মঙ্গলবার, ২১ ডিসেম্বর, ২০১০

শহীদ আসগর আলী

শহীদ নং-৬
নাম : মো: আসগর আলী
সাংগঠনিক মান: কর্মী
শহীদ হওয়ার তারিখ: ১৮ নভেম্বর ১৯৮৮ দুপুর বেলা
পিতার নাম: মো: রমজান আলী
সর্বশেষ পড়াশুনা: এম.এস.সি শেষর্ব পরীক্ষার্থী, পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগ।
জীবনের লক্ষ্য: আদর্শ শিক্ষক হওয়া।
শহীদ হওয়ার স্থান: শাহ্‌ মখদুম হলের সামনে, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
আঘাতের ধরন: ছোরা, কিরিচ।
কাদের আঘাতে শহীদ: ছাত্রমৈত্রী।
স'ায়ী ঠিকানা: গ্রাম: শাশারপুর, ডাক: ভিয়াইল, থানা: চিবির বন্দর, জেলা: দিনাজপুর।
ভাইবোন : ৪ জন।
ভাই-বোনদের মাঝে অবস'ান: সবার বড়।
পরিবারের মোট সদস্য: ৭ জন (বর্তমানে ১১ জন)।
পিতা: জীবিত, পেশা: কৃষি।
মাতা: জীবিত, পেশা: গৃহিণী।
শহীদ হওয়ার পূর্বে স্মরণীয় বাণী: সুন্দর এ মতিহার সবুজ চত্বরকে ভালবেসেছি। জীবনের শেষ রক্ত বিন্দু দিয়ে ইসলামের স্বার্থে বিশ্ববিদ্যালয়কে ভালবেসে যাব।
শাহাদতের পর শহীদের মাতা-পিতার প্রতিক্রিয়া: শাহাদাতের সংবাদ পাওয়ার পরপরই পিতামাতা দুই জনেই অজ্ঞান হয়ে যান।

'আমার আব্বু কোথায়?'

আফিফা তাজরেমিন


আমি তখন খুব ছোট ছিলাম। কোন কিছুই বোঝার বা উপলব্ধি করার ক্ষমতা আমার ছিলনা। আব্বুর কোন স্মৃতিই আমার মনে নেই। এখন মনে হয়, তখন আমার বোঝার জ্ঞান থাকলে দেখতে হতো আমার দাদু-দাদীর সুস' সবল সন-ান হারানোর বুক ফাটা আর্তনাদ। আমার মায়ের বাস-ব স্বপ্নগুলো কেমন করে ভেংগে চুরমার হয়ে গেল। বিধ্বস- যেন একটি জ্যান- লাশ। এখন আমাকে প্রতিনিয়ত দেখতে হয় কিভাবে সংগ্রাম করে আমার মা বেঁচে আছে। আমি আব্বুর অসীম ্লেহ থেকে বঞ্চিত হয়ে অন্যের ্লেহ ভালবাসার ওপর বেঁচে আছি। আব্বুর স্বপ্ন ছিল তার মত আমাকেও বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রী নেওয়াবেন। আব্বু বেঁচে থাকলে হয়ত তার এ স্বপ্ন পূর্ণ হত। কিন' যখন আব্বুর হত্যার ঘটনাগুলি মনে পড়ে যায় (মা এবং অন্য সবার কাছে শুনে) তখন আর ইচ্ছা হয় না বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার। একটা ভয়, ঘৃণা, অভিমান, আর কষ্ট, এসে জমা হয় আমর ক্ষুদে মনে। আমার তখন খুব কষ্ট হয় মনে হয় কি হবে ঐ সাফল্য নিয়ে? আমার আব্বুতো দেখতে পারবেনা, উপলব্ধি করতে পারবেনা তার স্বপ্ন পূরণের অনুভূতি। বুকে জড়িয়ে আদর করে বলবে না “সোনার মেয়ে আমার, তুমি আমার স্বপ্নকে পূর্ণ করেছ।”
এখনও পত্রিকা পড়লে আমার চোখে পড়ে রাজশাহীতে গন্ডগোল, ২/৫ জন ছাত্র নিহত। এটা মনে পড়লে বুক তখন কেঁপে ওঠে, আমার দাদু-দাদীর মতো আমার মায়ের মতো। আমার দাদুর মনে হাজারো প্রশ্ন এসে ভীড় জমে কেন ছাত্ররা কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনীতি করে? এসব জায়গাতো শুধু পড়াশুনা করার জন্য, তবে কেন ছাত্ররা কলম ফেলে অস্ত্র নিয়ে যুদ্ধ, মারামারী, হানাহানি করে? ছাত্ররা শুধু পড়া শুনা করবে। তারপর তারা বাবা মায়ের স্বপ্নকে পূরণ করবে। কিন' সম্পূর্ণ বিপরীত হচ্ছে। সন-ান ঘরে ফিরছে ঠিকই, তবে স্বপ্নকে পূর্ণ না করে লাশ হয়ে। মায়ের কাছে শুনেছি ছাত্র নং অধ্যয় নং তপঃ তবে কেন ছাত্ররা কলম ফেলে অস্ত্র হাতে নেয়? কারা কলম ফেলে অস্ত্র ঘঠতে নিয়ে আমার আব্বুকে হত্যা করেছিল? কারা আমাকে চিরদিনের জন্য পিতৃহারা করলো? কেন আমাকে বঞ্চিত করলো আব্বুর আদর হে থেকে? কেন? আমার আব্বুতো কোনদিন কারও ক্ষতি করেনি। ইসলামের জন্য তার হৃদয় কেঁদেছে আর তাই তিনি ইসলামকে জীবনের মিশন মনে করেছিলেন। সত্যি বলতে কি ইসলামকে ভালবাসাই ছিল আমার আব্বুর অপরাধ। কেন বড় অসময়ে আমার আব্বুকে প্রাণ দিতে হল? মানবতাহীন কলুষিত এই নোংরা রাজনীতিই তো দায়ী। আমার আব্বুর হত্যার বিচার আমি চাই না। কারণ জানি, এসবের কোন দিন বিচার হয়না। একমাত্র পরকালে ছাড়া। তবে যদি মানবিকতা বলে কোন শব্দ থাকে অভিধানে, তবে নিশ্চয়ই খুনিরা অনুশোচনা আর অনুতাপের আগুনে জ্বলতে থাকবে চিরদিন।
(লেখিকা: শহীদ আসগর আলীর ্লেহের কন্যা)

শহীদ আসগরের বাড়িতে কিছুক্ষণ

আব্দুল মান্নান

শাশারপুরের আলো বাতাসে মানুষ হওয়া শহীদ আসগর আলী আর পৃথিবীতে নেই। আসবেন না দেখা হবেনা কখনও তার প্রিয়জনদের সাথে। ক্ষণকালের প্রিয়জনদের ছেড়ে তিনি তার প্রকৃত স'ায়ী প্রিয়জনের সাথে বসবাস করছেন বিশাল আকৃতির পুকুরের দক্ষিণ পাড়ের প্রিয় গোরস'ানে। শিক্ষাজীবনের অনেকগুলি সিঁড়ি পেরিয়ে সর্বশেষ ডিগ্রী নেয়ার জন্য এসেছিলেন উত্তর ও দক্ষিণ বঙ্গের শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপিঠ মতিহারের সবুজ চত্বর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। পড়াশুনা শেষ করে পিতা-মাতা, ভাই-বোনদের মুখ উজ্জ্বল করবেন। হায়! কী আশ্চর্য! শেষ ডিগ্রীটা তার ভাগ্যে জোটেনি। পৃথিবীর অজানা সবচেয়ে বড় ডিগ্রী পাওয়ার যিনি অধিকারী তিনি কি আর ছোট কোন ডিগ্রীর অপেক্ষায় থাকেন?
পিতা-মাতার চেয়ে কোন অংশেই কম দেখেনি পাড়া-প্রতিবেশীরা। পাড়া-প্রতিবেশীরা ছিল শহীদ আসগর আলীর প্রিয় শুভাকাঙ্খী। বাড়ি গেলেই সবার সাথে দেখা সাক্ষাত করতেন, খোঁজ-খবর নিতেন, সালাম বিনিময় করে তাদের পারিবারিক কুশলাদি জানতেন। নামাজে ডাকতেন, মসজিদে আসতে বলতেন, আর দরদ ভরা মন নিয়ে মানুষকে ইসলামের কথা বুঝাতেন। সে কারণেই পাড়া-প্রতিবেশীর কাছে যখন লাশ হয়ে শহীদ আসগর ফিরলেন তখন কি যে এক দৃশ্যের অবতারণা হয়েছিল যা ছিল সত্যিই বর্ণনাতীত।
পাড়া-প্রতিবেশীরা সেদিন শাশারপুরের আকাশ বাতাসের সাথে কেঁদেছে, চোখের পানিতে বুক ভিজিয়েছে। তাদের প্রিয় মানুষটিকে শুধু এক নজর দেখার জন্য
আকুতি করেছে, ভিড় ভেঙ্গেছে হাজারো মানুষের, যেমনটি করে অবুঝ শিশুরা তার মায়ের কোলে যাওয়ার জন্য। মিছিল নিয়ে হাজির হয়েছে তার প্রিয় সাথীরা শহীদকে সম্মানের সাথে দাফন করার জন্য। আত্মীয় স্বজনের সাথে ভাল ব্যবহারের পাশাপশি সবার প্রতি মায়া মমতা ও ্লেহ বৎসল ছিলেন। মানুষের দুঃখে কষ্ট পেতেন এবং তা দূর করার জন্য সাধ্যানুযায়ী চেষ্টা করতেন। গরীবেরা কষ্টে পড়লে বুদ্ধি, পরামর্শ দিয়ে সর্বোপরি সহায়তা করতেন। নিজে কষ্ট করে মানুষের কষ্ট দূর করতেন। কাউকে ফাঁকি দেয়া, বিপদে ফেলার কথাতো কষ্মিনকালেও ভাবতেন না। টিকিট ছাড়া ট্রেনে উঠতেন না। একবার পার্বতীপুর থেকে ট্রেন যোগে বাড়ি আসার সময় এক লোক অর্থাভাবে টিকেট কাটতে না পারলে শহীদ আসগর ভাই তাকে টিকিট না কেটে ট্রেনে না উঠতে পরামর্শ দেন এবং বাড়ি পৌছার সুবিধার্থে কিছু টাকা দিয়ে সহায়তা করেন। আর একদিন, মটর সাইকেল নিয়ে পুলহাট থেকে দিনাজপুর যাওয়ার পথে রাস-ার পাশে একটি ডোবা ছিল, সেখানে একটি ছোট শিশু পানিতে পড়ে হাবুডুব খাচ্ছিল। দয়াপরবশ শহীদ আসগর আলী বাচ্ছাটিকে দ্রুত চিকিৎসার জন্য মেডিকেলে নিয়ে যান এবং নিজ খরচে চিকিৎসার ব্যবস'া করেন। পরে বাচ্চাটির পিতা-মাতা এসে শহীদ আসগরকে চিকিৎসার টাকা পয়সা পরিশোধ করতে চাইলে তা গ্রহণে অনীহা প্রকাশ করেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা কালীন, এলাকা থেকে আসা ছাত্রভাইদের নানা কাজে সহায়তা করেছেন। নিজ খরচায় অনেকের সার্টিফিকেট তুলে দিয়েছেন।
স্বভাব-চরিত্রে অতুলনীয় শহীদ আসগর কথা-বার্তায় ছিলেন মিতভাষী। প্রয়োজনীয় কথা সংক্ষেপে বলতেন। বাড়ির সবার চেয়ে কম খেতেন। রান্নার সময় আম্মার চুলার নিকটে গেয়ে বসতেন আর আদরের ছেলেকে মা পাতিল থেকে তরকারী তুলে স্বাদ পরীক্ষার জন্য দিতেন। বাবা বন্দুক দিয়ে পাখি শিকার করলে শহীদ আসগর দৌড়ে গিয়ে ধরতেন। হাসি মাখা মুখে শহীদ আসগর শৈশব, কৈশর পেরিয়ে উচ্চ শিক্ষার আশায় ১৯৮৪ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞান সম্মান ১ম বর্ষে ভর্তি হন। ১৯৬৩ সালে জন্ম। তিন ভাই, এক বোন সবার বড় শহীদ আসগর। ভাব গাম্ভীর্য আর চাল-চলনে সর্বদা সাহেবী ভাব পরিলক্ষিত ছিল বিধায়, পিতার বড় সখ ছিল ছেলেকে টয়োটা কার কিনে দেবেন। ছেলে টয়োটাতে চড়ল না চড়ল প্রিয় খাটলিতে। দিনাজপুরের সেন্ট ফিলিপস উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ১৯৭৯ সালে বিজ্ঞান ১ম বিভাগে এস এস সি পাশ করেন।১৯৮১ সালে দিনাজপুর সরকারী কলেজ থেকে বিজ্ঞান ২য় বিভাগে এইচ এস সি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৯৮৮ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থ বিজ্ঞান বিষয়ে বি এস সি (সম্মান) ডিগ্রী লাভ করেন। শাহাদাতের পূর্বে এম এস সি পরীক্ষার মাত্র দু’টি পার্ট বাকি ছিল তার।
ইসলাম পূর্ব জাহেলিয়াতের যুগেও চারটি মাসে খুন, জখম, রক্ত, হানাহানি বন্ধ ছিল। তারা মাস চারটিকে পবিত্র মনে করত। কিন' খোদাদ্রোহী ইসলামের শত্রুরা বাংলার সভ্যতা ও ঐতিহ্যের দিন শুক্রবারেও রক্তপানে বিরত থাকেনি। নৃশংস, বীভৎস, কুত্তা আর হায়েনাদের আবার সভ্যতা কিসের? ওরাতো যেখানে সেখানে যৌনাচার করে, করে ঘেউ ঘেউ আর কামড়া-কামড়ি।
শহীদ আসগর আলী আমীর আলী হলের আবাসিক ছাত্র ছিলেন। পড়াশুনার পাশাপাশি, কিভাবে ইসলামের খেদমত করা যাবে তাই ছিল শহীদের ব্রত। ইসলামী আন্দোলনের সময়ের সাথে উত্তরোত্তর তার আমল আখলাকও বৃদ্ধি পায়। শাহাদাতের দিন ছিল শুক্রবার জুমআর দিন। জুমআর নামাজ হল মসজিদেই পড়তে পারতেন কিন' কেন্দ্রীয় মসজিদে গেলে বেশী সওয়াব হবে এই আশায় গোসল সেরে পাক-পবিত্র হয়ে জুমআর নামাজ আদায়ের জন্য কেন্দ্রীয় মসজিদের দিকে রওনা হলেন শহীদ আসগর আলী। নামাজ পড়তে দিলনা রক্ত পিপাসুরা। আমীর আলী হলের সামনে তাকে রামদা, হকিস্টিক, ছোরা, কুড়াল দিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করল। যদি কথা বলার শক্তি থাকত সেই টেলিফোন পোলটির তাহলে চিৎকার করে বলে দিত খুনীদের বীভৎস কাহিনী, আজকের নতুন প্রজন্মকে। যার সামনে শহীদ আসগর আলীকে খুন করা হয়েছিল। যুগ ও কালের নীরব সাক্ষী ব্যথাতুর বিল্ডিং, পোল, আমগাছ আজও পবিত্র আত্মার মাগফিরাত কামনা করে। মাগফিরাত কামনা করে ইসলামী আন্দোলনের হাজার হাজার কর্মীরা। আজকে শহীদের সাথীরা ভীত-বিহ্বল সন্ত্রস-, কিভাবে তার অবশিষ্ট কাজগুলি সুষ্ঠুভাবে সমাধা করা যায়। ফেলে যাওয়া কাজগুলি সেরে ফেলার জরুরত ও পরকালীন হিসাবের ভয়ে ভীত সন্ত্রস-। একদিকে তারা হতাশ অপর দিকে শক্তিধর। হতাশ এই কারণে যে, আজও বিচার হয়নি এইসব পবিত্র আত্মার হত্যাকারীদের কেননা তাদের কখনও ছিলনা প্রধানমন্ত্রী, না ছিল কোন জাদরেল আমলা, দেখেনি তারা টেলিফোনের দাপট। আর শক্তিধর এই কারণে যে, শহীদদের ভেজা শোকগুলি শক্তিতে পরিণত হয়েছে। কোন সাহিত্যিক হিসাবে জন্ম গ্রহণ করলে কিংবা খোদা মসির জোরে আমাকে বলবান করলে সুন্দর করে কিছু লিখতে পারতাম।
দিনাজপুরের যোগাযোগটা ট্রেনেই সুবিধা আমার কাছে মনে হয়েছে। কিন' সকালে কিছু কাজ থাকায় ট্রেনে যেতে পারলাম না। বিকাল ৩-১৫ মিনিটে রাজশাহী টু লালমনিরহাট, অনন্যা পরিবহনে চড়লাম। নামলাম রংপুর মডার্ন মোড়ে। চিন-া একটাই কখন শহীদের বাড়ি পৌঁছাতে পারব। গাড়ি পরিবর্তন করে সৈয়দপুর পৌঁছুলাম কিন' রাতে নেমেই শুনলাম বেশ ক’দিন থেকে গাড়ি চলাচল বন্ধ। নিরুপায় হয়ে মাইক্রো ভাড়া করে রাত্রেই দিনাজপুর পৌঁছুলাম। সারাটা রাত কাটল টেনশনে। পরের দিন জেলা সভাপতি আব্দুল মতিন ভাইয়ের সহযোগিতায় মটর সাইকেল নিয়ে পথ চলা শুরু করলাম। চিরির বন্দর থানায় শাশারপুর গ্রামে যেখানে শুয়ে আছে এক পবিত্র আত্মা, নাম তার শহীদ আসগর আলী। পিচ ঢালা রাস-া শেষ করে ইটের খোয়া বিছানো রাস-ায় পাড়ি জমালাম। পরিশেষে প্রত্যাশিত গন-ব্যস'লে পৌঁছুলাম। ছিমছাম পাকা বাড়ি। আব্বা বাড়ি ছিলেন না। ততক্ষণে এক চাচাত ভাই আমাদের বসার ব্যবস'া করে আব্বাকে ডাকতে গেলেন। মেঝ ভাই ইসাহাক আমাদের সাথে কথা বলা শুরু করলেন। আমরা সবাই তন্ময় হয়ে মেজ ভাইয়ের কথা শুনছি। মেঝ ভাই পেশায় শিক্ষক। এরই মধ্যে দূর থেকে দেখতে পেলাম পাঞ্জাবী, লুঙ্গি পরা এক শ্রদ্ধাভাজনের আগমন, আমাদের দিকে। দেখে আমাদের কষ্ট হলনা চিনতে। তিনি আমাদের শহীদের গর্বিত পিতা। এক সময় ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচিত মেম্বার ছিলেন বলে এলাকার মানুষ তাঁকে মেম্বার বলেই সম্বোধন করে।
আমাদের আসার উদ্দেশ্য বর্ণনা করে তাঁর কাছ থেকে কিছু শোনার আকুতি পেশ করলাম। ‘কী বলবো?’ একথা বলেই প্রায় ২০-২৫ সেকেন্ড পেরিয়ে চলল। কারো মুখে কোন কথা নেই নিঃসঙ্গ বিদ্যুৎ ক্ষরণের মত। তারপর চোখ ফেটে দরদর করে অশ্রু গড়ালো পিতার। আমি কষ্ট করেও নিজেকে সংবরণ করতে পারছিলাম না। অশ্রুতো নয়, যেন খা খা মরুভূমি থেকে প্রবাহিত আবে জমজম, যার এক পিয়ালা হাজার বছরের পিপাসাকে করতে পারে দূরীভূত। ফর্সা মুখ তখন ফ্যাকাশে দেখাচ্ছিল। নাকের সর্দি আর চোখের পানির বড় বড় ফোটা শুভ্র গন্ডদেশ বেয়ে পাঞ্জাবীর ওপর পড়ছে যেন টিনের চালে শিলাবৃষ্টির অশনি সংকেত। শহীদের পিতা তাকিয়ে আছেন উত্তরের উঠানে সাদা ফাঁকা জায়গায়। গাল থেকে হাত নামাতে নামাতে বলতে শুরু করলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই ভয়াবহ ১৮ নভেম্বরের ঘটনাসমূহঃ শাহাদাত বরণ করেছে বেলা ১২-৪৫ মিঃ। খবর পৌঁছেছিল রাতেই। পরের দিন সকাল দশটায় লাশ বাড়ি পৌঁছুলো। আমি জীবনে এত লোকের জানাজায় উপসি'তি আর কখনও দেখিনি। চেনা অচেনা হাজার হাজার মানুষ তিল ঠাঁই নেই বাড়ির আঙ্গিনায়। আসগর আলী অনার্স পরীক্ষা দিয়ে কিছুদিন সময় পেল দ্বীনের কাজ করার জন্য। অস্বাভাবিক ভাবে নামাজ ও ইসলামের দাওয়াতকে জীবনের বড় মিশন মনে করল। “কিয়ামতের দিন সবার আগে হিসাব হবে নামাজের, যার নামাজ সুন্দর হবে তার অন্যান্য ইবাদত সমূহ সুন্দর হবে এবং পরবর্তী হিসাব প্রদানও সহজতর হবে।” কথাগুলি বাড়ির সকল সদস্যসহ পাড়া-প্রতিবেশীদের বেশি করে বলতে থাকল।
আধুনিক প্রজন্ম ও পরিবারের সন-ান হয়েও দাড়ি রাখতে কার্পণ্য করলেন না। বিজ্ঞান অনুষদের ছাত্র হওয়ায় ভাল আর্টের অভ্যাস গড়ে উঠেছিল। আর সে কারণেই ছেলেরা পড়াশুনার সহায়তাসহ ছবি আঁকানোর ব্যাপারে আবদার করত। তিনি ছেলেদের আবদার রাখতে পারেননি। বাড়ির অদূরে প্রতিষ্ঠিত সঙ্গীত কলেজে পদার্থবিদ্যার একজন প্রভাষকের প্রয়োজন দেখা দিলে শহীদ আসগর দরখাস- করেন এবং অস'ায়ীভাবে কিছুদিন চাকুরি করেন। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই কলেজের স্টাফ ও ছাত্র-ছাত্রীদের মাঝে তাঁর সুনাম ও সুখ্যাতিতে ছিল টুইটুম্বর। শাহাদাত্তোর জীবনে সবার মাঝে বেঁচে আছে কালেমা খচিত পতাকা হয়ে যাকে মাটিতে রাখা যায় না। ডান হাত কাটা গেলে বাম হাতে, বাম হাত কাটা গেলে মুখ দিয়ে উঁচু করে আসমানে ধরে রাখে তবুও শির নোয়াবার নয় খোদাদ্রোহী তাগুতী শক্তির কাছে।
টেলিভিশন দেখাকে ঘৃণা করতেন। টি ভি তে ইসলাম বিরোধী অনুষ্ঠান প্রদর্শনের কারণে পূর্বে ক্রয়কৃত টি ভি শহীদ আসগর আলী বিক্রির ব্যবস'া করলেন।
সর্বদা অপ্রয়োজনীয় খরচ পরিহার করতেন। জিনিসপত্র কেনা-কাটায় খুব কম ঠকতেন। সে কারণেই অনেকেই কেনাকাটায় সাগ্রহে তাকে সাথে নিতে চাইতো। তিনি তার ব্যক্তিগত সকল খরচ লিখে রাখতেন। কথা প্রসঙ্গে ইসাহাক ভাই বাড়ির ভিতরে আসার জন্য পীড়াপীড়ি শুরু করলেন। এতক্ষণ আমাদের সাথে পিতার কথা হচ্ছিল বাইরের ঘরের বারান্দায়। সাজানো গোছানো ড্রয়িং রুমে গেলাম। নাস-া খেতে খেতে আবারও কথা হচ্ছিল। শহীদের রেখে যাওয়া কোন কাজ, স্মৃতি ইত্যাদি প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি উঠে গিয়ে স্টীলের আলমারী খুললেন কিছু পুরাতন লিফলেট ও একটা বাঁধাই কৃত ছবি এনে সামনের টেবিলে রাখলেন। “এই যে বাবা এই সেই বন্দুক যা দিয়ে আমি পাখি শিকার করলে ও বাচ্চাদের মত দৌড়ে গিয়ে পাখি আনতো। আর অনেক বার অনেকেই এসে কিছু কিছু জিনিস নিয়ে গেছে।” যে কয়টি জিনিস আমার টেবিলের সামনে পিতা রেখেছিলেন তার মধ্যে একটা জিনিস আমাকে সাংঘাতিকভাবে আকর্ষণ করলো তা হল শহীদের বাঁধাই করা সেই এস এস সি পরীক্ষার পূর্বে উঠানো ছবি। হাফ সুয়েটার। ভিতরে লম্বা কলারের শার্ট। ভ্রু ও চুলগুলি অসম্ভব কালো। ছবির নিচ দিয়ে নিজ হাতে লেখা নাম ও হাইস্কুল ত্যাগের ইংরেজী তারিখ। উন্নত নাসিকা; কর্ণ সব মিলে অপরূপ। বার বার নাড়ছি। উল্টে পাল্টে। দেখে মনে হয়েছিল কত দিনের পরিচিত। যত রাগ হোক আর দুঃখ হোক সমুদ্র সমান তবুও যদি ঐ ছবি কেউ দেখে তাহলে থাকবেনা তার কোন যাতনা। বার বার গলা আমার শুকনো কাঠ হচ্ছে ছবিটি নিয়ে যাই; এটা বলতে। বাড়ি থেকে বের হয়ে আসার আগ পর্যন- বাঁধাই করা ছবিটি আমার হাতেই ছিল। কিছুক্ষণ পরেই আমার ভুল ভাঙ্গল। বাড়ির গুরুত্বপূর্ণ দুই-একটি স্মৃতির মধ্যে এটি একটি। নিজকে তৎক্ষণাৎ সংযত করলেও বেওকুফের মত বলতে ইচ্ছে করছিল- ছবিটি আমরা নিয়ে যাই। ওটাকে আমরা শহীদ স্মৃতি সংগ্রহশালায় যত্ন সহকারে রাখবো। যা দেখে শহীদের লক্ষ লক্ষ সাথীরা আনন্দে তাদের ডাগর চোখ ভিজে সাগর করবে। ঐ বেওকুফ ত্যাঁদড় আকাঙ্খাটি কোথা থেকে এসেছিল জানি না তবে মনে হয়েছিল ওটা এমন এক বস' যা সাথে নিয়ে পথ চললে নিশ্চিনে- চলা যাবে। পকেটে নিয়ে পরীক্ষার হলে গেলে পরীক্ষা ভাল হবে, ঘরে টাঙ্গানো থাকলে শহীদের স্বপ্ন দেখা যাবে। বালিশের পাশে নিয়ে ঘুমালে রাতে জান্নাতের আত্মার সাথে আমার কোলাকুলি হবে। মেজ ভাই ইসাহাক প্যান্টস, শার্ট পরে আবারও কক্ষে প্রবেশ করে বললেন, আমার স্কুলের সময় হয়েছে। আমি একটু স্কুল থেকে ঘুরে আসি। আপনারা আজকে থাকবেন। আমরা থাকার অপারগতা প্রকাশ করলাম। কেননা কাজ ছিল প্রচুর, সময়ের তুলনায়। শহীদ আসগর আলী সম্পর্কে কিছু লেখার অনুরোধ জানিয়ে তাঁকে আমাদের রা: বি: শাখার সেক্রেটারী মাইনুল ভাইয়ের ঠিকানা দিয়ে দিলাম। আমাদের উঠে আসার সময় হতে চলল। এখনও আম্মার সঙ্গে সাক্ষাত হয়নি। আম্মাকে আসার ব্যবস'া করে দেয়া হল। আমরা সবাই দাঁড়িয়ে সালাম জানালাম। আমাদের সম্মুখের খাটে তিনি বসলেন। কিন' না, তিনি একটা কথাও বলতে পারলেন না, কাঁদতে শুরু করলেন। পরিবেশ হালকা করার জন্য অন্য প্রসঙ্গে কিছু কথা বললাম।
শহীদ আসগর বাড়ি এলে মায়ের কাছে বসে প্রাণ খুলে কথা বলতেন। শরীরের প্রতি যত্ন নেয়া, বেশি কাজ না করা ইত্যাদির পরামর্শ দিতেন। মাকে ভালবাসতেন প্রাণ খুলে। আর সেজন্যই কাঁদতে কাঁদতে মায়ের চোখ নষ্ট হওয়ার উপক্রম। চোখে এখন ভাল দেখতেও পান না। শরীরও প্রায় ভগ্নদশা।
মা একদিন হঠাৎ রাতে স্বপ্ন দেখছেন, তিনজন বন্ধুকে নিয়ে আসগর বাড়িতে বেড়াতে এলো কিন' বসলো না, কিছু খেলো না। মা ভাবছেন মানুষ সাথে করে বাড়িতে এলো, না খেয়ে চলে যাচ্ছে কেমন হল! শহীদ আসগর মাকে বলল, “আমি খুব সুখে আছি মা, আমি মরিনি, বেঁচে আছি।” সত্যিই শহীদেরা মরে যায় না। তারা বেঁচে থাকে কিন' তা দৃশ্যপটে নয়। (যারা আল্লাহর পথে শহীদ হয় তাদেরকে তোমরা মৃত বলোনা, বরং তারা জীবিত- সূরা বাকারাঃ ১৫৪) পিতা-মাতার বড় সন-ান আসগর আলীর বড় শখ ছিল বৃদ্ধ মাতার সেবা করার। পড়াশুনা শেষ করে মাকে নিয়ে শহরে থাকবে। কাজ কর্ম করতে দেবে না। ভালমন্দ খাওয়াবে, চিকিৎসা করাবে।
যোহরের নামাজের সময় হতে চলল। নামাজের আগেই কবর জিয়ারতের কাজটি সম্পন্ন করতে পারলে ভাল হত। সবাই আমার প্রস-াবনায় সদয় সম্মতি প্রকাশ করল। আগে নাকি কেউ খুব বেশি সাহস করত না কবর স'ানে যাওয়ার জন্য। কেন জানি ভয় ভয় করত। আসগর ভাইয়ের কবর হওয়ায় এখন কবরস'ান উজ্জ্বল মনে হয়। কেউ আর সেখানে যেতে ভয় পায় না। কবরস'ানে একটা সুন্দর ডাহুক পাখি প্রায় সময় দেখা যেত। মানুষেরা ধরতে গেলে পাখিটি দৌড়ে গিয়ে কবরে ঢুকে পড়ত। ডাহুক পাখিটি মাঝে মধ্যে আসগর ভাইয়ের ঘরের চালে বসত। পাখিটি একদিন নাকি উঠানেও এসেছিল। ঘুরাঘুরি করে চলে গেছে। একদিন এক লোক কবরস'ানে ডাহুকটিকে ধরার জন্য তাড়া করেছিল। রাতে স্বপ্নে ডাহুকটি একজন সুন্দর মানুষ আকৃতিতে পাগড়ী পরে এসে লোকটিকে কড়া ভাষায় নিষেধ করে যে, তাকে যেন তাড়া করে বিরক্ত না করে। তারপর থেকে (লেখা পর্যন-) কবরস'ানে ডাহুকটি আর দেখা যায়নি। কথাগুলি পিতা আমাদেরকে খুব উৎকন্ঠার সাথে শুনাচ্ছিলেন। কবরস'ানের দিকে যতই এগুচ্ছি ততই আমার শরীরে অজানা শিহরণ উদ্বেলিত হচ্ছে। কিভাবে পাপদগ্ধ এই হাতে ফরিয়াদ করি।
কবরস'ানের মাটি (ভিটে) অন্যান্য জমি থেকে কিছুটা উঁচু, এটেল মাটি। মাটির অন-র সব ফাটা ফাটা মনে হল। মনে হয় শহীদের জন্য কেঁদেছে বহুদিন। চোখের পানি শেষ হয়ে গেছে হৃদয়ে তার হাহাকার শুকনা কাষ্ঠফলক। গাছগুলি বিদীর্ণ, পাতাগুলি ফিকে। হায়রে ধৈর্যের ওহুদ পাহাড়সম মাটি। তোমার নিচ্ছিদ্র অঙ্গের ওপর যারা কুপিয়ে কুপিয়ে হত্যা করেছে মসজিদে যাওয়া আসগরকে, তাদেরকে তুমি কিছুই বললে না? হাত রক্তে রঞ্জিত করে উল্লাসে ফেটে পড়েছে, অট্টহাসিতে প্রতিধ্বনিত হয়েছে আমীর আলী হল। তুমি কেন সুপ্ত আগ্নেয়গিরির মত তপ্ত উদগীরন সৃষ্টি করলে না? তোমার সকল ্লায়ুতন্ত্র সক্রিয় করে ভালবাসা দিও তোমার প্রিয় মানুষটিকে হে কবরস'ান। আমার পাপ দগ্ধ হাতে তোমার হৃদয় দ্রবীভূত হবেনা জানি। তবে যাবার আগে শহীদের পিতাকে সাথে নিয়ে বলে গেলাম, বিভীষিকাময় কিয়ামতের দিনে খোদার এজলাসে এ হত্যার বিচার চেও। তুমি অভিমান করে থেকো, শহীদকে জান্নাতে না দেয়া পর্যন- যেন তোমার অভিমান থাকে। হে কবরস'ানের পবিত্র আত্মার স্রষ্টা আমাদের ক্ষমা করো, খুন ঝরা আঁকাবাঁকা পথে আমাদের পরিবেশ অনুকূল করে দিও। কবর জিয়ারত শেষ করে এসে সবাই মিলে মসজিদে যোহরের নামাজ পড়ালাম। এভাবেই বিদায় বেলা ঘনিয়ে এলো।
মটর যানে ছুটে চললাম শহীদ আসগরের প্রিয় মানুষের কাছে। আফিফা তাজরেমিন। মাত্র তিন বছরের ছোট্ট অবুঝ শিশুকে রেখে শাহাদাতের পিয়ালা পান করেছিলেন শহীদ আসগর আলী। মাথার মধ্যে উত্তরহীন নানান জটিল প্রশ্ন স'ানাভাবে ঘুরপাক খাচ্ছে। নিশ্চয় অনেক বড় হয়েছে। বুঝতে শিখেছে। যদি প্রশ্ন করে, আমার পিতাকে কারা হত্যা করেছে? কেন বিচার হল না? আপনারা কী করছেন? তাহলে কী বলব? উত্তরতো জানি না। কাজেই নীরব থাকতে হবে কিছুক্ষণ। তারপর বলব, মাগো তুমি যেদিন প্রধানমন্ত্রী হবে সেদিন তোমার পিতার হত্যাকারীদের বিচার করো যেমনটি করে আজকে প্রধানমন্ত্রীরা।
দিনাজপুর শহরের পুলহাট। ভাবী তার পিতার বাড়িতে প্রিয় কন্যা আফিফাকে নিয়ে বাস করেন। দেখে আমার বুঝতে একটুও কষ্ট হলোনা যে বিধবা নারীর শোকগুলি শক্তিতে পরিণত হয়েছে। প্রথমে আমার সংক্ষিপ্ত বর্ণনায় যে সম্মতি প্রকাশ করে বলল, আমিওতো তাই জানতাম। আমি আবার শুর করলাম। শহীদেরা আমাদের ধন, প্রেরণার উৎস। তাদের জীবন চরিত্র আমল আখলাক অন্যান্য সব মানুষ থেকে কিছুটা স্বতন্ত্র। সুতরাং তাদের দৈনন্দিন কার্যকলাপ আমরা যত্নের সাথে সংগ্রহ করে আগামী শতাব্দীর নতুন প্রজন্মকে জানাতে চাই। তাদের স্মৃতিকে আমরা ধরে রাখতে চাই চির অম্লান করে। আপনি আপনার প্রিয় মানুষটিকে নিয়ে কিছু কথা লিখে দিলে আমরা চিরকৃতজ্ঞ থাকবো। কথাগুলি শুনে ভাবী বললেন, “আমি কি আপনাদের সাথে এ ব্যাপারে একমত হতে পারব?” আবেগপূর্ণ বাক্যটির যে এত ওজন হবে তা আমি বুঝতে পারিনি। আমার কাছে তখন মনে হল, বিশাল কেওক্রাডাং পর্বত দু’ভাগে ভাগ হয়ে আমার ঠোঁট যুগল চেপে ধরল।
ইতোমধ্যে আফিফার নানাভাই আমাদের কাছে এলেন। আমরা তাঁকে সালাম জানালাম। সহাস্যে উত্তর দিয়ে বসতে বললেন। ভদ্র বৃদ্ধের চোখ নষ্ট হয়ে গেছে। দু'চোখে কিছুই দেখেন না। রক্তাক্ত মতিহারে শহীদ আসগরের স্মৃতিকে ধরে রাখার জন্য দু’চারটি কথা শোনার জন্য আমরা আপনাদের শরণাপন্ন হয়েছি, একথা শুনে তিনি যার পর নাই- খুশি হলেন। উৎসাহ দিলেন। কথার ফাঁকে ফাঁকে দু’বার জিজ্ঞাসা করেছি আফিফা কোথায়? স্কুলে গেছে এখনও ফিরেনি- ভাবী বললেন। ছবিতে দেখেছি চোখে দেখিনি। চোখে দেখে যাওয়ার অসামান্য কৌতুহল আমাদের থেকেই যাচ্ছে। আবারও বললেন ভাবী, ‘প্রতিদিন এতক্ষণ চলে আসে। আসার সময় হয়ে গেছে। এখনই চলে আসবে হয়ত।’ কিন' না, আসছে না। হয়তো আমাদের আগ্রহ বুঝতে পেরেই ভাবী ছবি এনে দেখালেন। হ্যাপি বার্থ ডে-এ তোলা। তিন বছরের আফিফা আজ ত্রয়োদশে হাঁটছে। কল্পনার আফিফাকে ছবিতে দেখে আমার বিশ্বাসের অসারাংশ বাদ পড়ল। এই সেই তিন বছরের আফিফা তাজরেমিন, যাকে ্লেহের জননী আজ তেরটি বছর বুকের পাঁজরে আগলে রেখেছেন। ছবি দেখে আমার চোখ ফেটে অশ্রু বেরুতে চাচ্ছে কিন' পুরুষ মানুষ, এত মানুষের মধ্যে কাঁদতে পারলাম না। আফিফার পিতা বেঁচে নেই, মা-ই পিতা, মা-ই মাতা। জননীর চাওয়া পাওয়ার আঁধারের মানিক আফিফা। জননীর না পাওয়ার পাওয়া, অগতির গতি, অসহায়ার একমাত্র সম্বল আফিফা। ঈদের দিনের প্রচন্ড খুশিতেও আফিফার খুশি থেকে যায় অসম্পূর্ণ। ঈদ আসলে ছেলে-মেয়েরা বাবার কাছে নতুন জামা চায়, খেলনা চায়, টাকা চায়। কে দিবে এই মেয়েটিকে চাওয়ার পূরণ করে?
শহীদ আসগর রাজশাহী থেকে বাড়ি এলে নিষ্পাপ আফিফা দৌড়ে গিয়ে বাবার কোলে উঠত। বাবা নিষ্পাপ মেয়ের কপালে চুমু খেতেন, আদর দিয়ে সোহাগ দিয়ে ভরে দিতেন আফিফার মুখ, চোখ দিয়ে খুশি ঠিকরে পড়ত। বাবার কাছে অভিযোগ করে আফিফা বলত, ‘আব্বু, আম্মু আমাকে মেরেছে।’ এইত মামনি আমি এসেছি আর তোমার আম্মু তোমাকে মারতে পারবেনা, আমি তোমার আম্মুকে মারবো। কোলে নিয়ে দীর্ঘক্ষণ উঠানে পায়চারী করতেন। আফিফার অভিযোগ শ্রবণকারী সুখ ও দুঃখের ভাগিদার প্রিয় আব্বু চির নিদ্রায় শায়িত কবরস'ানে। ওর সুন্দর নিদ্রা কেউ যেন না ভাঙ্গে এ অনুরোধ সকলের প্রতি।
শহীদ আসগরের শালীনতা, ব্যক্তিত্ব, কর্তব্যনিষ্ঠা যেমন ছিল অনুকরণীয় আমলি জিন্দেগী তেমন ছিল নির্মল। সর্বশেষ রাজশাহী যাওয়ার পূর্বে শহীদ আসগরের একটি লুঙ্গির প্রয়োজন ছিল। শহীদের পিতা ছেলের জন্য একটা ভাল লুঙ্গি কিনে দিলেন। শহীদ আসগর বললেন, ‘রাজশাহীতে প্রায় সময় প্যান্ট পরেই থাকি, লুঙ্গি তেমন পরাই হয়না। এত ভাল লুঙ্গি না কিনলেও পারতেন আব্বা।’ পিতার দেয়া শেষ লুঙ্গিটি নিয়ে শহীদ আসগর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েছিলেন। আর ফিরে আসেন নি জীবন নিয়ে, ফিরে এসেছিলেন সাদা কাপড়ের কফিনে। তখন সময় ছিল সকাল দশটা, শনিবার, ১৯ নভেম্বর’৮৮ ইং।
(লেখক: সাবেক সভাপতি, শহীদ শামসুজ্জোহা হল, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়)

কোন মন্তব্য নেই: