মঙ্গলবার, ২১ ডিসেম্বর, ২০১০

মানবতাবিরোধী অপরাধ বিচারের নামে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস

এক সাগর রক্তের বিনিময়ের অর্জিত স্বাধীনতা। দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী সমরে আমাদের প্রত্যাশা ছিল শোষণ মুক্ত, দারিদ্রমুক্ত স্বনির্ভর বাংলাদেশ। যুদ্ধ শেষ হয়েছে প্রায় চল্লিশটি বছর আগে, অথচ স্বাধীনতা নামের সুখপাখিটা আজো আমাদের কাছে অধরাই থেকে গেছে। যে পাকিস্তানী শোষকদের অত্যাচার, নিপীড়ন, বঞ্চনা আর গোলামী থেকে মুক্তি পেতে লড়েছি আমরা, সে দেশের সাধারণ মানুষ আজো গোলামীর জিঞ্জিরে বন্দী। দারিদ্রের ভয়াবহতা বেড়েছে, নির্যাতনের তীব্রতা বেড়েছে, মানবতা বিরোধী অপরাধের মাত্রা বেড়েছে। বেড়েছে বর্ণবাদ, বিভাজন আর হিংসার রাজনীতি। রাজা যায় রাজা আসে, সাধারণ মানুষের তাতে কিই বা যায় আসে। পাকিস্তানী নরপিশাচেরা বিতাড়িত হয়েছে, শাসনের ছড়ি আজ ভাইয়ের হাতে। অথচ সে ভাই ভাতৃত্বের ধার ধারে না, ভাইয়ে ভাইয়ে বিভাজনের মাধ্যমে ক্ষমতা পাকাপোক্ত করতেই ব্যস্ত। শত্রুর হাতের চাবুকের আঘাত সওয়া যায়, ভাইয়ের হাতে ফুলের আঘাত যে সয় না। অথচ ভাইয়েরা ফুল নয়, চাবুক নয় বরং ময়না কাটায় ক্ষতবিক্ষত করেছে আপন ভাইয়ের শরীর।

বুঝার মতো বুদ্ধি হওয়ার পর থেকেই জেনে এসেছি বাংলাদেশের এক ক্রান্তিলগ্নে কান্ডারীবিহীন বাংলাদেশী তরীতে শক্তহাতে হাল ধরেছিলেন মেজর জিয়া। যে পঁচিশে মার্চ রাতে বাংলাদেশের নিরীহ জনতার উপর মানুষের বেশে হামলে পড়ে পাকিস্তানী হায়েনার দল, যখন কিছু বীর সেনানী কৌশলগত কারণে ছুটেছে নিরাপদ রনাঙ্গণে,দ্বিগ্বিদিক জ্ঞানশূণ্য নেতানেত্রীরা যখন পালানোর পথ খুঁজে মরেছে বাংলাদেশের প্রতিটি সীমান্তে, তখন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে ভেসে আসে কাঙ্খিত স্বাধীনতা যুদ্ধের ঘোষণা। ২৫শে মার্চের আকস্মিক আক্রমনে যে বাংলাদেশীরা হতবিহ্বল হয়ে পড়েছিলেন, হতাশার গ্লানি ছেয়ে ছিল যাদের হৃদয়ে, স্বাধীনতার বলিষ্ঠ ঘোষণায় সম্বিত ফিরে আসে বাঘা বাংলাদেশীর প্রাণে। আবার ফিরে আসে তারা কাঙ্খিত স্বাধীনতা আন্দোলনে, ঝাপিয়ে পড়ে বীর বিক্রমে নরপিশাচ বধে, ঝাপিয়ে পড়ে মায়ের সম্ভ্রম বাঁচাতে, সন্তানের মুখে হাসি ফোটাতে।
স্বাধীনতার ঘোষণা এমন ছিল না যে শ্রেফ এক অচেনা বাহক চিঠিটি বয়ে এনে পাঠ করে শোনালেন বুঁকের গহীনে লুকিয়ে রাখা ভালোবাসা আর দীর্ঘশ্বাসের গল্প। সংবাদ বাহকের মুখে প্রেমিকের বাণী শুনে কেউ পত্রপাঠকের হাত ধরে বেড়িয়ে পড়ে না প্রেমিকার সন্ধানে। অথচ যিনি স্বাধীনতার ঘোষণা দিলেন, হোক না তা অন্য কারো পক্ষের ঘোষণা, তার আবেদন এতটাই তীব্র ছিল যে যাচাই বাছাইয়ের ধার ধারেনি কেউ, সত্য মিথ্যার পরোয়া করেনি কেউ, জীবন মৃত্যুর হিসেব কষে নি কেউ বরং বজ্রনিনাদে তার নেতৃত্বে ঝাপিয়ে পড়েছে, অসম যুদ্ধে লড়ে লড়ে ছিনিয়ে এনেছে স্বাধীনতা।’ কারণ ইস্যুটি ছিল কাঙ্খিত, স্বাধীনতার ঘোষণা যিনি দিলেন তিনি ছিলেন দেশপ্রেমী হিসেবে পরিক্ষিত ও আস্থাভাজন। নিছক কারো নাম নিয়ে ঘোষণা দিলেই তা কেউ মেনে নেয় না, যদিনা তার নেতৃত্বের ব্যাপারে প্রশ্নাতীত আস্থাশীল হওয়া যায়। আজ আওয়ামী লীগের নেতাককর্মীরা জামায়াত-শিবির নিধনে উদগ্রীব। এমনই সময়ে নাইজেরিয়া সফররত শেখ হাসিনার নাম নিয়ে টেলিভিশনের কোন ঘোষক “জামায়াত-শিবিরকে যেখানে পাওয়া যায় সেখানেই হত্যার” নির্দেশ দেয় তবে তা কেউ মানবে বলে মনে হয় না, বা মানলেও তার দায় কি শেখ হাসিনা নিবেন? সংবাদ পাঠ আর যুদ্ধের ঘোষণা যারা আলাদা করতে জানে না রাজনীতিবিদ বা বুদ্ধিজীবী হিসেবে নিজেদের জাহির করা তাদের সাজে না।
কে দিয়েছিলেন সেই ঘোষণা, বিতর্ক অনেক। চাঁদপুরের চান মিয়া থেকে শুরু করে যদু-মধু-কদু কেউ আর আজ পিছিয়ে নেই স্বাধীনতা ঘোষণার দাবী করায়। অথচ ঘুরে ফিরে ঐ একটি কন্ঠস্বরই শুনতে পায় বিশ্ববাসী, আই মেজর জিয়া…। এমনকি স্বাধীনতার ঘোষণা কে দিয়েছেন তা নির্ণয়ে আদালতও রায় দিয়েছে। অথচ রায় দিয়ে চোর ছ্যাচোর, হত্যাকারীদের মুক্তি দেয়া যায়, নিরপরাধকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেয়া যায়, দিনের পর দিন আইনী হেফাজতের নামে রিমান্ডে শ্লীলতাহানি করা যায় কিন্তু আইনের ভয়ে, আদালতের রায়ে ইতিহাস বদলায় না।
অথচ লাখো শহীদের রক্তের গড়া বাংলাদেশে দাড়িয়ে রাজাকার পরিবারের সদস্য ও একাত্তরে স্বাধীনতা বিরোধীদের পক্ষে সক্রিয় অংশগ্রহণকারী এবং বর্তমান সরকারের আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী এ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম চ্যালেঞ্জ করে বলেন, “জিয়াউর রহমান ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের চর ছিলেন”। খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধকালে পাকিস্তানি সেনাদের সহযোগিতা করার অভিযোগ এনে জাতীয় সংসদের উপনেতা সৈয়দা সাজেদ বলেন, “যুদ্ধকালীন খালেদা জিয়া সেনা তত্ত্বাবধানে থেকে তাদের সহযোগিতা করেছেন, তার কি বিচার হবে না? তারও বিচার হবে।” এভাবে হুমকি ধমতি শোনা যায় আওয়ামী নেতানেত্রীদের মুখে। অথচ স্বাধীনতা যুদ্ধে প্রত্যক্ষ সমরে অংশগ্রহণের অভিজ্ঞতা খুঁজে পাওয়া যায় না আওয়ামী নেতাদের, বরং কোলকাতা বালিগঞ্জের আবাসিক এলাকার বাড়ীতে মন্ত্রীসভার সদস্যদের নিয়ে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিনকে তাস খেলা আর ভোগবিলাসে মত্ত দেখেছেন ৯ নং সেক্টর কমান্ডার।
মূলত একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধটি ছিল বিভিন্ন বাহিনী থেকে বিদ্রোহ করে বেরিয়ে আসা এদেশীয় বীরসন্তান, সাধারণ মুক্তিকামী কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র-জনতার লড়াই। এ লড়াই নির্দিষ্ট কোন দলের লড়াই নয়। আওয়ামী লীগ চেয়েছিল ভারতের আশীর্বাদে স্বাধীনতা, অনেকেই তা মেনে নিয়ে যুদ্ধ করেছে, অনেকে তা না মেনে যুদ্ধ করেছে শুধু মাত্র বাংলাদেশকে ভালোবেসে, আর অনেকেই যুদ্ধ করে নি। স্বাধীনতা যুদ্ধ শেষে আওয়ামী লীগ কেবল দু’টো পক্ষকেই স্বীকৃতি দিয়েছে, ভারতপন্থী মুক্তিযোদ্ধা এবং পাকিস্তানপন্থী স্বাধীনতাবিরোধী। এর বাইরে যে কোন পক্ষ থাকতে পারে, বাংলাদেশ নামে যে আলাদা একটি পক্ষ থাকতে পারে তা তারা মানতে পারে নি। তাই যারা স্বাধীনতার পরে ভারতের আধিপত্যবাদকে মেনে নিতে পারে নি নির্ভেজাল দেশপ্রেমের কারণে, তাদেরকে পাকিস্তানের দালাল বলে নির্যাতন করা হয়েছে, কারারুদ্ধ করা হয়েছে, সমাজে হেয় করা হয়েছে, যাদের অন্যতম ৯ নং সেক্টর কমান্ডার জাসদের প্রতিষ্ঠাতা প্রেসিডেন্ট মেজর জলিল।
স্বাধীনতার পরে সময় যত গড়িয়েছে ভারতপন্থী রজনীতির জমিন ক্রমশ সংকুচিত হয়েছে। স্বাধীনতার সময়ে ভারতভীতির কারণে যে সব ইসলামী দল ও সামাজিক সংগঠন স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরোধিতা করেছে, স্বাধীনতার পরে তারা স্বাধীন বাংলাদেশকে মনে প্রাণে স্বীকার করে নিয়েছে, এবং একাত্তরে যেমন তারা অখন্ড পাকিস্তান রক্ষায় সোচ্চার ছিল, স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে তারাই ভারতীয় আগ্রাসন প্রতিরোধে অতন্ত্র প্রহরীর ভূমিকায় সরব হয়েছে। মূলত দেশপ্রেম ঈমানেরই অংগ আর সে ঈমানের তীব্র অনুভূতি ইসলামী আন্দোলনগুলোকে সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে রুখে দাড়াতে সর্বদা উদ্বুদ্ধ করেছে। আর তাই সময়ের সাথে সাথে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদী শক্তি ও ইসলামী আন্দোলনগুলোর মাঝে দূরত্ব কমেছে, জনপ্রিয়তা বেড়েছে এবং “ভারত নয়,পাকিস্তান নয় বরং বাংলাদেশের স্বার্থই সর্বাগ্রে” এমন একটি চেতনা সাধারণ মানুষের মাঝে জাগ্রত করতে সক্ষম হয়েছে। তাই ভারতীয় আশীর্বাদ থাকা সত্ত্বেও আওয়ামী লীগ কোনঠাসা হয়ে পড়েছে বার বার।
বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরংকুশ বিজয় দেখে যারা প্রথমে স্তম্ভিত হয়েছিল, ধীরে ধীরে তাদের সামনে থেকে কুয়াশা মেঘ কেটে আতাঁতের নির্বাচনের স্বরূপ পরিস্কার হতে থাকে এবং নির্বাচনী সময়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বপ্রাপ্ত আবদুল জলিল মিডিয়ায় স্বীকারই করে বসলেন যে নির্বাচনটি ছিল সম্পূর্ণ আঁতাতের। ভারতের স্বার্থ ছিল, স্বার্থ ছিল বিদেশী আরো কিছু পরাশক্তির এমন অভিযোগ প্রায়শই শোনা যায়। তবে শুধু আতাতই নয় বরং মিথ্যের জোয়ারে জয়ী হয়েছে আওয়ামী লীগ। দশ টাকা সের চাল খাওয়ানোর যে ওয়াদা শেখ হাসিনা প্রকাশ্য জনসভায় দিয়েছিলেন তা দরিদ্র মানুষের মাঝে ব্যাপক আগ্রহের সৃষ্টি করে। বিশেষ করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে লাগামহীন দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি এবং তৈরী পোষাক শিল্পের শ্রমিকদের নূণ্যতম ষোলশ পঞ্চার টাকার বেতনের মাঝে দশ টাকা সের চালের ঘোষণা টনিকের মতো কাজ করে। এর পাশাপাশি আওয়ামী লীগের রিজার্ভ ভোট বলে খ্যাত হিন্দু ভোটারদের একচেটিয়া ভোট আওয়ামী লীগের বাক্সে পড়ায় কারচুপি অনেকটাই সহজ হয়ে যায়। পাশাপাশি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে বিএনপির নেতাকর্মীদের ব্যাপক নির্যাতন, বিএনপির অত্যন্ত প্রসংশনীয় ও দলের জন্য ক্ষতিকর “অপারেশন ক্লিনহার্ট” বিএনপির সাহসী কর্মীদেরকে হতোদ্যম করে। নির্বাচনে এরা যেমন মাঠে নামে নি তেমনি আওয়ামী যুবলীগ ও ছাত্রলীগের সন্ত্রাসের ভয়ে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী জনগন ভোট কেন্দ্রে যেতে সাহসী হয় নি, যেখানে প্রায় শতভাগ হিন্দু ভোটার দুপুর বারোটার মাঝেই ভোট দিয়েছেন।
তবে নির্বাচনের পরপরই জনগনের মোহভঙ্গ হয়, শেখ হাসিনা দশটাকা সের চাল খাওয়ানোর প্রতিশ্রুত অস্বীকার করে বসেন, ঘরে ঘরে চাকুরী দেয়ার পরিবর্তে চাকুরী কেড়ে নেয়া শুরু করেন, বিদ্যুতের চরম অব্যবস্থাপনায় মানুষ হয়ে পড়ে দিশেহারা। একের পর এক কারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, বাড়ছে শ্রমিক অসন্তোষ। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্রলীগের বর্বরতা পাকিস্তানী হায়েনাদেরও হার মানিয়ে দিচ্ছে। পাশাপাশি আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের দ্বারা সংখ্যালঘু হিন্দুদের জমি জবর দখল, নির্যাতনের নিত্য নতুন সংবাদ হিন্দু রিজার্ভ ভোটে প্রভাব ফেলে। আর এরই প্রত্যক্ষ প্রভাব পরে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে। এডভোকেট রানা দাশ গুপ্ত বলেন, “সংখ্যালঘুদের  ভোটে নির্বাচিত হয়ে যারা পশুশালা দখল করতে যায় তাদের আর আমরা ভোট দিতে পারি না। কারণ ভোটও দিলাম, জমিও হারালাম এমনটি চলতে পারে না। সংখ্যালঘুদের বুকে স্বপ্ন ভঙ্গের যন্ত্রণা আছে। এবার আর আমরা ভুল করবো না। যাকে খুশি তাকে নয়, এবার জেনে শুনে এবং বুঝে ভোট দেবো”।
একদিকে হিন্দুদের উপর দমন নিপীড়নে রিজার্ভ ভোট কমছে, তার উপরে ভারতে ছুটছে অনেক হিন্দু ভোটার, অথচ সাধারণ মানুষকে মোহাচ্ছন্ন করে রাখার সকল যাদুমন্ত্রই ব্যর্থ হয়ে যাচ্ছে। স্বাভাবিকভাবেই বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ ও ইসলামী শক্তির মাঝে বিভক্তি অপরিহার্য হয়ে পড়ে আওয়ামী লীগের জন্য। আর বড় দল হিসেবে বিএনপিকে শায়েস্তা করা অতটা সহজ নয়, এবং দলটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ের ধকল এখনো কাটিয়ে উঠতে না পারায় বিএনপির দিক থেকে দৃষ্টি ঘুরিয়ে, টার্গেট করেছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর দিকে। দলটি ক্ষুদ্র হলেও সব সময়ই রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে, বা বলা যায় জামায়াত ছাড়া বাংলাদেশের রাজনীতি অসম্ভব। আর মরে গেলেও দলটি ভারতপন্থীদের সহায়তা দেবে না, ভালো করেই জানেন শেখ হাসিনা। তাই দলটিকে যে কোন মূল্যে নিশ্চিহ্ন করে দেয়াটা আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক দেউলিয়াত্ব লাঘবের একমাত্র উপায় মনে করে নীতি-নির্ধারকরা। পাশাপাশি ছাত্রলীগের পৈচাশিক রাজনীতির বিপরীতে ইসলামী ছাত্রশিবিরের নিয়মতান্ত্রিক আদর্শিক আন্দোলন তরুন প্রজন্মকে ইসলামী আন্দোলনমুখী করছে যা আওয়ামী লীগের জন্য অশনি সংকেত বটে। তাই পুরনো অযুহাতকে চাঙ্গা করে জামায়াতকে নিশ্চিহ্ন করার অপচেষ্টা চালাচ্ছে আওয়ামী লীগ।
মুসলিম লীগ, নেজাম-ই-ইসলাম,জামায়াতে ইসলামীসহ অন্যান্য ইসলামী দল ও সামাজিক সংগঠনগুলো স্বাধীনতা যুদ্ধের পক্ষে অংশগ্রহণ করে নি। তাদের যুক্তি ছিল, “তারা বাঙ্গালীর বিরুদ্ধে নয়, তবে ভারতীয় আধিপত্যবাদী শক্তির সাহায্য নিয়ে দেশ স্বাধীন করার পক্ষে মোটেও নয়”। তারা ভারতীয় আধিপত্যবাদী শক্তিকে পাকিস্তানী আধিপত্যবাদী শক্তির তুলনায় অধিকতর বিপজ্জনক বলে গণ্য করেছেন। তাদের মতে ব্রাহ্মণ্যবাদী ভারতীয় প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী মুসলমানদের বাসভূমি সৃষ্ট পাকিস্তানকে কেবল দ্বিখন্ডিত করতে আগ্রহী নয়, বরং দ্বিখন্ডিত করার পরে পূর্ব অঞ্চল অর্থাৎ বাংলাদেশকে সর্বতোভাবেই গ্রাস করার হীন পরিকল্পনায়ও লিপ্ত। মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে ইসলামী দল ও সামাজিক সংগঠনগুলো যেমন ভারতের ব্যাপারে উদ্বেগ্ন, আর অবিশ্বাস ছিল, সাধারণ মানুষের মনেও তেমনি ছিল ভারতভীতি, স্বাধীনতা পরবর্তী সময় থেকে বতর্মান সময়ে সাধারণ মানুষের মনে ভারতভীতি ক্রমাগত বেড়েই চলেছে।
আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার কিছু দিন পর থেকেই যুদ্ধাপরাধী বিচারের জিগির তুলেছে যদিও বাংলাদেশের আইনে যুদ্ধাপরাধীদের যে বিবরণ দেয়া আছে তাতে বেসামরিক কারো যুদ্ধাপরাধী হওয়ার সুযোগ নেই। আর সামরিক যুদ্ধাপরাধীদের আগেই মুক্তি দিয়েছেন শেখ মুজিবুর রহমান। পাকিস্তানী হায়েনাদের যারা যুদ্ধকালীন সময়ে সহায়তা করেছে তাদের বিচার করা হয় দালাল আইন, পরে তাতে অনেকের সাজা হয়, অনেককেই সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করা হয়। পাকিস্তানের সাথে সম্পর্কউন্নয়নে যেখানে ৯৫ হাজার হত্যাকারীকে মুক্তি দেয়া হয় সেখানে এ দেশীয় দোসরদের দাড়া করানো হয় বিচারের মুখোমুখি। এভাবেই শেষ হয় যুদ্ধাপরাধের বিচার, শেষ হয় রাজাকার, আলবদর, আলশামস অধ্যায়ের। কিন্তু আওয়ামী লীগ দলের অস্তিত্বের স্বার্থে রাষ্ট্রের সাধারণ মানুষের মাঝে বিভেদের দেয়াল তুলে দিতে আবারো যুদ্ধাপরাধী ইস্যু চাঙ্গা করেছে। তবে যুদ্ধাপরাধী ইস্যুটি যে নিছক জামায়াত শিবির দমনের জন্য চাঙ্গা করা হয়েছে তা “জামাত-শিবিরকে কোন ছাড় দেয়া হবে না” বলে শেখ হাসিনার ঘোষণাই প্রমাণ করে। এক দিকে আইনমন্ত্রী ঘোষণা করছেন যুদ্ধাপরাধী নয় স্বাধীনতাযুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার হবে, অপরদিকে সাধারণ মানুষের সেন্টিমেন্টকে ধ্বংসাত্মক কাজে উস্কে দিতে বার বার যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের হুমকি দিচ্ছেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে বিভিন্ন পর্যায়ের মন্ত্রী, নেতানেত্রী। অথচ শেখ হাসিনার নিজের বেয়াই রাজাকার হলেও তার বিষয়ে চুপ। “পুতুলের দাদাশ্বশুর রাজাকার হলেও যুদ্ধাপরাধী ছিলেন না : দেশে কোনো রাজাকার নেই” একদিনে ঘোষণা দিচ্ছেন শেখ হাসিনা, অপর দিকে রাজাকার রাজাকার বলে জামায়াত শিবিরের নেতাকর্মীদের উপর চালাচ্ছে বর্বরোচিত নির্যাতন। মূলত যারাই আওয়ামী লীগের শক্তির উৎস ভারতের বিরুদ্ধে কথা বলবে তাদেরকেই কোন না কোন অযুহাতে নিশ্চিহ্ন করে দিতে চায় আওয়ামী লীগ, সময়ের বীর সন্তান মাহমুদুর রহমানকে চোখ বেঁধে বিবস্ত্র করে রিমান্ডে নির্যাতন তারই স্বাক্ষ্য বহন করে।
বিগত আতাতের নির্বাচনের পর অনেকেই বলতে চেয়েছেন নির্বাচনে নতুন ভোটাররা যুদ্ধাপরাধী ইস্যুকে গুরুত্ব দিয়েছে এবং নির্বাচনী এ ওয়াদা বাস্তবায়ন করতেই জনগণ আওয়ামী লীগ কে ক্ষমতায় পাঠিয়েছে। কথাটি যে আদৌ সত্য নয় তা নির্বাচনী পরিসংখ্যানের দিকে তাকালেই বুঝা যায়। ২০০১ ও ২০০৮ উভয় নির্বাচনেই জামায়াত ২৫টি আসনে প্রতিদ্বন্দিতা করে। এছাড়া কিছু আসনে ২০০১ এ নির্বাচন করেছে কিছু আসনে শুধু ২০০৮ এ অংশগ্রহণ করে। উভয় নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে জামাত ২০০১ এর তুলনায় ২০০৮ এর নির্বাচনে ২৫টি আসনে ২ লক্ষ ৯৬ হাজার ৪ শত ৪১ টি ভোট বেশী লাভ করে। এছাড়া  বিগত নির্বাচনে জামায়াত যে ২টি আসন লাভ করে তার একটিতে শুধু এবারই অংশগ্রহন করেছে, ২০০১ এ অংশগ্রহণ করে নি। এ দ্বারা স্পষ্ট বুঝা যায় যে, জামায়াতের ভোট যেহেতু বেড়েছে, সাধারণ মানুষের মাঝে জামায়াতের ব্যাপারে আগ্রহ বেড়েছে, জামায়াতের গ্রহণযোগ্যতা বেড়েছে। তাই যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্যই সরকারকে জনগন ক্ষমতায় পাঠিয়েছে বলে যে দাবী করা হয় তা একেবারেই ডাহা মিথ্যে প্রচারণা, বরং দশটাকা সের চাল, ঘরে ঘরে চাকুরী, বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধান ইত্যাদি হাজারো প্রতিশ্রুতি পূরণে ব্যর্থতার দায় এড়াতে জনতার দৃষ্টি ভিন্ন দিকে ঘুরিয়ে দিতেই যুদ্ধাপরাধী ইস্যুটিকে চাঙ্গা করেছে আওয়ামী পন্থী বুদ্ধিজীবী, টকশোজীবী ও মিডিয়া। বামপন্থী ও আওয়ামী লীগের বুদ্ধিজীবীদের আলোচনার খোরাক গ্রামে গঞ্জে মিডিয়ার মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা সত্ত্বেও সবার কাছে এটি পরিস্কার, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কিংবা মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার যে নামেই ডাকা হোক না কেন জনগনের তাতে আগ্রহ নেই, বরং জনগন পেটপুরে দু’বেলা খেতে চায়, দু হাতে কাজ চায়, ছাত্ররা শিক্ষাঙ্গনে পড়তে চায়, ছাত্রলীগের পৈশাচিক নিপীড়ন, ধর্ষণ থেকে মুক্তি চায়, স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি চায়। মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের নামে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস থেকে দেশবাসী বাঁচতে চায়।

কোন মন্তব্য নেই: