ইসলামী ও পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিতসহ সমাজের বিভিন্ন পদ ও পেশার লোকের মধ্যে ইসলামে রাজনীতি আছে কি নেই এ নিয়ে বিতর্কের ডামাডোল বহু আগে থেকেই চালু আছে। ইসলামী শিক্ষায় শিক্ষিত সকল আলেমই যেমন ইসলামী রাজনীতির পক্ষে বলেন না ঠিক তেমনই ভাবে পাশ্চাত্য বা অন্য শিক্ষায় শিক্ষিত সকলেই ইসলামী রাজনীতির বিপক্ষেও বলেননা। কেউ বলেন এর দ্বারা ইসলামের অবমাননা করা হয় আবার অন্যেরা বলেন রাজনীতি করা ঈমানের দাবি। কোনটি ঠিক আর কোনটি বেঠিক তা কুরআন ও হাদীসের আলোকে বুঝার চেষ্টা করব আমরা।
ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীদের সাথে তাল মিলেয়ে ইসলাম ধর্ম পালনকারীদের মধ্য থেকে অনেকে অনবরত ইসলামী রাজনীতির বিরুদ্ধে বিষদগার করে থাকে। তাদের মতে কুরাআন শুধুমাত্র আনুষ্ঠানিক কিছু এবাদতের মধ্য দিয়ে পরকালের জীবনকে সাফল্যমন্ডিত করার দিক নির্দেশনা দিয়ে থাকে। একটি রাষ্ট্রে একাধিক ধর্মের অনুসারীদের বাস তাই রাষ্ট্র পরিচালনায় ধর্মের কোন সংশ্লিষ্টতা থাকা উচিত নয়। তারা এও মনে করে সমাজের সুবিধাবাদী ও পথভ্রষ্ট একটা অংশ ধর্মীয় রাজনীতি নিয়ে নিরর্থক মাতামাতি করে। সমালোচকেরা নিজেদেরকে ধর্মভীরু কিন্তু ধর্মান্ধ নয় বলে দাবি করে থাকে। তাদের সমালোচনা থেকে মনে হয়, কুরআনে যদি এমন আয়াত থাকতো যার সরাসরি অর্থ দাঁড়াতো, তোমরা রাজনীতি কর, প্রয়োজনে হরতাল কর, মিছিল-মিটিং কর, গনসংযোগ কর, ইলেকশনে অংশগ্রহণ কর, ইলেকশনে জিতে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করে ইসলামী আইন প্রতিষ্ঠা কর। আর তা না করলে তোমাদেরকে পরকালে কঠিন শাস্তি দেয়া হবে। তাহলে হয়তো তারা নিজেদেরকে ইসলামী রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত করত। আসলে এটা একটা কথার কথা । বাস্তবতা হলো তারা কুরআনের অনেক নির্দেশকেই বৃদ্ধাঙ্গুলী দেখিয়ে জমিনে চলা-ফেরা করে থাকে। তবে এমনটি হলে প্রকৃত ঈমানদারগণ ইসলামের নির্দেশ অনুযায়ী রাজনীতি করুন আর নাই করুন অন্ততঃপক্ষে আল্লাহর আদেশের বিরুদ্ধে যাবে এ ভয়ে ইসলামী রাজনীতির বিরুদ্ধে কথা বলা থেকে বিরত থাকতেন।
সমালোচকদের প্রত্যাশা অনুযায়ী কুরআন এবং হাদীসে হয়তো পারিভাষিক শব্দ (রাজনীতি করা ফরজ) আমরা হুবহু সেভাবে পাবনা। কিন্তু কুরআনের আয়াত ও হাদীসের ব্যাখ্যার মাধ্যমে আমরা সে ধরণের বহু নির্দেশ পেয়ে থাকি । কিন্তু ব্যাখ্যা মূলক সংজ্ঞা গ্রহণ করতে সমালোচকরা মানসিক ভাবে তৈরি নয়। ব্যাখ্যা মূলক সংজ্ঞাকে তারা কুরআন ও হাদীসের সাথে সংগতিহীন বলে মনে করে এবং তারা এটাকে অপব্যাখ্যা বলে প্রচার করে। আর এভাবেই তারা ইসলামী রাজনীতির বিপক্ষে আমাদের মাঝে জোর প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে।
পারিভাষিক শব্দগুলিকে নিয়ম-নীতির একমাত্র মানদণ্ড ধরে নিয়ে সকল কার্যক্রম সম্পন্ন করতে চাইলে জীবন নামক এ তরীর চলার পথ কোন এক সময় সংকীর্ণ হয়ে যেতে বাধ্য। তাই চলার পথকে সাবলীল ও সুন্দর করার জন্য মূলনীতির সাথে সংগতি রেখে তৈরি করতে হয় আরও অনেক নীতি যা প্রতিটি কিতাবেই বৈধতা দিয়ে থাকে।
ইসলামী রাজনীতি নিয়ে ধম্রজাল সৃষ্টির জন্য সাধারণতঃ যে প্রশ্নগুলি করা হয় তা হলো- ১. কলুষিত রাজনীতির সাথে ইসলামকে জড়ানো কি ঠিক? ২. শান্তিপূর্ণ ধর্ম ইসলামকে রাজনীতিতে জড়ানো কি ক্ষমতালোভীদের কাজ নয়? ৩. মুসলমানদের মধ্যে যারা ইসলামী রাজনীতির সাথে জড়িত নয় তারা কি ইসলামের শত্রু? ৪. ইসলামী রাজনীতিতে অমুসলিমরা কি কোন ভূমিকা রাখতে পারবে?
উপরোল্লিখিত বিষয়গুলি নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করা যথার্থ কিনা, পর্যায়ক্রমে আলোচনা করলে আমাদের নিকট তা মূর্ত হয়ে উঠবে। প্রথমেই ইসলাম, রাজনীতি এবং ইসলামী রাজনীতি কি সংক্ষেপে সে দিকে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।
ইসলামঃ আল্লাহ পাকের পক্ষ থেকে মনোনিত একমাত্র দ্বীন হচ্ছে ইসলাম। আল্লাহ বলেন, নিঃসন্দেহে একমাত্র ইসলাম হচ্ছে আল্লাহ্র নিকট গ্রহণযোগ্য দ্বীন । (৩.আলে ইমরানঃ ১৯) আজ আমি তোমাদের জন্যে তোমাদের দ্বীনকে পূর্নাঙ্গ করে দিলাম, তোমাদের প্রতি আমার নিয়ামত (অবদান) সম্পূর্ণ করে দিলাম এবং ইসলামকে তোমাদের জন্যে দ্বীন হিসাবে পছন্দ করলাম। (৫. ময়েদাঃ ৩)
দ্বীন ইসলামের অনেকগুলি অর্থের মধ্যে একটি হলো জীবন বিধান বা আনুগত্যের বিধান। একজন ব্যক্তির জীবন, একটি সমাজ ও একটি রাষ্ট্র কি ভাবে পরিচালিত হবে তা এ বিধানে স্পষ্ট করে বলে দেয়া আছে। এ জীবন বিধানের প্রতি পুরোপুরি আনুগত্যশীল হতে পারলে ইসলামের অন্যান্য অর্থগুলি যেমন- শান্তি, সন্ধি, নিরাপত্তা, আত্নসমর্পন ইত্যাদির প্রায়োগিক ও ব্যবহারিক দিক গুলিও সহজেই অর্জিত হতে পারে।
রাজনীতিঃ Politics is a process by which groups of people make collective decisions. (http://en.wikipedia.org/wiki/Politics ) অর্থাৎ রাজনীতি হচ্ছে একটি প্রক্রিয়া যার দ্বারা এক বা একাধিক দল সম্মিলিত ভাবে সিদ্ধান্ত সমুহ গ্রহণ করে থাকে। প্লেটোর বর্ণনানুসারে রাজনীতি হচ্ছে একটি আদর্শ রাষ্ট্র এবং তা লাভ করার জন্য পন্থা। তাহলে একটি আদর্শ সমাজ তৈরির উপায় হচ্ছে রাজনীতির অন্তর্নিহিত অর্থ ও মূল কথা। বর্তমান সমাজের চেয়ে আরো উন্নতমানের সমাজ উপহার দেয়ার ব্যাপারে জনগণকে Avkvwš^Z হওয়ার ইঙ্গিত রাজনীতিই দিয়ে থাকে।
ইসলামী রাজনীতিঃ ইসলামের নীতিমালার আলোকে সমাজ ও রাষ্ট্রের সংস্কারের মাধ্যমে আদর্শ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে দায়িত্বপ্রাপ্ত একদল সদস্যের সম্মিলিত ভাবে পারস্পরিক পরামর্শের ভিত্তিতে সার্বিক সিদ্ধান্ত গহণ করার প্রক্রিয়াকে ইসলামী রাজনীতি বলে। দায়িত্বপ্রাপ্ত সদস্যগণ অন্যান্য সদস্যদের দ্বারা নির্বাচিত হয়ে থাকেন।
আল্লাহ বলেন - যারা তাদের পালনকর্তার আদেশ মান্য করে, নামায কায়েম করে; পারস্পরিক পরামর্শক্রমে কাজ করে এবং আমি তাদেরকে যে রিযিক দিয়েছি, তা থেকে ব্যয় করে, (৪২. শূরাঃ ৩৮)
শিরনামের সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যার পর ইসলামী রাজনীতি নিয়ে সৃষ্ট প্রশ্নগুলির দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করছি-
কলুষিত রাজনীতির সাথে ইসলামকে জড়ানো কি ঠিক?
রাজনীতি শব্দটি আমাদের কানের পর্দাকে স্পর্শ করার সাথে সাথে মানস পটে একটি সরকার, রাজনীতিকবৃন্দ এবং তাদের দ্বারা গৃহীত রাজ্যশাসন-প্রণালীর চিত্র ভেসে উঠে। অথবা অধিকাংশ ক্ষেত্রে নেতিবাচক ভাবে এমন একটা ধারণা দেয়া হয় যার অর্থ দাঁড়ায় রাজনীতি হচ্ছে দুর্নীতি ও নোংরা কৌশলের হাতিয়ার। যেহেতু অধিকাংশ রাজনীতিকরা নিজেদের ¯^v_© রক্ষা করতে রাজনীতির আড়ালে অসৎ পথ অবলম্বন করে থাকে সেহেতু জনসাধরণ খোদ রাজনীতিকেই নোংরা ভাবতে শুরু করেছে। জনসাধারনের এ ধারণাটাকে কাজে লাগিয়ে অসৎ লোকেরা খুব সহজেই তাদেরকে এও বুঝাতে সক্ষম হয়েছে যে, রাজনীতি ধর্মভীরু ও সৎলোকদের জন্য নয়। তাছাড়া ধর্মকে রাজনীতিতে টেনে আনাও মহা অন্যায়। এ কথাগুলি একজন ধর্মভীরু ও সৎলোকের সামনে উত্থাপন করার সাথে সাথে তিনি নিজের ঈমানকে অটুট রাখার জন্যে রাজনীতি থেকে নিরাপদ দুরে অবস্থান নেয়ার জন্য আকুল হয়ে উঠেন।
আমরা সবাই মিলে যদি রাজনীতিকে অসৎলোকদের জন্য উন্মুক্ত করে দিই তাহলে তা তো কলুষিত হবেই। পক্ষান্তরে আমাদেরকে বুঝতে হবে রাজনীতিতে সৎলোকের সমাগম ঘটাতে পারলে তা পরিচ্ছন্ন থাকবে। ইসলামের প্রকৃত অনুসারীগণ অবশ্যই সৎ হয়ে থাকেন। কাজেই রাজনীতিকে কলুষমুক্ত রাখার জন্য সৎলোকের অংশ গ্রহণ অত্যাবশ্যক। রাজনীতি নিজেনিজেই কলুষিত বা কলুষমুক্ত হতে পারেনা। আল্লাহ্র দেয়া নীতি দিয়ে শুধু রাজনীতি কেন আমরা যদি আমাদের জীবনের সকল বিভাগকে সজ্জিত করতে পারি তাহলে শান্তির সুবাতাস সর্বত্রই সহজেই প্রবাহিত হবে। ইসলামকে রাজনীতির সাথে জড়ানোর ব্যাপার নয় বরং ইসলামের অনুসারীদের ঈমানি দায়িত্ব প্রচলিত রাজনীতিকে কলুষমুক্ত করা। আল্লাহ্ বলেন -
আর তোমাদের মধ্যে এমন একটা দল থাকা উচিত যারা অহবান জানাবে সৎকর্মের প্রতি, নির্দেশ দেবে ভাল কাজের এবং বারণ করবে অন্যায় কাজ থেকে, আর তারাই সফলকাম। (৩. আলে ইমরানঃ ১০৪)
রাজনীতির নামে যারা অন্যায়কে প্রচার ও প্রতিষ্ঠা করতে চায় তাদেরকে প্রতিরোধ করতে হবে রাজনীতি দিয়েই ন্যায় প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে।
শান্তিপূর্ণ ধর্ম ইসলামকে রাজনীতিতে জড়ানো কি ক্ষমতালোভীদের কাজ নয়?
যখন প্রশ্ন করা হয়ে থাকে পবিত্র কুরআনে রাষ্ট্রের বিভিন্ন আইন-কানুনের ব্যাপারে যে নির্দেশগুলি দেয়া হয়েছে সেগুলি বাস্তবায়িত হবে কি ভাবে? উত্তরে অনেকে বলে থাকেন, রাষ্ট্র পরিচালনায় যাঁরা অংশ গ্রহণ করে থাকেন তাঁদেরকে দ্বীনের দাওয়াত দানের মাধ্যমে ভাল মুসলিম বানাতে পারলে তাঁরা নিজেরাই একসময় ¯^ZtùzZ© ভাবে কুরআনের আইন প্রতিষ্ঠা করতে আগ্রহী হবেন। আপাতদৃষ্টিতে যুক্তিটা বেশ শক্তিশালী মনে হতে পারে। কিন্তু বিষয়টা অত সহজ নয়। প্রসাশন যন্ত্রের সবাইকে দাওতের মাধ্যমে পরিসুদ্ধ করা যাবে এমনটি আশা করা বাতুলতা ছাড়া আর কিছুই না। তাছাড়া একদল সৎলোকের সংঘবদ্ধ প্রচেষ্টা ছাড়া কেউ ভাল মুসলিম হলেই প্রতিকুল পরিবেশে আল্লাহর আইন প্রতিষ্ঠা করতে পারবেন তাও জোর দিয়ে বলা যায়না। রাষ্ট্রের হর্তা-কর্তাগণও কোন না কোন আদর্শের অনুসারী হয়ে থাকেন। আর হর্তা-কর্তাগণ যদি ইসলাম বিদ্বেষী হয়ে থাকেন তাহলে কেউ চাইলেই তাঁরা ইসলামের জন্য রাস্তা পরিস্কার করে দিবেন এমনটি ভাবা নেহায়েত বোকামি ছাড়া আর কিছুই না।
কোন আদর্শকে প্রতিষ্ঠিত করতে হলে সে আদর্শের ধারক ও বাহকদেরকেই দায়িত্ব গ্রহণ করতে হয়। রাষ্ট্রযন্ত্র ইসলামের বিপরীত আদর্শের লোকদের কর্তৃত্বে থাকলে সমাজে যতই ইসলাম প্রিয় লোকের প্রাচুর্যতা থাকুকনা কেন রাষ্ট্রের সর্বস্তরে আল্লাহ্র আইনের উপস্থিতি কখনই লক্ষ্য করা যাবেনা। ক্ষমতা লোভী হিসাবে নয়, ইসলামের আইন প্রতিষ্ঠার নিয়তে মুমিনগণ রাজনৈতিক কর্মকান্ডে জড়িত হয়ে থাকেন। তবে ইসলামের আলোকে রাজনৈতিক কর্মকান্ডের পরিসীমা ব্যাপক। এর মাধ্যমে ইসলামের সঠিক জ্ঞান দান, দাওয়তি কাজের সমপ্রসারণ, নৈতিক মানের উন্নয়ন, সমাজ কল্যাণ ও সংস্কার মূলক কাজ সহ বহুবিধ কাজের আঞ্জাম দেয়া যায়। কাজেই রাজনৈতিক সংস্কৃতির মধ্যে বিচরণ করেই ইসলামের আদর্শ অনুযায়ী সৎলোক তৈরি করতে হবে কাঙ্খিত ফল লাভের উদ্দেশ্যে।
ইসলামে কিছু আইন আছে যা ব্যক্তিগত উদ্যোগে সম্পাদন করতে হয, আর কিছু সামষ্টিক ভাবে। সামষ্টিক ভাবে যে আইনগুলি মানতে হয় তা সমাজের বিভিন্ন স্তর থেকে শুরু করে রাষ্ট্রের বিভিন্ন বিভাগ পর্যন্ত বিস্তৃত। রাষ্ট্রের আইন ইসলাম পরিপন্থী হলে ইচ্ছা থাকা সত্বেও অনেক আইন সমষ্টিগতভাবে তো নই ব্যক্তিগতভাবেও মানা সম্ভব হয়না। উদাহরণ ¯^iƒc বলা যেতে পারে কোন ব্যক্তি সুদমুক্ত অবস্থায় তাঁর জীবন অতিবাহিত করতে চাইলেও তিনি তা পারবেননা যদি রাষ্ট্রের অর্থনীতি সুদের উপর প্রতিষ্ঠিত হয়। কারণ তাঁর সার্বিক কাজে সুদের প্রভাব কোন না কোন ভাবে পড়বেই। আরও অনেক উদাহরণ দেয়া যাবে যদি ইসলামের নীতিমালার আলোকে রাষ্ট্র পরিচালিত না হয় তাহলে কিভাবে ব্যক্তিগত আমল অবৈধতার হাতছানিতে প্রভাবিত হয়।
তাহলে উপরোল্লিখিত সমস্যা থেকে পরিত্রানের উপায় কি? দুটি উপায়, যদি সম্ভব হয় হিজরত করতে হবে সেই দেশে যেখানে আল্লাহর আইন প্রতিষ্ঠিত আছে, নতুবা নিজের দেশের শাসন ব্যবস্থাকে ইসলামের আলোকে সাজাতে হবে। নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে রাষ্ট্রের শাসনতন্ত্র পরিবর্তনের জন্য বর্তমানে যে পথটি খোলা আছে তা হচ্ছে রাজনীতিতে অংশ গ্রহণ করে গণতন্ত্রের মাধ্যমে জনসাধারণের সমর্থন আদায় করা। গণতন্ত্রের মাধ্যমে রাজনৈতিক কর্মকান্ডের মধ্য দিয়ে সরকার পরির্তন হচ্ছে ¯^xK…Z পথ। রাষ্ট্রের ক্ষমতা হাতে আসলেই শুধুমাত্র সমাজের সর্বস্তরে ন্যায় প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। ইসলাম ছাড়া অন্যান্য আদর্শের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। বিপরীত আদর্শের ছায়াতলে কোন আদর্শই প্রস্ফুটিত হতে পারেনা। রাষ্ট্র পরিচালনাকারীদের উদ্দেশ্যে আল্লাহ্ সুবহানো তায়ালা বলেনঃ
তারা এমন লোক যাদেরকে আমি পৃথিবীতে শক্তি-সামর্থ্য (রাষ্ট্র ক্ষমতা) দান করলে তারা নামায কায়েম করবে, যাকাত দেবে এবং সৎকাজে আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ করবে। প্রত্যেক কর্মের পরিণাম আল্লাহ্র ইখতিয়ারভূক্ত। (২২. হাজ্জঃ ৪১)
তোমাদের মধ্যে যারা বিশ্বাস স্থাপন করে ও সৎকর্ম করে, আল্লাহ্ তাদেরকে ওয়াদা দিয়েছেন যে, তাদেরকে অবশ্যই পৃথিবীতে শাসনকর্তৃত্ব দান করবেন। যেমন তিনি শাসনকর্তৃত্ব দান করেছিলেন তাদের পূর্ববর্তীদেরকে, (২৪. নূরঃ ৫৫)
প্রথম আয়াতটিতে শাসনকর্তৃত্ব কেউ পেয়ে থাকলে তাঁর দায়িত্ব ও কর্তব্য কি হবে তা বলে দেয়া হয়েছে। সুতরাং কোনভাবেই একটি মুসলিম জন অধ্যূষিত দেশের সরকার ইসলামী আইন প্রতিষ্ঠা না করার দায় এড়াতে পারবেননা।
দিত্বীয় আয়াতে বিশ্বাসী ও সৎকর্মশীলদেরকে পৃথিবীতে শাসনকর্তৃত্ব দান করার ওয়াদও করেছেন আল্লাহ্ সুবহানো তায়ালা। প্রশ্ন হলো একজন ব্যক্তি কর্তৃত্ব পেয়ে থাকেন কিভাবে? নিশ্চয় আল্লাহ তায়ালা আসমান থেকে তাঁকে কর্তৃত্ব দিয়ে পাঠিয়ে দেননা। আমাদের সমাজে কর্তৃত্বশীল ব্যক্তি কে হবেন তা নির্ধারণ করার জন্য পন্থা হলো গনতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় সাধারণ নির্বাচন। আর তা রাজনৈতিক কর্ম কান্ডের মধ্য দিয়েই পরিচালিত হয়ে থাকে। কাজেই আল্লাহ্র আইন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে চলমান পরিস্থিতিতে রাজনীতির বিকল্প কোন পথ খোলা আছে কি? পানিতে না নেমে যেমন সাঁতার শেখা যায়না, তেমনইভাবে ইসলামী রাজনীতির সাথে জড়িত না হয়ে সমাজে ও রাষ্ট্রে আল্লাহ্র আইনের প্রয়োগ কল্পনাও করা যায়না। ইসলাম বিরোধী চক্র এটাকে ক্ষমতা দখলের চেষ্টা বলে প্রচার করে থাকে।
মুসলমানদের মধ্যে যারা ইসলামী রাজনীতির সাথে জড়িত নয় তারা কি ইসলামের শত্রু?
আত্মরক্ষা, সমাজিক নিরাপত্তা, রাষ্ট্রের অক্ষন্ডতা, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা করা, বহিশত্রুর আক্রমণ মোকাবিলা, দেশের আভ্যন্তরিন সমস্যা সমাধান, ধর্মীয় অনুশাসন মানা ইত্যাদির জন্যে ইসলামে রয়েছে সুস্পষ্ট নীতিমালা। উল্লিখিত নীতিমালাগুলি যেমন এক ব্যক্তিকে নির্দেশ করে তাকে কি ভাবে তার জীবন পরিচালনা করতে হবে, একই ভাবে একটি সমাজ ও রাষ্ট্রের সার্বিক কাজ-কর্ম কি ভাবে পরিচালিত হবে তাও নির্দেশ করে থাকে। কাজেই কুরআনের অনুসারী হিসাবে একজন মুসলিম বলতে পারেনা কুরআনের কিছু নীতি মানব আর কিছু মানবনা। আল্লাহ্ বলেন -
তবে কি তোমরা গ্রন্থের কিয়দংশ বিশ্বাস কর এবং কিয়দংশ কর অবিশ্বাস? যারা এরূপ করে, পার্থিব জীবনে দুর্গতি ছাড়া তাদের আর কোনই পথ নেই! কিয়ামতের দিন তাদেরকে কঠোরতম শাস্তির দিকে পৌঁছে দেয়া হবে। আল্লাহ তোমাদের কাজ-কর্ম সম্পর্কে বে-খবর নন। (২. বাকারাঃ ৮৫)
যেসব লোক আল্লাহ্ যা অবতীর্ণ করেছেন, তদনুযায়ী ফায়সালা করে না, তারাই কাফের। (৫. মায়েদাহঃ ৪৪)
যারা আল্লাহ্ ও শেষ দিবসের আশা রাখে এবং আল্লাহ্কে অধিক স্মরণ করে, তাদের জন্যে রাসুলুল্লাহ (সল্লাল্লাহু আলাইহি সাল্লাম) এর মধ্যে উত্তম নমুনা রয়েছে। (৩৩. আহযাবঃ ২১)
উপরোল্লিতি আয়াত গুলির আলোকে আমরা বুঝতে পারি আংশিক ভাবে কুরআনকে বিশ্বাস করার এবং সে হিসাবে মান্য করার সুযোগ নেই। আমাদের জীবনের প্রত্যেকটি বিভাগের সকল কাজ কুরআন অনুযায়ী ফায়সালা করা বাধ্যতামূলক। রাসুলুল্লাহ (সল্লাল্লাহু আলাইহি সাল্লাম) আমাদের আদর্শ নেতা হওয়াতে ব্যক্তিগত কাজ থেকে শুরু করে, রাষ্ট্র পরিচালনা সহ অন্যান্য সকল কাজ তিনি যেভাবে করে দেখিয়েছেন ঠিক সেভাবে অনুসরণ করতে হবে।
কাজেই একজন ঈমানদারকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে কুরআনের আলোকে তাঁর চলার পথটি কেমন হবে। সার্বিকভাবে ইসলাম প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কাজ করতে চাইলে জনগণের সমর্থন নিয়ে সরকার গঠনের জন্য রাজনীতিই হচ্ছে নিয়মতান্ত্রিক পথ। কাজেই ইচ্ছায় হোক বা অনিচ্ছায় একজন মুসলমানকে ইসলামী রাজনীতির সাথে কোন না কোন ভাবে সম্পৃক্ত থাকতেই হবে। শুধুমাত্র সমর্থন দেয়াও রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত হওয়ার সামিল। একজন মুসলমান ইসলাম প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে ইসলামী রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত না হয়ে যদি গায়ের ইসলামী রাজনীতির সাথে সক্রিয় থাকেন অথবা উনি কোনটিই না করেন তাহলে সে ক্ষেত্রে তাঁর গৃহীত সিদ্ধান্ত ইসলামের পক্ষে যাবে নাকি বিপক্ষে তা সহজেই অনুমেয়। ইসলাম বিরোধী শক্তির সাথে থাকা অথবা কুরআনের আইন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে নিষ্ক্রীয় থাকা আল্লাহর নির্দেশের পরিপন্থী উপরোল্লিখিত আয়াতে তা স্পষ্ট করে বলা হয়েছে। ইসলাম বিরোধী তারাই, যাদের কর্মপন্থায় ইসলাম তথা আল্লাহ্র আইন প্রতিষ্ঠার কোন কর্মসুচী নেই।
ইসলামী রাজনীতিতে অমুসলিমরা কি কোন ভূমিকা রাখতে পারবে?
আল্লাহ্র আইন প্রতিষ্ঠিত হলে অমুসলিমগণ বিপদে পড়বে মর্মে পরিকল্পিত ভাবে এক ভয়াবহ অবস্থার চিত্র প্রকাশ করা হয়ে থাকে। সাথে সাথে এও প্রচার করা হয় আল্লাহ্র আইন মানেই অমুসলিমদেরকে ঈমান আনতে বাধ্য করা, প্রয়োজনে অস্ত্রের সাহয্য নেয়া। মহান আল্লাহ্ তাঁর দ্বীন m¤^‡Ü বলেন -
দ্বীন সম্পর্কে জোর-জবরদস্তি নেই; ... (২.বাকারাঃ ২৫৬)।
তোমরা তাদেরকে মন্দ বলোনা, যাদের তারা আরাধনা করে আল্লাহ্কে ছেড়ে।... (৬. আনআমঃ ১০৮)
তোমাদের দ্বীন তোমাদের জন্য, আমার দ্বীন আমার জন্য। (১০৯.কাফিরূনঃ ৬)
আয়াতের আলোকে স্পষ্ট ভাবে বলা যায় জোর করে কাউকে ইসলামে প্রবেশ করানোর কোন সুযোগ নেই। তাছাড়া আল্লাহ ছাড়া অমুসলিমরা অন্য যাদের উপসনা করে তাদেরকে মন্দ না বলার ব্যাপারে আল্লাহ তাগিদ দিয়েছেন। যার যার ধর্ম সে তা পালন করবে। ইসলামী রাজনীতির মাধ্যমে আল্লাহ্র আইন প্রতিষ্ঠিত হলে অমুসলিমদের কোন অসুবিধা হবেনা তাদের ধর্ম পালনে তা স্পষ্ট।
তাছাড়া নিম্নের আয়াতগুলি থেকেও অমুসলিমদের সাথে কিরূপ ব্যবহার করতে হবে তা আমরা জানতে পারি।
তুমি মানুষকে তোমার প্রতিপালকের পথে আহবান কর হিকমাত ও সদুপদেশ দ্বারা এবং তাদের সাথে আলোচনা কর সদ্ভাবে। (১৬. নাহ্লঃ ১২৫)
তোমরা উত্তম পন্থা ব্যতীত কিতাবীদের সাথে বিতর্ক করবেনা, তবে তাদের সাথে করতে পার, যারা তাদের মধ্যে সীমালঙ্ঘনকারী। (২৯.আনকাবুতঃ ৪৬)
ওরা যা বলে তা আমি জানি, তুমি তাদের উপর জবরদস্তিকারী নও; সুতরাং যে আমার শাস্তিকে ভয় করে তাকে উপদেশ দান কর কুরাআনের সাহায্যে। (৫০. কাফঃ ৪৫)
নাগরিক হিসাবে অমুসলিমগণও রাষ্ট্রের সকল সুযোগ-সুবিধা ভোগ করবে। ইসলাম অমুসলিদের সকল প্রকার অধিকার ও মর্যাদা নিশ্চিত করেছে। তাছাড়া মুসলিম ও অমুসলিম নির্বিশেষে সবার সাথে সুন্দর ব্যবহারের কথা স্পষ্ট ভাবে কুরআন ও হাদীসে ঊল্লেখ করা হয়েছে। যদি কোন লোক দুস্কৃতিকারী হয় তাহলে তাকে রাষ্ট্রীয় আইনে শাস্তি পেতে হবে, সে যে ধর্মেরই অনুসারী হোক না কেন। এমনকি অনৈসলামিক রাষ্ট্রের জন্যেও একই নিয়ম।
ধর্ম বিশ্বাস অন্তরে লালন ও ধর্মাচার পালন করার জন্য ইসলাম অন্য ধর্মের উপর বিন্দুমাত্র প্রভাব খাটাবেনা। রাষ্ট্রের আইন-শৃঙ্খলা ভঙ্গ করলে রাষ্ট্রে যে বিধান চালু থাকবে সেটা সকলকে মানতে হবে এটাই ¯^vfvweK| তবে তা যদি কোন ধর্মের ধমীঁয় মূল্যবোধের সাথে সাংঘর্ষিক হয় তাহলে অবশ্যই গুরুত্ব সহকারে তা বিবেচনা করতে হবে। দেশের শান্তি-শৃঙ্খলা বিনষ্ট হোক, দুর্নীতি, সুদ-ঘুষ, রাহাজানি, ছিনতাই, মাদকাশক্তি, ব্যাভিচার, হত্যা, লুন্ঠন সহ সকল প্রকার মানবতা বিরোধী কর্ম-কান্ড সমাজে চালু থাকা যেমন ইসলামের আইনে অপরাধ ঠিক তেমনিভাবে অন্যান্য ধর্মের আইনেও একই অপরাধ।
অমুসলিমগণ যেখানে ইসলামী সমাজে নিজেদের ধর্মীয় মূল্যবোধ রক্ষা করার নিশ্চয়তা পাচ্ছে সেখানে সকল প্রকার মানবতা বিরোধী কাজের অবসানের লক্ষ্যে ইসলামী রাজনীতিতে অংশ গ্রহণ করার সুযোগও তাদের আছে। কিন্তু এমন একটা আবহ সৃষ্টি করে রাখা হয়েছে যে তাদের জন্য ইসলামী রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত হওয়ার বিষয়েটা রীতিমতো দুরুহ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। ধর্মীয় মূল্যবোধে বিশ্বাসী মুসলিম রাজনীতিকরাও অমুসলিমদেরকে আস্থায় আনতে না পারার দায়টা এড়াতে পারবেননা ।
পরিশেষে বলতে চাই কেউ যদি জেনে-বুঝে কুরআন ও সুন্নাহ্র বিরোধীতা করতে চায় তাহলে সেটা ভিন্ন কথা। কিন্তু যারা আল্লাহ্র হুকুম জীবনের সর্বক্ষেত্রে মানতে চায় তাদেরকে নিজেদের স্বার্থেই ইসলামের পূর্ণাঙ্গ রূপটাকে ধারণ করতে হবে। ইসলামে ধর্মনীতি, সমাজনীতি, অর্থনীতি, রাজনীতি সহ মানুষের জীবনের সর্ব বিষয়ে দিক নির্দেশনা রয়েছে। তাই ইসলামের নীতিমালা থেকে মানুষকে সঠিক পথে পরিচালিত করতে না পারলেও অন্ততঃপক্ষে অসত্য তথ্য দিয়ে বিভ্রান্ত করা উচিত নয়। আশা করি উপরের আলোচনা থেকে আমরা বলতে পারব ইসলামে রাজনীতি করার ব্যাপারে যথেষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। আমাদের প্রিয় রাসুল মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) রাজনীতি করে উদাহারণও রেখে গেছেন আমাদের মাঝে। কুরআনের মাধ্যমে নির্দেশাবলী নাযিল করা হয়েছে মান্য করার জন্যই । যারা কুরআনের উপর দৃঢ় বিশ্বাস রাখে তারা অবশ্যই কুরআনের আয়াত গুলিকে সামনে রেখেই চলার চেষ্টা করবে।
মানুষ পৃথিবীতে আসার পর থেকেই সত্য ও মিথ্যার মধ্যে দ্বন্দ্ব লেগেই আছে। সত্য ও মিথ্যার মধ্যে পার্থক্য বুঝার জন্য আল্লাহ্ সুবহানো তায়ালা আমাদেরকে কুরাআন দান করেছেন। পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান হিসাবে তিনি আমাদেরকে দিয়েছেন দ্বীন ইসলাম। আমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন সৃষ্টির সেরা জীব হিসাবে। দান করেছেন বিবেক বুদ্ধির ন্যায় অমূল্য সম্পদ। কাজেই বিবেক আর বুদ্ধি দিয়েই বিচার করতে হবে কোনটি আল্লাহ্কে খুশী করার ও আমাদের শান্তির পথ। বিতর্কের মানসিকতা নিয়ে নয় বরং সত্যকে উপলব্ধি করার দৃঢ় প্রতিজ্ঞা নিয়ে এগিযে যেতে হবে সেই পথে।
লেখকঃ আব্দুল মান্নান
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন