বৃহস্পতিবার, ৩০ ডিসেম্বর, ২০১০

ঈমানের মানদণ্ড

সূরা আত-তাওবা আয়াত নং- ২৩, ২৪

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تَتَّخِذُوا آبَاءَكُمْ وَإِخْوَانَكُمْ أَوْلِيَاءَ إِنِ اسْتَحَبُّوا الْكُفْرَ عَلَى الْإِيمَانِ ۚ وَمَن يَتَوَلَّهُم مِّنكُمْ فَأُولَٰئِكَ هُمُ الظَّالِمُونَ ـ قُلْ إِن كَانَ آبَاؤُكُمْ وَأَبْنَاؤُكُمْ وَإِخْوَانُكُمْ وَأَزْوَاجُكُمْ وَعَشِيرَتُكُمْ وَأَمْوَالٌ اقْتَرَفْتُمُوهَا وَتِجَارَةٌ تَخْشَوْنَ كَسَادَهَا وَمَسَاكِنُ تَرْضَوْنَهَا أَحَبَّ إِلَيْكُم مِّنَ اللَّهِ وَرَسُولِهِ وَجِهَادٍ فِي سَبِيلِهِ فَتَرَبَّصُوا حَتَّىٰ يَأْتِيَ اللَّهُ بِأَمْرِهِ ۗ وَاللَّهُ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الْفَاسِقِينَ ـ উৎসঃ সূরা আত-তাওবা, يَا أَيُّهَا - ওহে, الَّذِينَ - যারা, آمَنُوا - ঈমান এনেছ, لَا - না, تَتَّخِذُوا - তোমরা গ্রহণ করো, آبَاءَكُمْ - তোমাদের বাপ-দাদাদেরকে, َإِخْوَانَكُمْ- তোমাদের ভাইদেরকে, أَوْلِيَاءَ - অভিভাবরূপে, إِنِ - যদি, اسْتَحَبُّوا - তারা ভালবাসে, الْكُفْرَ - কুফরীকে, عَلَى الْإِيمَانِ- ঈমানের পরিবর্তে, وَ- এবং, مَن- যে, يَتَوَلَّهُم - তাদেরকে অন্তরঙ্গরূপে গ্রহণ করবে, مِّنكُمْ - তোমাদের মধ্য হতে, فَأُولَٰئِكَ - তবে ঐসব লোক, الظَّالِمُونَ - যালেম, قُلْ - বল إِن - যদি, كَانَ - হয়, آبَاؤُكُمْ - তোমাদের বাপ-দাদারা, وَأَبْنَاؤُكُمْ - তোমাদের সন্তানরা, وَإِخْوَانُكُمْ - তোমাদের ভাইয়েরা, وَأَزْوَاجُكُمْ - তোমাদের স্ত্রীরা, وَعَشِيرَتُكُمْ - তোমাদের স্বজনগোষ্ঠী, أَمْوَالٌ- মালসম্পদ, اقْتَرَفْتُمُوهَا - যা তোমরা অর্জন করেছ, تِجَارَةٌ - ব্যবসা, تَخْشَوْنَ - তোমরা ভয় কর, كَسَادَهَا - যারা মন্দা পড়ার, مَسَاكِنُ - বাসস্থানসমূহ, تَرْضَوْنَهَا - যা তোমরা পছন্দ কর, أَحَبَّ - অধিক প্রিয়,جِهَادٍ- জিহাদ, سَبِيلِه- রাস্তা বা পথ, فَتَرَبَّصُوا -তবে তোমরা অপেক্ষা কর, حَتَّىٰ- যতক্ষণ না, يَأْتِيَ - নিয়ে আসেন, بِأَمْرِهِ - তাঁর নির্দেশকে, সিদ্ধান্ত, لَا - না, يَهْدِي - পথ দেখান, الْقَوْمَ - জাতিকে, الْفَاسِقِينَ - যারা সত্যত্যাগী। নামকরণ: এ সূরা দুইটি নামে পরিচিতি। প্রথম নাম আত-তাওবা আর দ্বিতীয় নাম বারায়াত। এ সূরার এক স্থানে কোন কোন ঈমানদার লোকদের দ্বিতীয় গুনাহসমূহ মাফ করে দেয়ার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। আর বারায়াত অর্থ সম্পর্কচ্ছেদ। মুশরিকদের সাথে সম্পর্কছেদের ঘোষণা এ সূরার শুরুতেই করা হয়েছে। সূরার শুরুতে বিসমিল্লাহ না লেখার কারণ: এ সূরার শুরুতে বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম না লেখার বিভিন্ন কারণ তাফসীরকারগণ উল্লেখ করেছেন। কিন্তু ঈমাম রাযী (র) যে কারণটি উল্লেখ করেছেন তাই সঠিক বলে মনে হয়। তাহলে নবী করীম (সা) নিজেই এ সূরার শুরুতে বিসমিল্লাহ লেকাননি। এ কারণে সাহাবায়ে কিরামও তা লেখেননি। পরবর্তী কালের লোকেরাও একই নীতি অনুসরণ করেছেন। কুরআন মজীদকে নবী করীম (সা) থেকে যথাযথভাবে গ্রহণ ও পূর্ণমাত্রায় সংরক্ষিত রাখার ব্যাপারে যে কতদূর সতর্কতা অবলম্বন করা হয়েছে, এটা তার অন্যতম প্রমাণ। নাযিল হওয়ার সময়কাল ও সূরার বিভিন্ন অংশ: সূরাটি তিনটি ভাষণে শেষ হয়েছে। প্রথম ভাষণটি সূরার শুরু থেকে ৫ম রুকূর শেষ পর্যন্ত। তা নাযিল হওয়ার সময় হচ্ছে নবম হিজরীর যিলকাদ মাসের নিকটবর্তী কোন সময়। নবী করীম (সা) এ বছর হযরত আবু বকর (রা) কে আমীরুল হজ্জ (হজ্জের অনুষ্ঠান


لاَ تَجِدُ قَوْمًا يُّؤْمِنُوْنَ بِاللهِ وَالْيَوْمِ الاخِرِ ................. مِنْ تَحْتِهَا الاَنْهرُ ـ
মহানবী (সা) বলেন: لاَ يُؤْمِنُ اَحَدَكُمْ حَتّى اَكُوْنَ اَحَبًَّ اِلَيْهِ مِنْ وَالد.............
�َتّى اَكُوْنَ اَحَبًَّ اِلَيْهِ مِنْ وَالدِهِ وَوَلَدِهِ وَالنَّاسِ اَجْمَعِيْنَ ـ “তোমাদের কোন ব্যক্তি মুমিন হতে পারে না যতক্ষণ না আমি তার কাছে তার পিতামাতা, সন্তান-সন্ততি ও মানুষের চাইতে বেশী প্রিয় হই”। (বুখারী ও মুসলিম) قُلْ إِن كَانَ آبَاؤُكُمْ وَأَبْنَاؤُكُمْ وَإِخْوَانُكُمْ وَأَزْوَاجُكُمْ وَعَشِيرَتُكُمْ وَأَمْوَالٌ اقْتَرَفْتُمُوهَا وَتِجَارَةٌ تَخْشَوْنَ كَسَادَهَا وَمَسَاكِنُ تَرْضَوْنَهَا أَحَبَّ إِلَيْكُم مِّنَ اللَّهِ وَرَسُولِهِ وَجِهَادٍ فِي سَبِيلِهِ فَتَرَبَّصُوا حَتَّىٰ يَأْتِيَ اللَّهُ بِأَمْرِهِ ۗ وَاللَّهُ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الْفَاسِقِينَ ـ অর্থ: বল, তোমাদের নিকট যদি তোমাদের পিতা তোমাদের সন্তান, তোমাদের ভাই তোমাদের পতœী,তোমাদের গোত্র তোমাদের অর্জিত ধন-সম্পদ,তোমাদের ব্যবসা যা বন্ধ হয়ে যাওয়ার ভয় কর এবং তোমাদের বাসস্থান-যাকে তোমরা পছন্দ কর-আল্লাহ,তাঁর রসূল ও তাঁর রাহে জেহাদ করা থেকে অধিক প্রিয় হয়,তবে অপেক্ষা কর,আল্লাহর বিধান আসা পর্যন্ত,আর আল্লাহ ফাসেক সম্প্রদায়কে হেদায়েত করেন না। এই সূরার ২৪ তম আয়াতটি নাযিল হয় মূলত ওদের ব্যাপারে যারা হিজরতের আদেশ দেয়ার পরও মক্কা থেকে হিজরত করেনি। মাতা-পিতা, ভাই-বোন, সন্তান-সন্ততি, স্ত্রী-পরিবার ও অর্থ-সম্পদের মায়া হিজরতের নির্দেশ পালনে এদের বিরত রাখে। এদের সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা নবী করীম (সা) কে নির্দেশ দেন, আপনি তাদের বলে দিন, “যদি তোমাদের পিতা, তোমাদের সন্তান, তোমাদের ভাই, তোমাদের স্ত্রী, তোমাদের আত্মীয়-স্বজন, তোমাদের উপার্জিত সম্পদ, তোমাদের সে ব্যবসায় যার মন্দা, হওয়াকে তোমরা ভয় কর এবং তোমাদের বাসস্থান, যাকে তোমরা খুব পছন্দ করে- এসব যদি আল্লাহ, তাঁর রাসূল ও তাঁর পথে জিহাদ করার চাইতে তোমাদের কাছে বেশী প্রিয় হয় তাহলে আল্লাহর বিধান তোমাদের কাছে না আসা পর্যন্ত অপেক্ষা কর। আল্লাহ পাপিষ্ঠ সম্প্রদায়কে কখনও সত্য পথের সন্ধান দেন না। এ আয়াতে আল্লাহ তায়ালার বিধান আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করার যে কথা আছে, তৎসম্পর্কে তাফসীর শাস্ত্রের ইমাম হযরত মুজাহিদ (র) বলেন, এখানে ‘বিধান’ অর্থে যুদ্ধ-বিগ্রহ ও মক্কা জয়ের আদেশ। বাক্যের মর্ম হলো, যারা দুনিয়াবী সম্পর্কের জন্য আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সম্পর্ককে জলাঞ্জলি দিচ্ছে, তাদের করুণ পরিণতির দিন সমাগত। মক্কা যখন বিজিত হবে আর এ সকল নাফরমানেরা লাঞ্ছিত ও অপদস্ত হবে, তখন দুনিয়াবী সম্পর্ক তাদের কোন কাজে আসবে না। হযরত হাসান বসরী (র) বলেন, এখানে বিধান অর্থ আল্লাহর আযাবের বিধান। অর্থাৎ আখেরাতের সম্পর্কের উপর যারা দুনিয়াবী সম্পর্ককে প্রাধান্য দিয়ে হিজরত থেকে বিরত রয়েছে, আল্লাহর আযাব অতি শীঘ্র তাদের গ্রাস করবে। দুনিয়ার মধ্যেই এ আযাব আসতে পারে। অন্যথা আখেরাতাতের আযাব তো আছেই। সবেমাত্র হিজরতের আদেশ দেয়া হলো। এতেই অনেকের হাঁফ ছেড়ে বাঁচার অবস্থা। কিন্তু অচিরেই আসবে জিহাদের আদেশ, যে আদেশ পালনে আল্লাহ ও রাসূলের জন্য সকল বস্তুর মায়া, এমনকি প্রাণের মায়া পর্যন্ত ত্যাগ করতে হবে। আয়াতের শেষ বাক্য হলো- وَاللَّهُ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الْفَاسِقِينَ ـ “আল্লাহ ফাসেক সম্প্রদায়ক হোদায়াত করেন না”। এতে বলা হয যে, যারা হিজরতের আদেশ পাওয়া সত্ত্বেও দুনিয়াবী সম্পর্ককে প্রাধান দিয়ে আত্মীয়-স্বজন এবং অর্থ-সম্পদ বুকে জড়িয়ে বসে আছে। তাদের এ আচরণ দুনিয়াতেও কোন কাজ দিবে না এবং তারা আত্মীয়-স্বজন পরিবেষ্টিত অবস্থায় স্বগৃহে আরাম-আয়েশ ও ভোগের যে আশা পোষণ করে আছে, তা পূরণ হওয়ার নয়; বরং জিহাদের দামামা বেজে উঠার পর সকল সহায়-সম্পত্তি তাদের জন্য অভিশাপ হয়ে দাঁড়াবে। কারণ আল্লাহর রীতি হল, তিনি নাফরমান সম্প্রদায়ের উদ্দেশ্য পূরণ করেন না। উপসংহারে বলা যায়, ইসলামী আকীদা-বিশ্বাস মনের অভ্যন্তরেও কোনো অংশীদার সহ্য করে না। ইসলামকে একনিষ্ঠভাবেই গ্রহণ করতে হবে। তাই বলে মুসলমানদেরকে তাদের পিতা-মাতা, আত্মীয়-স্বজন, সহায়-সম্পদ ও সুখ-আনন্দভোগ ত্যাগ করে ভৈরাগ্য অবলম্বন করতে বলা হয়নি। শুধু বলা হয়েছে- মুমিনদের অন্তরে ইসলামের ভালোবাসা যেন একনিষ্ঠ ও বিশুদ্ধ হয়। একমাত্র এর দ্বারাই যেন সে পরিচালিত ও উদ্বুদ্ধ হয়। এরূপ হলে জীবনের সকল হালাল ও পবিত্র সুখ ও আনন্দ উপভোগ করায় কোনো আপত্তি নেই, তবে পার্থিব সুখ যখন ইসলামের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়, তখন তাকে পুরোপুরিভাবে ছুঁড়ে ফেলার জন্য প্রস্তুত থাকা চাই। উভয়ের মধ্যে পার্থক্য বুঝা যাবে এভাবে যে, ইসলাম ও বৈষয়িক স্বার্থ-এ দু’টোর মধ্যে কোনটা অগ্রাধিকার পাচ্ছে। যদি ইসলাম অগ্রাধিকার পায় এবং কোেেনা মুসলমান যদি নিশ্চিত হয় যে, ইসলামের প্রতি তার ভালোবাসা ও নিষ্ঠায় কোনো ভেজাল নেই, তাহলে সন্তান-সন্ততি, পিতা-মাতা, ভাই-বোন, আত্মীয়-স্বজন, ধন-সম্পদ, বাড়ী-ঘর ও ব্যবসা-বাণিজ্য ইত্যাদিকে উপভোগ করা দোষণীয় নয়। অহংকার ও অপব্যয়-অপচয় ছাড়া হালাল পার্থিব সম্পদ ভোগ করায়ও আপত্তি নেই। বরং তখন আল্লাহর নিয়ামত ভেবে তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতার মনোভাব নিয়েউপভোগ করা আরো পুণ্যের কাজ হবে। ‘হে ঈমানদারগণ‍! তোমাদের পিতা-মাতা ও ভাই-বোন যদি ঈমানের ওপর কুফরীকে অগ্রাধিকার দেয়, তাহলে তাদেরকে প্রিয়জন হিসেবে গ্রহণ করে না.......’। ইসলামের দৃষ্টিতে মনের সাথে ইসলামের সম্পর্ক যেখানে ছিন্ন হবে, সেখানে রক্ত ও বংশের সম্পর্কও ছিন্ন হয়ে যাবে। আল্লাহর সাথে যখন ঘনিষ্ঠতা থাকবে না, তখন পরিবার-পরিজনের সাথেও ঘনিষ্ঠতা থাকবে না। আল্লাহর সাথে যে ঘনিষ্ঠতা ও আত্মীয়তা, সেটাই সর্বোচ্চ ও সর্বপ্রথম আত্মীয়তা এবং তাঁর সাথেই সমগ্র মানবজাতি যুক্ত। আল্লাহর সাথে যদি প্রীতির সম্পর্ক না থাকে, তবে আর কারো সাথেই তা থাকতে পারে না। ‘যারা তাদেরকে প্রিয়জন মনে করবে, তারা যালেম’। এখানে ‘যালেম’ শব্দ দ্বারা মুশরিক বুঝানো হয়েছে এবং যে আত্মীয় কুফরীকে ঈমানের ওপর স্থান দেয়, সে আত্মীয়কে আত্মীয় হিসাবে গ্রহণ করাই ঈমানের পরিপন্থী। এখানে শুদু নীতি ও আদর্শই তাত্ত্বিকভাবে বর্ণনা করা হয়নি, বরং বিভিন্ন প্রকারের সম্পর্ক এবং সুখ ও আনন্দের বিবরণ দেয়া হয়েছে। প্রকারের সম্পর্ক সম্পদ এবং সুখ ও আনন্দের বিবরণ দেয়া হয়েছে। অত:পর এগুলোকে এক পাশে এবং ইসলামী আকীদা, আদর্শ ও তার দাবি অপর পাশে রাখা হয়েছে। এক পাশে রাখা হয়েছে পিতা-মাত, ছেলে-মেয়ে, ভাই-বোন, স্ত্রী ও গোত্রকে, রক্ত, বংশ, আত্মীয়তা ও দাম্পত্য সম্পর্কের উপাদান হিসেবে, সহায়-সম্পদ ও ব্যবসা-বাণিজ্যকে স্বাভাবসুলভ মোহ ও লোবের উপাদান হিসেবে, অপর পাশে রাখা হয়েছে আল্লাহ, রাসূল ও আল্লাহর পথে জিহাদের প্রতি ভালবাসাকে। আর জিহাদ বলতে জিহাদের সকল দাবি ও সখল দু:খ-কষ্টকে, সকল ত্যাগ ও বঞ্চনাকে, সকল যখম ও শাহাদাতকে এবং সকল যুলুম ও বেদনাকে বুঝানো হয়েছে। এতো সব ত্যাগ ও কষ্টের পরও জিহাদ থেকে যাবে নিরেট ‘আল্লাহর পথে জিহাদ’ হিসাবে। এরজন্য কোনো খ্যাতি, সুনাম ও প্রচার আশা করা যাবে না, কোনো গর্ব, অহংকার ও প্রদর্শনী করা যাবে না এবং পৃথিবীর কারো প্রশংসা ও অভিনন্দন আশা করা যাবে না। অন্যথা এর কোনো সওয়াব ও প্রতিদান পাওয়া যাবে না। ‘বলো, যদি তোমাদের পিতা-মাতা, ছেলে-মেয়ে...........’। (আয়াত-২৪) নি:সন্দেহে এটা খুবই কঠিন কাজ, তবুও এটা করতেই হবে। আল্লাহর রাসূল ও জিহাদকে দিতে হবে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার। নচেত ‘আল্লাহর ফয়সালার অপেক্ষা করো’। অর্থাৎ ফাসেকদের পরিণতির অপেক্ষা করো। আর ফাসেকদের পরিণতি হলো- ‘নিশ্চয় আল্লাহ ফাসেকদের হেদায়াত করেন না’। এই নিষ্ঠা ও একাগ্রতা শুধু ব্যক্তির কাছ থেকে নয়, বরং সমগ্র মুসলিম সমাজ ও রাষ্ট্রের কাছ থেকে চাওয়া হচ্ছে। কোনো সম্পর্ক ও স্বার্থকে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস ও আল্লাহর পথে জিহাদের দাবির ঊর্ধ্বে তোলা যাবে না। এই নিষ্ঠা ও একাগ্রতা বাস্তবায়নের জন্য আল্লাহ মুসলমানদেরকে যে নির্দেশ দিয়েছেন, তা একথা জেনেই দিয়েছেন যে, এটা করতে তারা সক্ষম ও সমর্থ, অন্যথা নির্দেশ দিতেন না। কারণ আল্লাহ কারো সাধ্য বহির্ভূত কাজের আদেশ দেন না। এটা মানুষের ওপর আল্লাহর বিরাট করুণা ও অনুগ্রহ যে, তাদেরকে এতো উচ্চাংগের নিষ্ঠা ও সহনশীলতা দান করেছেন, এই নিষ্ঠাকে তিনি এতো মজাদার বানিয়েছেন যে, পৃথিবীর আর কোনো জিনিস এতো মজাদার নয়। আল্লাহর সাথে মিলিত হওয়ার আবেগ ও অনুভূতির মজা, আল্লাহর সন্তোষ লাভের আশা পোষণ করার মজা এবং পার্থিব হীন স্বার্থের মোহ ও নৈতিক অধ:পতনের ঊর্ধ্বে ওঠার মজা, এসব মজার সাথে দুনিয়ার আর কোনো মজা, স্বাদ, আনন্দ ও তৃপ্তির কোনো তুলনা হয় না। শিক্ষা: ১) পিতা-মাতার আনুগত্য করা যাবে না যদি তারা ঈমান অপেক্ষা কুফরকে অধিক ভালোবাসে। তবে তাদের সাথে পার্থিব সম্ভাব বজায় রাখতে হবে। ২) দীনি সম্পর্কের উপর দুনিয়াবী সম্পর্ককে প্রাধান্য দেয়া যাবে না। ৩) আল্লাহ, রাসূল ও জিহাদকে দুনিয়ার সকল স্বার্থের  িহাদকে দুনিয়ার সকল স্বার্থের ঊর্ধ্বে স্থান দিতে হবে। ৪) দুনিয়ার সুখ-সুবিধা ও স্বার্থকে পেছনে ফেলে ইকামাতে দীনের দাবিকে অগ্রাধিকার দিলেই ঈমানের দাবি পূরণ হবে। ৫) নাফরমান সম্প্রদায়কে আল্লাহ হেদায়াত দেন না। বাস্তবায়ন: সূরা তাওবার ২৩ ও ২৪ নং আয়াতের শিক্ষাগুলো আমাদের ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে বাস্তবায়নের জন্য আমরা যেন মনেপ্রাণে চেষ্টা করি। আল্লাহর সকল আদেশ পালন করে এবং সকল নিষেধ থেকে দূরে থেকে আমরা যেন মুত্তাকী বান্দা হিসাবে আল্লাহর দরবারে গ্রহণীয় হতে পারি সেই তাওফীক কামনা করছি। ওয়ামা তাওফীকি ইল্লা বিল্লাহ।
পরিচালক) নিযুক্ত করে মক্কায় পাঠিয়েছিলেন। এই সময়ই ভাষণটি নাযিল হয়। আর তখনই নবী করীম (সা) হযরত আলী (রা) কে তাঁর পিছনে পিছনে মক্কায় পাঠালেন যেন হজ্জের সম্মেলনে তা পাঠ করে শুনানো হয় এবং এ ভাষণের আলোচ্য বিষয়ের মর্মানুসারে যে কর্মনীতি অবলম্বন করা হয়েছে তা যেন সকলকে জানিয়ে দেয়া হয়। দ্বিতীয় ভাষণটি ষষ্ঠ রুকূর শুরু থেকে ৯ম রূকূর শেষ পর্যন্ত। এটি নবম হিজরীর রজব মাসে বা তার কিছু পূর্বে নাযিল হয়। তখন নবী করীম (সা) তাবুক যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। এতে ঈমানদার লোকদেরকে জিহাদে যোগদানে উৎসাহিত করা হয়। আর যারা মুনাফিকী, ঈমানের দুর্বলতা ও গাফিলতির কারণে আল্লাহর পথে জান-মাল খরচ করতে প্রস্তুত ছিল না তাদেরকে তিরস্কার করা হয়। তৃতীয় ভাষণটি দশম রুকূ থেকে শুরু করে সূরার শেষ পর্যন্ত চলে। এ অংশ তাবুক যুদ্ধ থেকে প্রত্যাবর্তনকালে নাযিল হয়। এতে এমন কতগুলো অংশও রয়েছে যা উক্ত সময়ের বিভিন্ন পর্যায়ে নাযিল হয়েছে। পরে নবী করীম (সা) আল্লাহর নির্দেশ অনুসারে এসব কয়টি ভাষণকে একত্র করে একই ভাষণের ধারাবাহিকতায় বিন্যাস্ত করেন। এ অংশ কয়টি একই বিষয় সম্পর্কিত। এতে মুনাফিকদের তম্বিহ (সতর্ক) করা হয়েছে। তাবুক যুদ্ধে যারা যোগদান করেনি তাদের ভৎর্সনা করা হয়েছে। আর যেসব লোক সত্যিকারভাবে ঈমানদার থাকা সত্ত্বেও আল্লাহর পথে জিহাদ অংশগ্রহণ থেকে বিরত থেকেছিল, তাদের জন্য ক্ষমা ঘোষণা করা হয়। এ সূরার বিভিন্ন অংশ নাযিলের ধারাবাহিকতার দৃষ্টিতে প্রথম ভাষণটির স্থান সর্বশেষে নির্দিষ্ট হওয়া উচিত ছিল: কিন্তু বিষয়স্তুর গুরুত্বের দৃষ্টিতে তার স্থান সর্বপ্রথম এবং অপর ভাষণ দুইটিকে শেষে রাখা হয়েছে বলে মনে হয়। ঐতিহাসিক পটভূমি: ঘটনা পরস্পরার সাথে এ সূরার বিষয়বস্তুর যে সম্পর্ক তার সূচনা হয় হুদাইবিয়ার সন্ধি থেকে। হুদাইবিয়ার সন্ধি পর্যন্ত ছয় বছরের নিরবচ্ছিন্ন চেষ্টা ও সাধনা-সংগ্রামের ফল এই হয়েছিল যে, আরবের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ এলাকায় ইসলাম একটি সুসংঘবদ্ধ সমাজের বিধান ও ব্যবস্থা, এক পরিপূর্ণ সভ্যতা ও সংস্কৃতি এবং একটি স্বয়ং সম্পূর্ণ সার্বভৌম রাষ্ট্র ব্যবস্থা হিসাবে পরিচিতি লাভ করেছে। যখন হুদায়বিয়ার সন্ধি সংঘটিত হয়, তখন দীন ইসলাম অপেক্ষাকৃত অধিক শান্তি ও নিরাপত্তাপূর্ণ পরিবেশে চারিদিকে সম্প্রসারিত হওয়ার সুযোগ লাভ করে। অত:পর ঘটনার গতি দু’টি বড় পথে চলতে শুরু করে, যার পরিণামে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ফল প্রকাশিত হয়। তার মধ্যে একটির সম্পর্ক আরবদেশের সাথে, আর অপরটির সম্পর্কে রোমান সাম্রাজ্যের সাথে। আরবদেশের সাথের পরিণামে মক্কা বিজয়, আর রোমান সাম্রাজ্যের সাথের পরিণামে বিনা যুদ্ধে রোম সাম্রাজ্যের প্রভাবাধীন এলাকা মুসলিমদের প্রভাবাধীন হয়। ব্যাখ্যা: (ক) يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تَتَّخِذُوا آبَاءَكُمْ وَإِخْوَانَكُمْ أَوْلِيَاءَ إِنِ اسْتَحَبُّوا الْكُفْرَ عَلَى الْإِيمَانِ ۚ وَمَن يَتَوَلَّهُم مِّنكُمْ فَأُولَٰئِكَ هُمُ الظَّالِمُونَ ـ অর্থ: হে ঈমানদারগণ! তোমরা স্বীয় পিতা ও ভাইদের অভিভাবকরূপে গ্রহণ করো না, যদি তারা ঈমান অপেক্ষা কুফরকে ভালবাসে। আর তোমাদের যারা তাদের অভিভাবকরূপে গ্রহণ করে তারা সীমালংঘনকারী। আত্মীয়তা ও বন্ধুত্বের সকল স্পর্কের উপর আল্লাহ ও রাসূলের সম্পর্ক অগ্রগণ্য। এ দুই সম্পর্কের সাথে সংঘাত দেখা দিলে আত্মীয়তার সম্পর্কে জলাঞ্জলি দিতে হবে। উম্মতের শ্রেষ্ঠ জামায়াতরূপে সাহাবায়ে কেরামের যে জামায়াত গঠিত হয়েছিল, তার মূলে ছিল তাঁদের এ ত্যাগ ও কুরবানী। তাঁরা সর্বক্ষেত্রে সর্বাবস্থায় আল্লাহ ও রাসূলের আনুগত্যকে প্রাধান্য দিয়েছিলেন। তাই আফ্রিকার হযরত বেলাল (রা), রোমের হযরত সোহাইব (রা), পারস্যের হযরত সালমান (রা), মক্কার কুরাইশ ও মদীনার আনসারগণ গভীর ভ্রাতৃত্ব বন্ধনে আবদ্ধ হতে পেরেছিলেন। ইমাম বায়হাকী (র) স্বীয় হাদীস গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন যে, বদরের যুদ্ধের দিন আবু উবায়দা ইবনুল জাররাহ (রা) এর পিতা তাঁর সামনে এসে মূর্তির প্রশংসা করতে শুরু করে দেয়। তিনি তাকে বারবার বিরত রাখার চেষ্টা করেন। কিন্তু সে বিরত না হলে পিতা-পুত্রে যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত আবু উবায়দা (রা) স্বীয় পিতাকে হত্যা করেন। তখন আল্লাহ তায়ালা নিম্নোক্ত আয়াত নাযিল করেন:

কোন মন্তব্য নেই: