ঘুমোতে যাওয়ার আগেই বুঝেছি আজ রাত আর ঘুম হবেনা। নিদ্রার ভেতরেই নির্ঘুম আমি সারারাত। দুচোখে কেবল শুধু আগুন আর আগুন জ্বলছে; মায়ের উষ্ণ ভালোবাসায় মোড়ানো পবিত্র শরীর আবারো গার্মেন্টস অগ্নিকান্ডে পুড়ে পুড়ে অঙ্গার হয়েছেন আমার মা, ঝলসে গেছে কাজলা দিদির মেহেদী রাঙ্গানো হাত, পুড়ে পুড়ে অঙ্গার হচ্ছে স্বপ্ন মাখানো নিষ্পাপ মুখখানি। সেই দৃশ্য দেখে কতবার যে নিজ ইচ্ছায় অন্ধ হয়ে গেছি; চোখের পাতা বন্ধ করেছি! বুকের চাপা রক্ত টিপ টিপ চোখে ঝরেছে। দু’মুঠো খাবারের জন্য যারা প্রতিদিন কত কষ্ট করেছে। সকাল সন্ধ্যা, হাড় ভাঙ্গা পরিশ্রম শেষেও যাদের নিস্তার মেলে নি। ওভারটাইমের নামে জোড় করে খাটিয়ে নিচ্ছে মানুষ রূপী হায়েনার দল। সেই হতভাগা মানুষগুলো তাদের ঝলসানো বিভৎস্য মুখখানি; কুড়িয়ে নেয়া শরীরের পুড়ে যাওয়া ছাই দেখে আমার মুখে থু থু জমতে থাকে, হাত মুঠো হতে থাকে, চিৎকারে চোয়াল শক্ত হতে থাকে। এই ঘৃণা ভরা থু থু কাদের উপর নিক্ষেপ করবো? এই নির্মম ঘটনার আড়ালে লুকিয়ে আছে কাদের সেই কুৎসিত চেহারাটা, কে বলে দেবে? সারারাত আমি ঘুমোতে পারি না। সদা হাস্যেজ্জল নিষ্পাপ মুখগুলোর আর্ত চিৎকারে আমার ঘুম টুটে যায়। ঘুমের ঘোরে পোড়া গন্ধের বিভৎস্য মুখ দেখে আঁতকে উঠে আমার নির্ঘুম রাত কেটে যায়।
বারো বছরের ছোট্ট ছেলে নিলয়, হাতে বাবা-মায়ের ছবি নিয়ে ঘুরছে দিক,বিদিক তবু খুজে পাচ্ছেনা তার বাবা মায়ের পুড়ে ছাই হওয়া লাশ। তার অসহায় চোখে তাকিয়ে সান্তনা দেবার জন্যও পাশে কেউ নেই। যেই বাবা মা জীবনটাকে নিশ্চিত করতে এসেছিল নিশ্চিন্তপুর । সেকি জানতো তার জীবনটাকে এভাবে অনিশ্চিতের মুখে ঢেলে দিয়ে তারা পাড়ি দেবে না ফেরার দেশে। চোখটা বন্ধ করে কিছুক্ষনের জন্য আমিও নিলয় হয়ে গেলাম; ভাবতে থাকলাম এতিম,অসহায় নিলয়ের মত করে।
প্রিয় মা,বাবা তোমাদেরকে আমি আর কোথায় খুজে বেড়াব!সব জায়গায় তো খোজ নিলাম; বেওয়ারীশ হয়ে পড়ে থাকা সকল লাশের পুড়ে যাওয়া মুখগুলো একে একে খুলে দেখলাম। কোথাওতো তোমাদের পেলাম না। কে এনে দিবে আমাকে তোমাদের সন্ধান? আমি যে বড় অসহায় হয়ে গেলাম! তোমরা বুঝি আর কখনই ফিরে আসবেনা!! আমি বুঝি চিরদিনের জন্য এতিম হয়ে গেলাম!! মাগো,প্রতিদিন ক্লান্ত শ্রান্ত হয়ে যখন ঘরে ফিরতে তোমাকে দেখা মাত্রই তোমার কোলে বুঝি আর ঝাপিয়ে পড়া হবে না, আদর করে আমার কপালে আর চুমু খাবেনা তুমি! কেউ আর দুধমাখা ভাত মুখে তুলে দেবে না। হারিয়ে গেছে চিরদিনের জন্য ছায়াদানকারী বাবা নামের বটবৃক্ষটা। বাবা সত্যি করে বলছি “টুকটুকে লাল জামা চেয়ে তোমাকে আর কখনো জ্বালাবোনা। তবু তুমি ফিরে আসো।আর পারছিনা! আমার ভিতরটাও যে জ্বলে,পুড়ে ছাই হয়ে গেল, কাকে যে দেখাই!জানি মরনে তোমাদের অ-নে-ক কষ্ট হয়েছে!আমার কথা ভেবে বাঁচতেও চেয়েছো খুব।কথা দিচ্ছি যে আগুন নিষ্ঠুর ভাবে তোমাদের কপালটাকেও পুড়িয়ে ছাই করে দিয়েছে যে কপালে প্রতিদিন চুমু খেতাম। অপেক্ষায় থেকো ওপারে তোমাদের সাথে আবার দেখা হবে সেদিন প্রান ভরে কপোলে চুমু খেয়ে নেব। আদরে,আদরে আজকের সমস্ত যন্ত্রনা সেদিন ভুলিয়ে দেব।
আমি যে দিকে তাকাই, সেদিকেই যেন আমার মায়ের,বাবার ঝলসানো বিভৎস্য মুখখানি দেখতে পাই। বহুদূর থেকে মা যেন আমাকে ডেকে বলেন, খোকা, এইতো আমরা এখানে।কোথাও না পেয়ে বাতাসের পোড়া গন্ধে নিলয় খুজে বেড়ায় তার বাবা,মাকে। মাগো, আর কতদিন পৃথিবীর সব প্রান্তে তোমার ঝলসানো শরীরের পোড়া গন্ধ ভেসে বেড়াবে, মাগো, তোমার শরীরের পোড়া গন্ধ দেশ বিদেশের মানুষগুলোর নাকে আঘাত হানলেও সেই গন্ধ পৌছায় না তোমাদের ঘামে অর্জিত মুনাফায় তৈরি বিশাল অট্রালিকার দেয়াল ভেদ করে কোটি পতি মালিকের এয়ার কন্ডিশন রুমে। পৌছেনা হাসিনা খালেদার শাহী বেহেশত খানায়। আমার মতন ওদের মায়েরা তো আর দিন মুজুরে না; তাই ওদের কাউকে পুড়ে ছাই ও হতে হয়না। কি করে বুঝবে আমাদের দুঃখ,কষ্ট,আর বেদনা গুলো। দিনের পর দিন না খেয়ে যে থাকতে হয়না ওদের। কি করে বলবো! আর কতবার তোমার পুড়ে কয়লা হয়ে যাওয়া বিভৎস্য মুখখানি পত্রিকার শিরোনাম হবে! এর কোন উত্তর আমি দিতে পারবোনা। আমি জানিনা এর কোন সমাধান আছে কিনা থাকলেও কার কাছে আছে সেই সমাধান?
সবাই বলে, তোমরা নাকি দেশটাকে বাঁচিয়ে রেখেছ। তোমাদের ঘামের উপর নাকি ভেসে বেড়ায় বাংলাদেশের অর্থণীতি তবে তোমাদেরকেই কেন বারং বার পুড়ে পুড়ে ছাই হতে হয়? কেন শহরের নামিদামী মানুষদের নামিদামী এলাকায় আগুন লাগতে দেখিনা; কারখানার মালিককে তো কখনো পুড়ে ছাই হতে দেখা যায়না। তবে কেন? তোমাদের মত হত দরিদ্র শ্রমিকেরা যারা এক মুঠো ভাতের জন্য রাত দিন পরিশ্রম করে কোনভাবে বেঁচে থাকার জন্য। তাদের বেঁচে থাকার মূল্য কি এতই বেশী যে পুড়ে ছাই হয়ে উড়ে উড়ে সেই মূল্য দিতে হয়? আমি জানিনা এর সঠিক উত্তর কে দেবে? তবে বুঝে গেছি আর চিনেও নিলাম রাষ্ট্রের আসল চেহারা এ যেন বিড়াল আর দুধের সেই গল্পটা আরেকবার মনে করিয়ে দিল। শহরের যে জায়গার বিল্ডিংগুলো ছোট দেখতে একটা খুপরির মত সে জায়গাগুলো আর সেখানকার মানুষগুলোকে অনেকের কাছেই জঞ্জাল মনে হয় একদিন হয়ত এই জঞ্জালগুলো এমনিতেই পরিষ্কার হয়ে যাবে কেউ টেরও পাবে না।
আকাশে শকুনদের উড়াউড়ি দেখে মনে হয় এই বুঝি কোন হিংস্র হায়েনার দল ঝাপিয়ে পড়েছে কোন নিরীহ, হতদরিদ্র মানুষের উপর। কেড়ে নিয়েছে তার সবিকিছু যা ছিল নগন্ন। যাদের সামান্য স্বার্থের কাছে নিলাম হচ্ছে শত,শত নিরীহ মানুষের জীবন। আকাশে ওড়া চিল দেখে সুন্দর মনে হলেও তার আড়ালে থেকে যায় তার হিংস্র শিকারি চোখ। আমাদের শহরেও নামিদামী সুন্দরের আড়ালে এমন কিছু চোখ রয়েছে যা কিনা কেবল শিকার খুজে বেড়ায়। আমি জানিনা ওদের পরবর্তী শিকারে কারা পরিনত হতে যাচ্ছে?তবে তারা যদি আবারো নিচু শ্রেনীর হত,দরিদ্র মানুষ হয় তবে খুব একটা আশ্চর্য হবার কিছু থাকবেনা।
প্রিয় মা,বাবা, তোমরা তো এখন ওপারে আছো। আল্লাহর সাথে দেখা হলে বলো আমার মতো অসহায় নিলয়কে যেন আর গরীব বাবা মায়ের ঘরে না পাঠায় যার বাবা,মাকে দু'মুঠো ভাত খুজতে গিয়ে এভাবে পুড়ে ছাই হতে নাহয়। আবার যদি কোন নিলয়ের জন্ম হয় সেই জন্ম যেন বিশাল অট্রালিকায় সোনার পালঙ্কে; সোনার চামুছ মুখে নিয়ে হয় তাহলে তাকে আর আমার মতন বাবা,মায়ের পুড়ে যাওয়া শরীরের ছাই উড়ে যাওয়া বাতাসে খুজতে গিয়ে দিক-বিদিক ছুটতে হবেনা।
শ্রমিকের মুখ আর পণ্যের মুখ এক নয়''
কেননা শ্রমিকের অনেক শ্রম ও ঘামের বিনিময়ে তৈরি হয় পণ্য
শ্রমিক কেবলই ক্ষয়ে ক্ষয়ে যায়
আর পণ্য হয়ে উঠে উজ্জ্বলসুন্দর
পণ্য ক্রমান্বয়ে দামি হয়ে উঠে
শ্রমিক কেবলই ক্ষয়ে ক্ষয়ে যায়
শ্রমিক আর পণ্য ক্রমাগত সরে সরে যায়
দূরে
আরো দূরে''''
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন