে কিরামগণ শাহাদাতের অমিয় সুধা পান করার জন্য ছিলেন সর্বদা ব্যাকুল, পাগলপারা। একটি ঘটনাই তার উজ্জ্বল নমুনা, একবার রাবী আবিবকর ইবনে আবী মুসা আশয়ারী (রা) বললেন, “তারা দু’জনেই যুদ্ধের সময় উপসি'ত ছিলেন- রাসূল (সা) বললেন, নিশ্চয়ই জান্নাতের দরজাগুলো তলোয়ারের ছায়াতলে।” একজন লোক দাঁড়িয়ে গেল যার কাপড়-চোপড় তেমন ছিল না, বললো, “হে আবী মুসা, রাসূল (সা) কি বললেন শুনলেন তো? তিনি বললেন, হ্যাঁ শুনলাম। তো তারপর লোকটি বন্ধুদের কাছে গিয়ে বললেন, তোমাদেরকে সালাম দিয়ে যাচ্ছি। আর আসবো না।” তারপর তার তলোয়ারের খাপটা ভেঙ্গে ফেলে দিলেন। এরপর তলোয়ার নিয়ে দুশমনদের দিকে চললেন, তাদেরকে মারতে থাকলেন যে পর্যন- না তিনি নিহত হলেন। শাহাদাতের মর্যাদা পাওয়ার খাঁটি কামনা যারা করবে তাদের জন্য রাসূল (সা) সুসংবাদ দিয়েছেন, “তারা বিছানায় মারা গেলেও আল্লাহ্‌ তাদেরকে সে মর্যাদা দান করবেন।”
উপসংহার
শাহাদাতের রক্ত আল্লাহ বৃথা যেতে দেন না। এটাই আল্লাহর বিনিময়। শহীদের উত্তরসূরীরা যখন সংগঠিতভাবে শাহাদাতের তামান্নায় উজ্জীবিত হয়ে দ্বীন প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে অবতীর্ণ হয় তখন তাদের সাহায্য করা আল্লাহর দায়িত্ব হয়ে পড়ে। স্বয়ং আল্লাহ্‌ বলেন, “মুমিনদের সাহায্য করা আমার দায়িত্ব।” বিংশ শতকের কর্মক্লান- সূর্য যখন পাশ্চাত্যের আকাশে বিদায়ের পটে, আমরা বিশ্ববাসী উৎসুক চোখে মহাসাগরের বেলাভূমিতে দাঁড়িয়ে সূর্যাসে-র দৃশ্য অবলোকন করছি। পাশ্চাত্য সভ্যতার অহংকার বিশাল টাইটানিক সব কিছুসহ কালের অতল গহ্বরে বিলীন প্রায় অবস'ায় ক্যাপ্টেন টি.সি. ইলিয়ট বিশ্ববাসীকে জরুরী মেসেজ দিয়ে বলেছেন, “ চৎধু ভড়ৎ ঁং হড়,ি বি ধৎব ধঃ ঃযব ঃরসব ড়ভ ড়ঁৎ ফবধঃয .” “আমাদের জন্য প্রার্থনা কর, বাঁচাও আমাদেরকে, আমরা মৃত্যুর দ্বারে।” গোটা মুসলিম বিশ্বও আজ যেন সন্দেহ, অবিশ্বাস, ভোগবাদ, নেশা ও যৌনাচারের এ ভয়াল সমুদ্র থেকে গগনবিদারী চিৎকার দিয়ে ঘোষণা করছে কোরআনের সেই অমিয় বাণী- “হে মনিব, তুমি আমাদের এই জালিম অধ্যুষিত এলাকা থেকে বের করে নাও।” এই মজলুম, যৌনাসক্ত, দিশেহারা পথিককে অপসংস্কৃতির গড্ডালিকা প্রবাহ থেকে ডাষ্টবিন থেকে তুলে এন হেরার রাজতোরণ দেখানোর দায়িত্ব নিতে হবে এমন একদল মর্দেমুমিনকে যারা ঈমানের চেতনায় তেজদীপ্ত এবং শাহাদাতের উদ্দীপনায় সদা উদ্বেলিত, আর যারা বাতিলের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে উমার ফারুক, উসমান, হামযা, জাফর বিন আবু তালিব, আবদুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা, হুসাইন, মুসাইয়্যিব, সাইয়্যেদ আহমদ ব্রেলভী, তিতুমীর, সালাহ উদ্দীন, ইবনে কাশিম, হাসানুল বান্নাহ, আব্দুল কাদের

আওদাহ, সাইয়্যেদ কুতুব, আবদুল মালেক, সাব্বির, হামিদ, আইয়ুব, জব্বার-এর মত ভুবন কাঁপানো সে ঘোষণা সদম্ভে উচ্চারণ করতে পারে, আল্লাহ্‌ তায়ালা কোরআন পাকে যেমন উল্লেখ করেন- “হে প্রভূ, আমরা তোমার উপর ঈমান আনলাম, আর শহীদদের কাতারে আমাদের নাম লিখে দাও।” বিশ্বজাহানের মালিকের কাছে সিজদাবনত চিত্তে আমাদেরও মুনাজাত, হে আল্লাহ! এই দিক ভ্রান- জাতির কণ্ঠে সত্যের অবিনাশী গান তুলে দিতে আমরাও শাহাদাতের অমিয় সুধা পান করতে প্রস'ত। আল্লাহ্‌ আমাদের সবাইকে কবুল করুন। আমীন।