রবিবার, ১ মে, ২০১১

রেনেসাঁর কবি ইকবাল

পাঠক !আপনারা পাকিস্তানের বিখ্যাত কবি ইকবাল লাহোরীর নাম নিশ্চয়ই শুনে থাকবেন। আল্লামা ইকবাল উর্দু,ফার্সি বিচিত্র ভাষায় কবিতা লিখেছেন। তো এ আসরে আমরা কবি ইকবাল,তাঁর কবিতা বা লেখালেখি এবং তাঁর দর্শনের সাথে আপনাদেরকে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করবো। সেইসাথে ইকবাল এবং ইরানের ইসলামী দর্শন,ইকবাল এবং মুসলিম বিশ্বের ঐক্য প্রভৃতি বিষয়েও কথা বলার চেষ্টা করবো। আশা করি আপনাদের ভালো লাগবে।
এখনো ঘাসের পরে দেখি না বন্ধু কোনো
আমিই বসন্তের প্রথম পুষ্প যেন
পানপাত্রে তাকালে দেখি শুধু নিজেকেই
এ ভাবনায় যদি অন্য কাউকে পেয়ে যাই
জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে যে তুলি নির্দ্ধিধায়
লিখেছে সে এক বার্তা এ জীবনের রঙীন পাতায়

কবি ইকবাল লাহোরী ১৮৭৭ খ্রিষ্টাব্দের ৯ ই নভেম্বরে পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের শিয়ালকোটে জন্মগ্রহণ করেন। ইরানের বিখ্যাত গবেষক প্রফেসর ফারিদানীর মতে বহু যুগ পরে ইকবাল ভারতীয় মুসলমানদেরকে অলস-নিদ্রা থেকে জাগাতে সক্ষম হয়েছেন। ইকবালের বাবা নূর মোহাম্মাদ ব্যবসায়ী ছিলেন। তিনি জ্ঞানী-গুণীদের আসরে বা আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্বদের সাথে আলাপ-আলোচনা করতে ভালোবাসতেন। তাঁর কর্মক্ষেত্র একটা শিক্ষাকেন্দ্রে পরিনত হয়েছিল। ইসলামের বিভিন্ন বিষয়ের প্রতি যাদের অনুরাগ ছিল তাদের অনেকেই সেখানে সমবেত হতেন এবং বিভিন্ন বিষয়ে মতবিনিময় করতেন। তিনি পবিত্র চরিত্রের অধিকারী ছিলেন এবং কোরআন তেলাওয়াতকে দুনিয়া ও আখেরাতের কল্যাণের উপায় বলে মনে করতেন। তিনি তাঁর ছেলে ইকবালকে উপদেশ দিয়ে বলতেন যে,কোরআন এমনভাবে পড়ো যেন আল্লাহর সাথে কথা বলছো।

ইকবালের মাও ছিলেন একজন পুণ্যবতী এবং দ্বীনদার রমনী। এ ধরনের একটি পরিবারে কবি ইকবাল লালিত পালিত হন,বেড়ে ওঠেন। ফলে তাকওয়ার শিক্ষা এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের শিক্ষা তিনি নিজ পরিবারেই লাভ করেন। একেবারে ছোটবেলা থেকেই তিনি তাঁর পারিবারিক পরিবেশে ইরানী বিখ্যাত মরমী কবি সানাঈ, আত্তার, ইরাকী, জামি, হাফেজ, মৌলাভি এবং সাদি'র কবিতার সাথে পরিচিত হবার সুযোগ পান। শৈশবকালীন বা প্রাথমিক শিক্ষা তিনি তাঁর জন্মস্থান পাঞ্জাবের শিয়ালকোটেই অর্জন করেন। সেখানেই তিনি কোরআন শেখেন,পড়তেও শেখেন,লিখতেও শেখেন। পড়ালেখার প্রাথমিক এবং মাধ্যমিকের প্রথম পর্ব শেষ করেই তিনি শিয়ালকোটের স্কট্স মিশন কলেজে ভর্তি হন। এই কলেজে তিনি প্রচলিত জ্ঞানার্জনের পাশাপাশি,ফার্সি এবং আরবি ভাষাও শেখেন।

শামসুল উলামা নামে খ্যাত মৌলভি সাইয়্যেদ হাসানের কাছে তিনি ফার্সি এবং আরবি ভাষা ছাড়াও উর্দু সাহিত্য সম্পর্কে ভালো জ্ঞান অর্জন করেন। শামসুল উলামা ছিলেন তাঁর বাবার বন্ধু। তাঁর সাহচর্যে ইকবাল কবিতা সম্পর্কে এতোই ভালো ধারণা অর্জন করেন যে মাত্র ১৯/২০ বছর বয়সেই তিনি কবিতা লিখতে শুরু করেন। তাঁর সেই যুবক বয়সের কবিতাও অগ্রজ উর্দু কবি সাহিত্যিকদের কাছে ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা পায়। তাঁরা ইকবালের কবিতার প্রশংসা করেন।
ইকবালের চিন্তা-চেতনা ছিল ব্যবসায়িক চিন্তার অনেক উর্ধ্বে। তাই তিনি বাবার ব্যবসায়িক উত্তরাধিকার না হয়ে চলে গেলেন লাহোরে,শিক্ষাজীবন চালিয়ে যেতে। প্রফেসর ফারিদানীর মতে-‘তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে ভারতীয় মুসলমানদের জন্যে তাঁর ওপর এমন এক গুরুদায়িত্ব অর্পন করা হয়েছে যে,তাঁর উচিত ঐ দায়িত্ব সাফল্যের সাথে পালন করা।' তিনি শিয়ালকোটকে এই কাজের জন্যে ক্ষুদ্র মনে করলেন,তাই লাহোরে চলে গেলেন এবং সেখানকার সরকারী কলেজে দর্শন শাস্ত্রে এম.এ. অর্জনের কাজে আত্মনিয়োগ করলেন।

ইসলাম গবেষক প্রফেসর টমাস আর্নল্ডের কাছে তিনি এবার শিক্ষা লাভের উদ্দেশ্যে গেলেন। দর্শনের ব্যাপারে কবি ইকবালের সৃষ্টিশীলতা,প্রেম এবং চিন্তার উৎকর্ষ এতো গভীর ছিল যে, স্বয়ং তাঁর শিক্ষক আর্নল্ড এক সময় বলেছিলেন-‘এই ছাত্র, শিক্ষককে গবেষক এবং গবেষককে মহাপণ্ডিত বানিয়ে ছাড়বে।' ১৯০৫ সালে ইকবাল ইংল্যান্ডে যান এবং কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া চালিয়ে যান। সেখানে ইরান বিশেষজ্ঞ দুই জন মধ্যপ্রাচ্যবিদের সাথে তাঁর পরিচয় হয়। একজন হলেন এডওয়ার্ড ব্রাউন এবং অপরজন হলেন নিকলসন। এই দুই শিক্ষকের সাথে উঠাবসার সুবাদে ফার্সি সাহিত্য সম্পর্কে তাঁর ভালো একটা ধারণা জন্মে। ফার্সি কবিতা পাঠের জন্যেও তাঁর কণ্ঠ পরিপক্ক হয় এবং সম্ভবত এ সময়টাতেই তিনি তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি বা চিন্তাচেতনা প্রকাশের জন্যে ফার্সি ভাষায় কবিতা লেখার প্রেরণা পান। যাই হোক, ইকবাল এখানে দর্শন এবং আইনশাস্ত্রে পড়ালেখা শেষ করে দর্শনের ওপর পড়ালেখা চূড়ান্তভাবে শেষ করার জন্যে জার্মানীতে যান।
ইউরোপে কয়েক বছর কাটানোর ফলে ইকবাল প্লেটো থেকে বার্গ সঁ পর্যন্ত বিভিন্ন দার্শনিকের চিন্তা ও কর্মের সাথে পরিচিত হন। তবে পাশ্চাত্য দর্শন তাঁকে তুষ্ট করতে পারে নি। কেননা পাশ্চাত্য দর্শনে তিনি সমাধান-অযোগ্য বহু বিষয় দেখতে পেয়েছেন। এ সময় তিনি পাশ্চাত্যের দার্শনিক মতবাদগুলো নিয়ে পর্যালোচনা করেন এবং তাঁর নিজস্ব চিন্তাদর্শ অর্থাৎ ইসলামী আদর্শকে জ্ঞান-বিজ্ঞানের নতুন নতুন অগ্রগতি বা দর্শনের দৃষ্টিকোণ থেকে যাচাই করার সুযোগ পান। এই প্রচেষ্টারই সোনালী ফসল হলো "দ্য ডেভেলপমেন্ট অব মেটাফিজিক্স ইন পারসিয়া" বা পারস্যে অধিবিদ্যার উন্নয়ন নামক গ্রন্থটি। এটি ছিল তাঁর একটি গবেষণাপত্র। এই গবেষণাপত্র বা থিসিসটি তিনি জমা দিয়েছিলেন মিউনিখ ইউনিভার্সিটিতে। ঐ ইউনিভার্সিটি তাঁকে এই থিসিসের জন্যে দর্শনে ডক্টরেট ডিগ্রি দিয়েছিল। থিসিসটি প্রকাশিত হয় লন্ডনে। সেই থেকে ইকবাল ইউরোপীয় সাহিত্যিক , রাজনীতিক এবং বুদ্ধিজীবী মহলে প্রাচ্যের একজন দার্শনিক হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিলেন।
ইকবাল তাঁর এই থিসিস বা অভিসন্দর্ভটি তৈরী করার প্রয়োজনে বহু ফার্সি বই তাঁকে পড়তে হয়েছে। বিশেষ করে আধ্যাত্মিকতা,দর্শন,নীতি-নৈতিকতা প্রভৃতি বিষয়ে তিনি ফার্সি অনেক বই পড়েছেন। আর এসব বই পড়ার কারণে স্বাভাবিকভাবেই ফার্সি ভাষার সাথে তাঁর পরিচয়টা নিবীড় হয়েছে। এরপর তিনি ফার্সি ভাষার বই-পুস্তক প্রায় নিয়মিতই পড়তেন। এই পড়ালেখা বা পরিচিতির প্রভাবে যা হয়েছে তাহলো,তাঁর আধ্যাত্মিকতা বা দার্শনিক চিন্তা প্রকাশের জন্যে ফার্সি ভাষাটা উপযোগী হয়ে উঠেছিল। এ জন্যেই লক্ষ্য করা গেছে যে,কবি ইকবাল তাঁর বহু বই ফার্সি ভাষায় লিখেছেন।

লন্ডন ইউনিভার্সিটিতে লেখাপড়া এবং আরবি ভাষার শিক্ষক হিসেবে কাজ করার পর কবি ইকবাল লাহোরে ফিরে যান এবং লাহোর কলেজে দর্শনের শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। কিন্তু কিছুদিন পর অর্থাৎ ১৯১১ সালে শিক্ষকতা ছেড়ে আইন পেশায় আত্মনিয়োগ করেন। এ সময় তিনি যেমন প্রচুর লেখালেখি করেন,তেমনি প্রচুর পড়াশোনাও করেন। মামলা সংক্রান্ত ফাইলপত্রাদি এবং আইন নিয়েও পড়াশোনা করেন। ফলে বাধ্য হয়েই তাঁর দেশের রাজনৈতিক সমস্যা ও সঙ্কট নিয়ে তাঁকে লড়তে হয়। এভাবে তিনি ভারত ,ইউরোপ এবং আমেরিকায় খ্যাতিমান হয়ে ওঠেন। ১৯২৬ সালে তিনি ভারতীয় পার্লামেন্টে মুসলমান প্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচিত হন।১৯৩০ সালে মুসলিম লীগের বার্ষিক সভার সভাপতিত্ব করেন। সেখানেই একটি স্বাধীন মুসলিম রাষ্ট্রের প্রস্তাব ওঠে। ১৯৩৩ সালে পাঞ্জাব ইউনিভার্সিটি তাঁকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি দেয়। তারপর থেকেই শুরু হয় ইকবাল জবিনের কষ্টকর অধ্যায়। অত্যন্ত সাদামাটা জীবন যাপন করতেন তিনি। ঐ সাদামাটা জীবনযাপনের মধ্য দিয়েই ১৯৩৮ সালে তাঁর জীবনাবসান হয়।
রেনেসাঁর কবি ইকবাল ( ২ )

পাঠক ! সালাম ও শুভেচ্ছা নিন। আশা করি আপনারা ভালো ও সুস্থ আছেন। গত আসরে আমরা অত্যন্ত সংক্ষেপে আল্লামা ইকবালের জন্ম এবং মৃত্যুর ইতিহাস সম্পর্কে বলেছিলাম। আজকের আসরে আমরা তাঁর ফার্সি ভাষায় লেখা মূল্যবান কিছু সাহিত্যের ওপর আলোকপাত করার চেষ্টা করবো। কবি ইকবালের লেখালেখির ওপর আলোচনায় আপনারা সঙ্গ দিতে ভুলবেন না-এ প্রত্যাশায় শুরু করছি রেনেসাঁর কবি ইকবাল শীর্ষক ধারাবাহিক অনুষ্ঠানের আজকের পর্ব।
আল্লামা ইকবাল উর্দুভাষা, ইংরেজি ভাষা এবং ফার্সি ভাষায় প্রচুর লেখালেখি করেছেন। তবে ফার্সি ভাষায় যা লিখেছেন তার সবই কবিতা। আসরার ই খুদি বা ‘দ্য সিক্রেট্স অব দ্য সেল্ফ',রুমুয ই বি খুদি বা ‘দ্য মিস্টেরিয অব সেল্ফলেস্নেস', পায়ামে মাশরিক বা ‘ম্যাসেইজ ফ্রম দ্য ঈস্ট',যাবুর ই আজাম বা ‘পারসিয়ান সাম্স', পাস চি বয়াদ র্কাদ আয় আকওয়ামে শার্ক বা ‘হোয়াট শুড দেন বি ডানঃও পিপল অব দ্য ঈস্ট' এবং জাভিদ নামা বা ‘টু হিজ সন' ইত্যাদি কবি ইকবালের ফার্সি রচনার অন্তর্ভুক্ত।
উর্দু ভাষাতেও তিনি প্রচুর লিখেছেন। এগুলোর মাঝে কবিতাও আছে , গদ্যও আছে। উল্লেখযোগ্য কয়েকটি রচনার নাম করা যাক। কবিতার মধ্যে রয়েছে বাঙ্গে দারা বা ‘কল অব দ্য মার্চিং বেল',বাল-ই-জিব্রিল বা ‘উইংস অব গ্যাব্রিয়েল',যার্ব-ই-কালিম বা ‘দ্য রড অব মোজেজ' ইত্যাদি। এছাড়াও অর্থবিজ্ঞান , ভারতের ইতিহাসসহ আরো বহু প্রবন্ধ তিনি লিখেছেন।
তাঁর বক্তৃতাও রয়েছে প্রচুর। ইংরেজি ভাষায় লেখা তাঁর শ্রেষ্ঠ কিছু লেখা হলো ডেভেলপমেন্ট অব মেটাফিজিক্স ইন পার্সিয়া , দ্য রিকনস্ট্রাকশন অব রিলিজিয়াস থট ইন ইসলাম। এটি আসলে আল্লামা ইকবালের ৬টি বক্তৃতার সংকলন। মাদ্রাজ,হায়দ্রাবাদ এবং আলীগড়ে তিনি এই বক্তৃতাগুলো দিয়েছিলেন। সংকলনটি প্রথমে প্রকাশিত হয় লাহোরে,তারপর অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে।
বক্তৃতাগুলোর বিষয়বস্তু হলো নলেজ এন্ড রিলিজিয়াস এক্সপেরিয়েন্স, দ্য কনসেপশন অব গড এন্ড দ্য মিনিং অব প্রেয়ার, দ্য হিউম্যান ইগো, প্রিডেস্টিনেশন এন্ড ফ্রি উইল, দ্য স্পিরিট অব মুসলিম কালচার এবং দ্য প্রিন্সিপাল অব মুভমেন্ট ইন ইসলাম।এছাড়া তিনি কয়েকটি গবেষণামূলক প্রবন্ধও লিখেছেন। এগুলোর মধ্যে ‘ইসলামী খিলাফত' এবং ‘ইসলামী সমাজের প্রতি দৃষ্টি' উল্লেখযোগ্য। ডেভেলপমেন্ট অব মেটাফিজিক্স ইন পার্সিয়া ইকবালের গুরুত্বপূর্ণ রচনাগুলোর একটি। ১৯০৫ সাল থেকে ১৯০৮ পর্যন্ত সময়কালে ইকবাল লন্ডনে পড়ালেখা নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। সে সময় তিনি তাঁর থিসিস বা গবেষণার মূল উপাত্ত অন্বেষনের কাজে ব্যস্ত ছিলেন। তাঁর শিক্ষক এবং বন্ধু ডক্টর আর.এ.নিকলসন ইকবালকে তখন পরামর্শ দিয়েছিলেন তিনি যেন আব্দুল করিম জিলির লেখা আল-ইনসানুল কামেল ফি মারেফাতুল আওয়াখের ওয়াল আওয়ায়েল গ্রন্থটি পড়েন। তাঁর পরামর্শে ইকবাল বইটি পড়েন। বইটি পড়ার পর ইকবাল আব্দুল করিম জিলির ওপর পূর্ণাঙ্গ একটি প্রবন্ধ লেখেন। তাঁর ঐ লেখাটিই থিসিস হিসেবে পরিগণিত হয় এবং এই থিসিসটির ওপর ভিত্তি করেই তাঁকে ডক্টরেট দেওয়া হয়। মূল লেখাটি ১৯০৮ সালে লন্ডনে ছাপা হয়। তারপর উর্দু,ফরাশি এবং ফার্সি ভাষায় অনূদিত হয়।
ইকবালের ভাষ্য অনুযায়ী এই গ্রন্থটি রচনার উদ্দেশ্য ছিল ইরানী দর্শনের ইতিহাসের মৌলিকত্ব তুলে ধরা। এই গ্রন্থে ইকবাল কেবল প্রাচীন ইতিহাসই বর্ণনা করেন নি,বরং তিনি গবেষকদের চিন্তাজগতে নতুন একটি ধারার প্রবর্তন করতে চেষ্টা করেছেন । ডক্টর ফারিদানীর মতে "ইকবাল তাঁর এই বইতে ইরানী মুসলমান চিন্তাবিদদের চিন্তাজগতে প্রবেশ করতে চেষ্টা করেছেন এবং সেগুলোকে নতুন দশর্শনের ভাষায় বর্ণনা করতে চেয়েছেন। তিনি সুফিবাদ বা মরমীবাদকে নতুন বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা করেছেন। এই বইতে তিনি মরমীবাদকে একটা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি বলে উল্লেখ করেছেন এবং জীবনের উন্নত লক্ষ্যগুলো অর্জনের জন্যে ব্যক্তি বা সমাজের জাগৃতির উপায়গুলো প্রদর্শন করেছেন।"

আসরারে খুদি বা দ্য সিক্রেটস অব দ্য সেলফ জলো ফার্সি ভাষায় লেখা ইকবালের প্রথম গ্রন্থ। আল্লাহকে চেনা এবং নিজেকে চেনাই এই গ্রন্থের মূল উপজীব্য। ইকবাল অত্যন্ত সাফল্যের সাথে রাজনৈতিক-সামাজিক এবং দার্শনিক নতুন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে নিজেকে এবং আল্লাহকে চেনার উপায়গুলো ব্যাখ্যা করতে পেরেছেন। ইকবাল সাহিত্যের সমালোচকগণ মনে করেন তিনি এই গ্রন্থে তাঁর ব্যক্তিগত আকিদা-বিশ্বাসকেই তুলে ধরেছেন। ইকবালের দৃষ্টিতে সৃষ্টির মূলে আছে খুদি বা আমিত্ববোধ। আর এই বোধ সবার মঝেই রয়েছে।
আমার কবিতা বেপরোয়া আঘাতের সুর
আমি কবিকণ্ঠ এক অনাগত আগামীর
আমার সুরধ্বনি অন্য এক পৃথিবীর
এই ধ্বনি ভিন্ন আরেক কাফেলার
ইকবালের মতে এই আমিত্ব চেতনা যখন প্রেমের সাথে মিশ্রিত হয় তখন বিশাল এক শক্তি অর্জিত হয়। এই আমিত্ব একটা সময় আল্লাহর সান্নিধ্যে পৌঁছে যেতে পারে। এই খুদিই ইসলামের আশ্রয় নিয়ে হযরত মুহাম্মাদ ( সা ) এর বিধানের অনুসরণ করাতে পারে এবং ইসলাম যা করতে নিষেধ করেছে তা থেকে দূরে রাখতে পারে। ইকবালের মতে এরকম অবস্থাতেই মানুষ আল্লাহর খলিফার মর্যাদায় উন্নীত হতে পারে।
‘আসরারে খুদি'র ভূমিকায় কবি ইকবাল উর্দু ভাষায় লিখেছেন, প্রাচ্যবাসীরা তাদের ব্যক্তিত্ব হারিয়ে ফেলেছে,তারা তাদের আমিত্ব কে ভুলে গেছে,যার পরিণতিতে তারা এখন পাশ্চাত্যের অনুসারী হয়ে পড়েছে। কিন্তু ইসলামের অনুসারী যারা তাদের উচিত তাদের ভেতরকার আমিত্ব শক্তিকে জাগিয়ে তোলা এবং তকদিরের ওপর সবকিছু ছেড়ে না দিয়ে কর্মতৎপর হওয়া। ইকবালের আসরারে খুদি কাব্য গ্রন্থটি ডক্টর নিকলসন ইংরেজি ভাষায় অনুবাদ করেছেন। ১৯২০ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর অনূদিত গ্রন্থটি লন্ডনে প্রকাশিত হয়। তারপর আরবি ভাষা, মালয় ভাষা, সিন্ধি ভাষা এবং উর্দু ভাষায় অনূদিত ও প্রকাশিত হয়।
আসরারে খুদি প্রকাশিত হবার পর ইকবাল ‘রমুযে বিখুদি' বা ‘দ্য মিস্টেরিয অব সেল্ফলেস্নেস' নামে আরেকটি বই লিখে তাঁর খুদি চিন্তাকে পরিপূর্ণতা দেন। এই গ্রন্থে তিনি ব্যক্তির সাথে সমষ্টির সম্পর্কের ব্যাপারে কথা বলেন এবং সমাজ ও জাতির মাঝে ব্যক্তির বিলীন হওয়া,মুসলিম সম্প্রদায়কে উম্মাতে মুহাম্মাদির সাথে একাত্ম হওয়ার উপায়গুলো বর্ণনা করেন।
‘পায়ামে মাশরেক' বা ম্যাসেইজ ফ্রম দ্য ঈস্ট গ্রন্তটিও ফার্সি ভাষায় লেখা। এই গ্রন্থটি তিনি জার্মানির বিখ্যাত কবি গ্যাটের দিভান অক্সিডেন্টালের জবাবে লিখেছেন।
১৯২৩ খ্রিষ্টাব্দে উর্দু ভাষায় লেখা ভূমিকাসহ এটি প্রকাশিত হয়। ১৪ পৃষ্ঠার দীর্ঘ ভূমিকায় তিনি গ্যাটের কাব্য সমালোচনা করেন এবং গ্যাটের ওপর ইরানী কবি হাফিজের প্রভাবের কথা বলেন। জার্মান কবিদের ওপর ইরানী কবিদের প্রভাব সম্পর্কে বলেন-‘ফার্সি সাহিত্য থেকে ব্যবহার করা জার্মানীর সাহিত্যিকদের একটা প্রাচীন প্রবণতা। আর জার্মান ভাষায় ইরানী সাহিত্যের অনুবাদ বহু আগে থেকেই শুরু হয়েছে।'
যাই হোক,ম্যাসেইজ ফ্রম দ্য ঈস্ট বা পায়ামে মাশরেক গ্রন্থটি আরবি, তুর্কি এবং উর্দুতেও অনূদিত হয়েছে। এছাড়া প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্যের অন্যান্য ভাষাতেও ইকবালের এই গ্রন্থটির ওপর কমবেশি লেখালেখি হয়েছে এবং অনুবাদও হয়েছে। কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটির প্রফেসর এ.জে.আরবেরিও এই গ্রন্থের ললে তুর নামক অধ্যায়টি সিনাই অব টিউলিপ নামে ইংরেজি ভাষায় অনুবাদ করেছেন। জার্মানীর প্রাচ্যবিদ হ্যান্সি ম্যাঙ্গিও ইকবালের জীবদ্দশাতেই এই গ্রন্থটির অংশবিশেষ জার্মান ভাষায় অনুবাদ করেছিলেন।
রেনেসাঁর কবি ইকবাল ( ৩)
পাঠক ! গত আসরে আমরা আল্লামা ইকবালের সৃষ্টিকর্ম সম্পর্কে আলোচনা শুরু করেছিলাম। অন্তত তাঁর লেখাগুলোর সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলাম। আজকের আসরে তারি ধারাবাহিকতায় কবি ইকবালের কালজয়ী রচনা নিয়ে কথা বলার চেষ্টা করবো। আপনারা যথারীতি আমাদের সাথেই থাকছেন-এ প্রত্যাশা রইলো।
যাবুরই আজাম (পার্সিয়ান সাম্স) কবি ইকবাল লাহোরির অপর একটি কাব্য গ্রন্থ। যাবুর একটি ঐশী গ্রন্থের নাম। বনী ইসরাইলীদের নবী হযরত দাউদ ( আ ) এর ওপর এই আসমানী কিতাবটি নাযিল হয়েছিল। হযরত দাউদ (আ) খুব সুন্দর কণ্ঠে এই গ্রন্থটি পাঠ করতেন। ইকবাল তাঁর একটি ফার্সি কাব্য গ্রন্থের নাম রেখেছেন যাবুরই আজাম। ১৯২৭ খ্রিষ্টাব্দে লাহোরে প্রথমবারের মতো বইটি ছাপা হয়। এতে গযল, টুকরো কবিতা এবং দুই পংক্তি বিশিষ্ট কবিতা বা মাসনাবি রয়েছে। একটি হলো গুলশানে রযে জাদিদ বা নতুন রহস্যের পুষ্পোদ্যান এবং বান্দেগি নমেহ বা ইবাদাতনামা। ইকবাল শেখ মাহমুদ শাবেস্তারী এবং তার মূল্যবান সাহিত্যকর্ম গুলশানে রয এর সাথে খুব ভালোভাবে পরিচিত ছিলেন। এটিকে তাঁরই নতুন রহস্যের পুষ্পোদ্যান বলে মনে করা যেতে পারে,কেননা ইকবাল শাবেস্তারির গুলশানে রযের স্টাইলেই গুলশানে রযে জাদিদ লিখেছেন। প্রশ্নোত্তরের রীতিতে এটি লেখা হয়েছে।
বান্দেগি নমেহ ইকবালের যাবুরে আজামের দ্বিতীয় অধ্যায়। বান্দেগি নমেহ'তে কবি ইকবাল প্রাঞ্জল ফার্সি ভাষায় লেখা কবিতায় সৃষ্টিশীলতা, শিল্প,মিউজিক,কবিতা,ভাস্কর্য এবং মজলুম জাতিগুলোর সাহিত্যের ব্যাখ্যা এবং সমালোচনা দক্ষতার সাথে তুলে ধরেছেন। তবে বান্দেগি নমেহ্'তে ইকবালের সার্থকতা হলো তিনি কেবল দুঃখ-দুর্দশার বর্ণনা দিয়ে বা চিত্র এঁকেই ক্ষান্ত হন নি,বরং তিনি ঔপনিবেশিকতার জাল ছিন্ন করার উপায় বা পন্থাটাও পাঠক-শ্রোতাদের দেখিয়ে দিয়েছেন।

মাসনাবির পর আসরারে খুদি ওয়া রমুযে বি খুদি এবং জভিদ নমেহ হলো ইকবাল লাহোরির উল্লেখযোগ্য ফার্সি রচনা। ইকবাল তাঁর জভিদনামায় মৌলাভির মাসনাবির প্রভাবে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত। এ বইতে তিনি নিজেকে যেন্দে রুদ বা জীবন্ত নদী বলে অভিহিত করেছেন। জভিদ নমে হলো কাল্পনিক এক সফরের ব্যাখ্যা। এ গ্রন্থে তিনি তাঁর পীর-মুর্শিদ মৌলাভির সাথে সকল আসমান,বেহেশত এবং দোযখ সফর করেন এবং কালজয়ী কিছু ব্যক্তিত্বের সাথে কথাবার্তা বলেন। ইরানের বিখ্যাত অভিধান প্রণেতা মরহুম ডক্টর মোহাম্মাদ মঈন ইকবালের জভিদ নমেহ সম্পর্কে বলেছেনঃ ইকবাল এই সফরে সানাঈ গাযনাভি,আবুল আলা মোয়াররী, মহিউদ্দিন ইবনে আরবি এবং ইতালীর দান্তের মতো বিখ্যাত কবি ও দার্শনিকদের মতোই নিজস্ব সৃষ্টিশীল শক্তিমত্তা দিয়ে কাব্যিক মেরাজে গেছেন এবং নিজস্ব মেরাজনামা বা উর্ধ্বারোহনের কাহিনীকে জভিদনমে নাম দিয়েছেন। আধ্যাত্মিক এই সফরে ইকবালের পথপ্রদর্শক এবং মানসিক রাজপথে ছিলেন ইরানের বিখ্যাত মরমী কবি মাওলানা জালালুদ্দিন মোহাম্মাদ বালখিয়ে রুমি।
ইকবাল সমগ্র জীবনব্যাপী যেই লক্ষ্য এবং চিন্তাকে সামনে রেখে কাজ করেছেন তাহলো,জাতির শত্র"র বিরুদ্ধে সংগ্রাম। যেসব শত্র" ভারত ভূখণ্ডকে বিদেশীদের হাতে সোপর্দ করেছে এবং মুসলমানদের ওপর তাদের আনুগত্য চাপিয়ে দিয়েছে,সেইসব শত্র"র বিরুদ্ধেই ছিল ইকবালের সংগ্রাম। ইকবাল ভারতীয় মুসলমানদের মুক্তির জন্যে একজন দূরদর্শী নেতার খোঁজে ছিলেন। এ বিষয়টি লক্ষ্য করা গেছে তাঁর মুসাফির এবং ‘তাহলে কী করা উচিত হে প্রাচ্যবাসী' তে। পশ্চিমা বিশ্বের ধর্মহীন বস্তুতান্ত্রিকতাও তাঁকে ভীষণ কষ্ট দিতো।
ইকবাল লাহোরীর প্রথম উর্দু কবিতার বই হলো বঙ্গ্-ই-দারা। ১৯২৮ খ্রিষ্টাব্দে লাহোরে এটি মুদ্রিত হয়। বঙ্গে দারা হলো ঘণ্টাধ্বনি। যেই ঘণ্টাধ্বনি উটের পায়ে বাঁধা হয় যাতে উটের পদক্ষেপ বোঝা যায়। এই শব্দ একদিকে উটের অস্তিত্বের ঘোষণা দেয় অপরদিকে জনগণকে জাগ্রত রাখে। ইকবাল এই গুণগুলোর কথা কবিতায় উল্লেখ করেছেন। বঙ্গে দারা ইকবালের কবিকর্মের প্রাথমিক দিককার রচনা। তরুণ বয়সে তিনি এসব কবিতা লিখেছিলেন এবং আঞ্জুমানে হেমায়েতে ইসলামে পড়েছিলেন। এই বইতে জাতীয় চেতনাই বেশি গুরুত্ব পেয়েছে।
'বলে জিব্রাইল' বা জিব্রাঈলের ডানা গ্রন্থটিও উর্দুতে লেখা। এটি তাঁর দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ। ১৯৩৫ সালে এই গ্রন্থটি ছাপা হয় লাহোরে। এই গ্রন্থটি দুটি অধ্যায়ে বিভক্ত। প্রথম অধ্যায়ে রয়েছে গযল এবং দু'লাইনের কবিতা। আর দ্বিতীয় অধ্যায়ে রয়েছে,বিচিত্র কাব্যকাহিনী। এইসব কাব্যকাহিনীর বিষয়বস্তুর মধ্যে রয়েছে সাসকিনামা এবং কর্ডোভা মসজিদসহ স্পেনে তিনি যেসব মুসলিম ঐতিহাসিক নিদর্শন দেখেছেন সেগুলোর বর্ণনা। বলে জিব্রাঈল হলো উর্র্দু ভাষায় ইকবালের কবি মানস বিকাশের মাধ্যম। ইকবাল এই গ্রন্থে চমৎকার সব গযল লিখেছেন। সেইসাথে মুমিনের গুণাবলী এবং ইসলামের সঠিক পরিচিতি,ইনসানে কামেল এবং মুসলমানদেরকে ইসলামী বিধি-বিধান দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে থাকার কথা প্রাঞ্জল ভঙ্গি ও ভাষায় ফুটিয়ে তুলেছেন।
যারবে কালিম ( দ্য রড অব মোজেজ ) উর্দু ভাষায় লেখা তাঁর অপর একটি গ্রন্থ। ১৯৩৬ সালে লাহোরে বইটি প্রকাশিত হয়। এই গ্রন্থে তিনি ইসলাম এবং মুসলমান, শিক্ষা-দীক্ষা, নারী, সুকুমার শিল্প ও সাহিত্য, প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্য ইত্যাদি বিষয় স্থান পেয়েছে। বইটির নামকরণ করেছেন কোরআনের একটি আয়াত অনুসরণে। আয়াতটি হলো ‘অকুল্ নাদরেব্ বি আসাকাল হাজার।' এই নামটি নির্বাচন করার উদ্দেশ্য ছিলো,তিনি মনে করতেন তাঁর বক্তব্য মুসলমানদের অন্তরের পাথরের ওপর মূসার লাঠির মতোই কাজ করবে এবং ঐ পাথর থেকে পানি পানি ফুটবে। আরমুগানে হেজাজ তাঁর সর্বশেষ গ্রন্থ। এটি তাঁর মৃত্যুর পর ছাপা হয়। এখানেও তিনি ঔপনিবেশিকতা এবং মুসলমানদের মুক্তি নিয়েই ভেবেছেন। কবি বাবা তাহের হামেদানির ছন্দশৈলীকে এ গ্রন্থে কাজে লাগিয়েছেন। দুই পংক্তি বিশিষ্ট কবিতায় মক্কা এবং মদীনা যিয়ারতের ইচ্ছে প্রকাশিত হয়েছে। শয়তানের সংসদ নামের ব্যঙ্গ কবিতাংশ বর্তমান বিশ্বের রাজনীতিবিদদের সমালোচনায় মুখর।
রেনেসাঁর কবি ইকবাল ( ৪ )

পাঠক ! গত আসরে আমরা কবি ইকবালের ওপর অপরাপর কবিদের সাহিত্য ও শৈলীগত প্রভাবের কথা বলেছিলাম। তারই ধারাবাহিকতায় আজো আমরা ত্রয়োদশ শতাব্দীর ফার্সি ভাষার বিখ্যাত কবি আল্লামা ইকবাল লাহোরীর জীবন ও কর্ম নিয়ে আলোচনা করার চেষ্টা করবো। আপনারা যথারীতি আমাদের সঙ্গ দিতে ভুলবেন না-এই প্রত্যাশা রইলো।
ইকবালের মাতৃভাষা ছিলো পাঞ্জাবী। পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা ছিল উর্দু। ফলে দুই ভাষাতেই ছিল তাঁর মাতৃভাষা সুলভ দক্ষতা। অথচ তিনি প্রাথমিক শিক্ষা থেকে শুরু করে উচ্চ শিক্ষা পর্যন্ত ইংরেজি ভাষায় পড়ালেখা করেছেন। ইংরেজি ভাষায় তিনি শিক্ষকতা করেছেন। কিন্তু তিনি তাঁর চিন্তা-চেতনা,তাঁর বক্তব্য,তাঁর সামাজিক-রাজনৈতিক এবং দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশের জন্যে ফার্সি ভাষাকে বেছে নিয়েছেন। বিস্ময়ের ব্যাপার হলো ইকবাল কখনো ইরানে আসেন নি কিংবা কখনো ফার্সি ভাষায় কথা বলেন নি। তবে ফার্সি ভাষার প্রতি তাঁর আগ্রহ বা আকর্ষণ থাকার কারণেই এ ভাষায় তিনি লেখালেখি করেছেন। তাঁর সমকালে অর্থাৎ ত্রয়োদশ শতাব্দীতে ফার্সি ভাষা ছিল উপমহাদেশের মুসলমানদের কথাবার্তা এবং সাহিত্যের অভিন্ন ভাষা। তিনি তাই এ ভাষাতেই তাঁর দার্শনিক,রাজনৈতিক এবং ধর্মীয় চিন্তার প্রকাশ ঘটিয়েছেন। তার কারণ উর্দু ভাষা এই চিন্তা প্রকাশের জন্যে উপযুক্ত ছিল না।
প্রথম প্রথম অবশ্য ইকবালের জন্যে ফার্সি ভাষায় কবিতা লেখাটা একটু কষ্টকরই ছিল। কিন্তু পরে অন্যান্য কবি বন্ধুর উৎসাহে এবং ফার্সি ভাষার প্রতি তাঁর অপরিসীম আগ্রহ ও অনুরক্তির ফলে তিনি সার্থকতা লাভ করেন। তাঁর সমকালে গোলাম কাদের বুলগেরামি জালান্দারীর মতো আরো অনেক পাঞ্জাবী এবং ভারতীয় কবি ফার্সি ভাষায় কবিতা চর্চা করতেন। অল্প সময়ের ব্যবধানে তিনি ফার্সি ভাষায় কবিতা লেখার ক্ষেত্রে অন্যদের চেয়ে অনেক অগ্রসর হয়ে যান এবং সে সময়ের বড়ো একজন কবি হিসেবে খ্যাতিমান হয়ে ওঠেন।
ইকবাল যদিও ফেরদৌসী, হাফেজ, সাদি, মৌলাভি, ইরাকী প্রমুখের কবিতার সাথে ভালোভাবে পরিচিত ছিলেন,তারপরও তাঁর কবিতা সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল। তাঁর কবিতার অন্যতম একটি বৈশিষ্ট্য হলো তিনি পুরোণো কাব্যশৈলীর মধ্যেই নতুন নতুন চিন্তাদর্শনের প্রয়োগ ঘটিয়েছেন কিংবা বলা যায় পুনর্গঠন করেছেন। তিনি তাঁর লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্যে ভারতীয় ফার্সি ভাষীদের এবং ইরানীদের বোধগম্য ও পছন্দের শব্দগুলোই প্রয়োগ করেছেন। ফার্সি কবিতার যেসব ধারা চলমান ছিল যেমন গযল,কাসিদা,রুবাইয়াৎ এবং মাসনাবিÑসকল ধারাতেই তবে কিছুটা স্বতন্ত্র স্টাইলে তিনি কবিতা লিখেছেন। শৈলীগত স্বাতন্ত্র্য যেমন ছিল তেমনি বিষয়বস্তুগত পার্থক্যও ছিল।

ইকবাল তাঁর দার্শনিক চিন্তা,আধ্যাত্মিক চিন্তা,ধর্মীয় চিন্তা ইত্যাদি প্রকাশের ক্ষেত্রে সানাঈ,নিজামী,মৌলাভি,শেখ মাহমুদ শাবেস্তারী প্রমুখের মতো প্রবাদ-প্রবচন এবং কিসসা-কাহিনীর স্টাইলে বর্ণনা করেছেন। কিন্তু প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে তিনি ছন্দের কাঠামো ভেঙ্গেছেন। কাব্য রচনার যে আলঙ্কারিক পদ্ধতি রয়েছে,তা অনেক সময় বাঁধা হাত-পায়ের মতো মনে হয়। তিনি মাঝে মাঝে প্রয়োজনবোধে কাব্যরীতির ঐ আলঙ্কারিক বিধি-বিধানের বন্ধ হাত-পা থেকে বেরিয়ে এসেছেন। এমনকি অনেক সময় তিনি কথার মাঝখানে কাব্যশৈলী পরিবর্তনও করেছেন। জাভিদনামাহ এবং মুসাফির নামক দ্বিপদী কাব্যে ইকবাল প্রয়োজনবোধে দ্বিপদীর স্টাইল পরিবর্তন করে গযলের স্টাইলে লিখেছেন।
কবিতার ক্ষেত্রে ইকবাল যে নতুন চিন্তাধারার প্রবর্তন করেন,তারফলে ভারতীয় মুসলমানদের চিন্তারাজ্যে এক ধরনের বিপ্লবের সূচনা হয়। ইকবাল বিশ্বাস করতেন কবিতা বা শিল্পের অপরাপর মাধ্যমগুলো হওয়া উচিত গঠনমূলক,অর্থবহ এবং উচ্চতর লক্ষ্যাভিমুখী। তিনি তাঁর বন্ধু সাইয়্যেদ সোলায়মান নদভীকে উর্র্দুতে লেখা একটি চিঠিতে স্পষ্টভাবেই বলেছেন,তাঁর কবিতা লেখার উদ্দেশ্য পাণ্ডিত্য প্রকাশ করা নয়। চিঠির একাংশে তিনি লিখেছেন,কবিতার ক্ষেত্রে শব্দমালা, সাহিত্যশৈলী আর কোমল আবেগ চর্চার প্রতি আমার আকর্ষণ কম, আমার লক্ষ্য হলো কেবল চিন্তারাজ্যে বিপ্লব ঘটানো।' কবিতাকে তিনি অর্থোপার্জন বা খ্যাতি অর্জনের মাধ্যমে পরিণত করেন নি। কেননা তিনি বিশ্বাস করতেন কবিরা হলেন মানুষ সৃষ্টির কারিগর এবং জাতির অগ্রজ এবং প্রাগ্রসর নাগরিক।
ইকবালের কবিতার বিষয়বস্তু হলো দুঃখ-দুর্দশাগ্রস্ত সমকালীন বিশ্বের চিত্র আঁকা এবং সেগুলোর বিরুদ্ধে সংগ্রাম করা। সর্বোপরি কালের সকল অসঙ্গতি থেকে মুক্তির উপায় দেখিয়ে দেওয়া। ইকবাল সবসময়ই প্রাচ্যের স্বাধীনতা এবং মুক্তি,মুসলমানদের স্বাধীনতা এবং মুক্তি এবং তাদের ঐক্য কামনা করেছেন। ইকবাল আত্মসচেতনতা এবং জীবনের মূল্যবোধগুলোর অর্থ উপলব্ধি করাকে মুক্তি লাভের শর্ত হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তিনি বিশ্বাস করতেন,পাশ্চাত্যের অনুসরণই হলো জাগরণের পথের অন্তরায় এবং প্রাচ্য সমাজের পশ্চাৎপদতার মূল কারণ।

রেনেসাঁর কবি ইকবাল (৫)
পাঠক ! কবি ইকবালের জীবন ও কর্ম ভিত্তিক ধারাবাহিক অনুষ্ঠান রেনেসাঁর কবি ইকবালের আজকের পর্বে আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। গত আসরে আমরা তাঁর বিভিন্ন কাব্যগ্রন্থের শৈলী ও বিষয়গত পর্যালোচনা করার চেষ্টা করেছি। আজকের আসরে আমরা ইকবালের কবিচিন্তা ও বিষয়বস্তু চিন্তায় ইরানী সাহিত্য ও সাহিত্যিকদের প্রভাব সম্পর্কে কথা বলার চেষ্টা করবো।
ইকবালের দৃষ্টিতে কবিতা ইসলামী সমাজে চিন্তাগত বিপ্লব প্রতিষ্ঠার জন্যে একটি যথার্থ মাধ্যম। ইকবাল কবিতার মাধ্যমে চেষ্টা করেছেন মুসলিম জাতিকে একত্রিত করতে,চেষ্টা করেছেন মানবপ্রেম,পবিত্রতা, মুক্তি এবং প্রেমের বাণী সমাজে পৌঁছিয়ে দিতে। তিনি তাঁর এই লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্যে উর্দু এবং ফার্সি উভয় ভাষাতেই কবিতা লিখেছেন,তবে ফার্সি কবিতার সংখ্যাই এক্ষেত্রে তুলনামূলকভাবে বেশি। মজার ব্যাপারটি হলো ইকবাল নিজে ফার্সি বলতে পারতেন না,অথচ ফার্সি ভাষায় প্রচুর লিখে গেছেন। ফার্সি সাহিত্য অধ্যয়ন এবং ইরানের বড়ো বড়ো কবিদের সাথে পরিচয়ের সুবাদে তিনি এই ভাষার প্রতি আকৃষ্ট হন।
ইকবাল তাঁর একটি কবিতায় ফার্সি ভাষায় কবিতা লেখার কারণ সম্পর্কে বলেছেন, ফার্সি ভাষার ওজস্বিতা এবং সমৃদ্ধি তাঁর উন্নত চিন্তা প্রকাশ করার জন্যে যথার্থ একটি ভাষা। তিনি মনে করতেন এই ভাষার মাধ্যমেই তিনি তাঁর চিন্তা-চেতনাগুলোকে সবচে ভালোভাবে প্রকাশ করতে পারবেন,চিন্তার বিকাশ ঘটাতে পারবেন। কবি ইকবাল লিখেছেনঃ

হিন্দী ভাষার স্বাদ যদি চিনির মতো
প্রকাশভঙ্গিতে দারী আরো মধুরতরো
আমার চিন্তা বিমোহিত দ্যুতিতে তার
তুরের খুরমা শাখা যেন লেখনী আমার
আমার উন্নত চিন্তার জন্যে ফার্সি ভাষা
সৃষ্টিশীল কর্মের যথার্থ বাহন ফার্সি ভাষা

আট শ' বছরেরও বেশি সময় ধরে ফার্সি ভাষা ছিল ভারত উপমহাদেশের সাংস্কৃতিক এবং রাষ্ট্রিয় ভাষা। উনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত এই ভাষা চালু ছিল। এতো দীর্ঘ সময় ধরে ফার্সি ভাষা প্রচলিত ছিল বলে এই ভাষার গুরুত্ব মোটেও হেলাফেলা করার মতো নয়। এই সময়কালে ভারতের প্রত্যেক মুসলিম আরেফ এবং মনীষী ফার্সি ভাষা জানাটাকে অবশ্য কর্তব্য বলে মনে করতেন। এই ফার্সি ভাষার সৌকর্য ও সমৃদ্ধি ব্রিটিশ উপনিবেশের কাল থেকে ধীরে ধীরে মুছে যেতে যেতে একেবারে বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যায়। কেবল স্বনামধন্য ও অভিজাত কতিপয় মুসলিম পরিবার ছাড়া আর কোথাও তার অস্তিত্ব রইলো না। এদিক থেকে বিচার করলে অবশ্যই বলা উচিত যে ইকবাল ফার্সি ভাষায় কবিতা লিখে এই ভাষার অসামান্য সেবা করে গেছেন। যেই ভাষাটিকে প্রাচ্যে বা ভারত উপমহাদেশে ভুলতে বসেছিল, সেই ভাষাটি পুনরায় প্রাণ ফিরে পেল।
আগেই বলেছিলাম যে ইকবাল ইরানী ফার্সি মরমী কবি বা বড়ো বড়ো কবিদের কবিতার সাথে ব্যাপকভাবে পরিচিত ছিলেন। বিশেষ করে মৌলাভি এবং হাফেজের কবিতার প্রতি তাঁর আকর্ষণ ছিল অপিরিসীম। মৌলাভির মাসনাবি এবং হাফেজের গযল তাঁর রক্ত-মাংসের সাথে মিশে ছিলে। তাছাড়া সে সময় পাঞ্জাবে কোরআন এবং নাহজুল বালাগার পরে মৌলাভির মাসনাভি এবং হাফেজের দিওয়ানের কাছে অন্য কোনো গ্রন্থই স্থান পেত না। ইকবাল মৌলাভিকে তাঁর পীর-মুর্শিদ বলে মনে করতেন। এ কারণে ইকবাল বিশেষজ্ঞগণ মনে করেন যে ইকবালের যে শিল্প চিন্তা বা তিনি যে চিন্তা-চেতনা পোষণ করতেন, তার ওপর মৌলাভির ব্যাপক প্রভাব ছিল। ইকবালের সমগ্র কবিজীবনে মৌলাভি ছিলেন তাঁর পথপ্রদর্শক এবং প্রেরণার উৎস। ইকবাল নিজেই লিখেছেনঃ
অগ্রজ রুমি প্রিয় মুর্শিদ আমার সুমহান চিন্তার
আমির তিনি নেশাগ্রস্ত আর প্রেমের কাফেলার
মৌলাভির প্রভাব অবশ্য ইকবালের কবিতার মধ্যে সহজেই বোঝা যায়। কারণ ইকবাল তাঁর অনেক কবিতাই মৌলাভির অনুকরণে রচনা করেছেন। তাঁর আসরারে খুদি,রুমুযে বেখুদি, বান্দেগি নমেহ, জভিদ নমেহ, মুসাফির ও বিলআখারে, পাস চে বয়াদ র্কাদ এই আকওয়ামে র্শাক' ইত্যাদি মৌলাভির অনুসরণে রচিত হয়েছে।

ইকবাল ছোটোবেলা থেকেই হাফেজের কবিতার সাথে পরিচিত ছিলেন। তিনি তাঁর কবিজীবনের শুরুতে হাফেজের বিপরীতে কবিতা লিখেছিলেন। অবশ্য পরে এ জন্যে অনুতপ্তও হয়েছিলেন। তিনি তাঁর ভুল বুঝতে পারার পর ঐ কবিতা নষ্ট করে ফেলেন। পরবর্তী পর্যায়ে তিনি যেসব কবিতা লিখেছিলেন তার সাথে হাফেজের কবিতার সুরের ঐক্য লক্ষ্য করা যায়। সর্বোপরি ইকবাল যে ইরানী কবিদের দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত ছিলেন তা নিঃসন্দেহে বলা যায়।

কোন মন্তব্য নেই: