শনিবার, ১ জানুয়ারী, ২০১১

ইসলাম ও ন্যায়বিচার

এক)
ফাতিমা বিনতুল আসওয়াদ ধরা পড়লেন। ধরা পড়লেন চুরির দায়ে। মুসলিম সমাজ বজ্রাহতের মতো চমকে গেলো, থমকে গেল। চুরির শাস্তি তারা জানেন। নির্ঘাত হাত কাটা যাবে ফাতিমার। না, অভাবের তাড়নায় চুরি নয়। ক্ষুধা নিবারণে কেউ চুরি করলে তো আর ইসলাম হাত কাটে না, চুরি যেন না করতে হয় তার নিশ্চয়তায় পর্যাপ্ত সুযোগ সুবিধা আগেই নিশ্চিত করে ইসলাম ।
মাখজুমি বংশের মেয়ে ফাতিমা। সম্মান আর আভিজাত্যে আরব জোড়া সুনাম। আছে অর্থসম্পদ প্রাচুর্য। তবুও চুরির দায়ে ধরা পড়লেন ফাতিমা। কুরায়শদের মাঝে কানাকানি, ফিসফিসানি। কিছু একটা করা দরকার। বিব্রত কুরায়শগণ অবশেষে রাসূলের (সাঃ) কাছে শাস্তি কমানোর সুপারিশের কথা ভাবেন।
দয়ার নবী। কানায় কানায় করুনায় পূর্ণ হৃদয় । তবুও ন্যায়ের পথে হিমালয়ের চেয়ে অটল তিনি, জানেন সবাই। তার দয়ার দরিয়ায় সুপারিশের পাল তোলা নৌকা ভাসাবে এমন হিম্মত আছে বা কয় জনার।
উসামা ইবনে যায়েদ (রাঃ), নবীজির অতি প্রিয়। সবাই ঘিরে ধরেন তাকে। তিনিই পারবেন, সাহসের বৈঠা বেয়ে ঢেউ তুলবেন নবীজির দয়ার সাগরে। শরীরের সবটুকু সাহস বুকে তুলে দাড়ান তিনি নবীজির দরবারে। আবেদন করেন শাস্তি লাঘবের, সম্ভ্রান্ত বংশের রমণীর সম্মানহানি বাঁচাতে সুপারিশ করেন হাত না কাটার।
রাসূল (সাঃ) ব্যথিত হলেন। যার আগমন ধরায় সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠায়, তিনি হাত গুটিয়ে নেবেন ন্যায় বিচার থেকে? বিস্ময়ভরা কন্ঠে তিনি বললেন, “আল্লাহর অনুশাসন কার্যকরী করার ব্যাপারে তুমি সুপারিশের আশ্রয় গ্রহণ করছ?”
অতঃপর তিনি উঠে দাড়ালেন, জনতাকে সম্বোধন করে দৃঢ কন্ঠে ঘোষণা করলেন, “তোমাদের পূ্র্ববর্তী লোক শুধু এ জন্য ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে যে, তাদের মধ্যে কোন ভদ্র বা অভিজাত বংশীয় লোক চুরি করলে তারা তাকে ছেড়ে দিত। কিন্তু যদি কোন দূর্বল ব্যক্তি চুরি করত তবে তার উপর অনুশাসন কার্যকর করত। আল্লাহর শপথ, মুহাম্মাদ তনয়া ফাতিমাও যদি চুর করে তবে তার হাতও কর্তিত হবে”।
সেদিন থেকে বিশ্ববাসী শিক্ষা নিলেন, ন্যায়বিচারে আত্মীয়তার স্থান নেই, স্বজাতির স্থান নেই, অর্থ প্রতিপত্তির স্থান নেই।
দুই)
আলী (রাঃ)। আমিরুল মু’মিনীন আলী ইবনে আবু তালিব। যুদ্ধে অসীম বীরত্বে অধিকার করেছেন শেরে খোদা উপাধি। জেহাদের ময়দানে দূর্গম দূর্গের কপাট ভেঙ্গে ঢাল বানিয়ে যুদ্ধ জয় করতে পারেন যিনি অমন উপাধিতে তাকেই তো মানায়।
ঢাল নেই তলোয়ার নেই এমন নিধিরাম সরদাররদের জন্য যুদ্ধ নয়। যোদ্ধা মানেই সমরাস্ত্রে সজ্জিত দুঃসাহসী বীর। সেই বীরসেনা আলী (রাঃ) তার প্রিয় বর্ম হারালেন। নিজের বর্ম একদিন খুঁজেও পেলেন বাজারে। বাজারে কুফানিবাসী জনৈক খৃষ্টান বর্মটি বিক্রির জন্য হাকাহাকি করছেন। নিজের বর্ম, সহজে কি আর চিনতে ভুল হয়, তাও আবার বীর সেনানীর বর্ম। সহজেই চিনে ফেললেন তার হারানো বর্ম। তবু ছিনিয়েতো আর নেয়া যায় না। হ্যা তিনি মুসলিম জাহানের খলিফা, তাই বলে জোর করে, তথ্য প্রমাণ ছাড়াই নিজের বর্ম বলেতো আর কেড়ে নেয়া যায় না।
তিনি ছুটলেন কাজীর দরবারে। শুরা বিন হারিশের দরবারে নালিশ জানালেন কুফার খৃষ্টান ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে। খলিফাতুল মুসলেমিন হযরত আলী বিচার চাইলেন সাধারণ প্রজার মতো, যদিও কাজী তারই নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মচারীমাত্র।
ন্যায়ের প্রতীক কাজী। ভুলে গেলেন বিচারপ্রত্যাশীর পরিচয়। আমিরুল মুমেনিনের দাবীর স্বপক্ষে দু’জন স্বাক্ষী নিয়ে আসার আদেশ দিলেন। আলী (রাঃ) তার অভিযোগের স্বপক্ষে নিজের সন্তান হাসান (রাঃ) কে হাজির করলেন, হাজির করলেন তার দাসকেও।
তবুও মামলায় হেরে গেলেন ক্ষমতামীল আমিরুল মু’মেনিন হযরত আলী। পিতার পক্ষে সন্তানের, মালিকের পক্ষে দাসের স্বাক্ষী গৃহীত হলো না কাজীর দরবারে। শুরা বিন হারিশ রায় দিলেন খৃষ্টান ব্যবসায়ীর পক্ষে।
কুফাবাসী অভিভূত হলেন ন্যায় বিচারে। যে ইসলাম বিচারে বাছবিচার করে না ধনী আর গরীবে, আমির আর সাধারণ প্রজার মাঝে, যে ইসলাম বিচারে খৃষ্টানের বিপক্ষে পক্ষ নেয় না মুসলিম আমিরের, সে ইসলাম থেকে পালিয়ে থাকতে পারে কি বুদ্ধিমান কেউ? কাজীর নিরপেক্ষ বিচারে আলোকিত হয়ে ওঠে খৃষ্টান ব্যবসায়ীর হৃদয়। ছুটে আসেন ইসলামের সুশীতল ছায়ায়,  ন্যায়ের ফল্গুধারায়।
তিন)
মৃত্যুদন্ড। রায় দিলেন কাজী সাহেব। রায় দিলেন রানী নূর জাহানের বিপক্ষে। ভারত উপমহাদেশের সম্রাট জাহাঙ্গীরের প্রাণপ্রিয় সহধর্মীনির মৃত্যুদন্ড ঘোষণা করলেন ন্যায়ের মূর্তপ্রতীক কাজী।
না, কোন প্রতিবাদ জানালেন না মহারাজ। কোন অভিযোগ নেই রানীমার অন্তরে। অভিযোগ করবেনই বা কেন? তিনি অপরাধ করেছেন, শাস্তি যে তাকে পেতেই হবে। তিনি খুন করেছেন। শিকারের পানে নিশানা করা তার তীর বিঁধেছে ধোপার বুকে। যদিও ইচ্ছে করে নয়, তবু খুনতো খুনই। অনিচ্ছাকৃত বলে তো আর বেঁচে উঠবে না ধোপা।
হ্যা, চাইলেই বিচারের রায় বাতিল করতে পারতেন সম্রাট। চাইলেই গর্দান নিতে পারতেন বিচারকের। তবু পারেন না তিনি। সকল বিচারকের বিচারক মহান আল্লাহ তালার ভয়ে কম্পিত সম্রাটের হৃদয়, কৃতঅপরাধে অনুতপ্ত রাণীর অন্তর। অবনত মন্তকে তিনি মেনে নিলেন কাজীর আদেশ।
কাজীর ন্যায় বিচারে  হৃদয় আর্দ্র হয় ধোপার বিধবা বউয়ের। রাণী হয়েও যিনি প্রজার রক্তের বদলে রক্ত ঝরাতে মেনে নেন ফাঁসির আদেশ অমন রাণীর মৃত্যু কিছুতেই মেনে নিতে পারেন না তিনি। রাণীমার মৃত্যুতে তো আর ফিরবেনা তার স্বামী। কাজীর দরবারে আবেদন করেন মৃত্যুদন্ড প্রত্যাহারে। রক্তমূল্য পরিশোধে প্রাণ ফিরে পান সম্রাট জাহাঙ্গীরের বেগম মহারাণী নূর জাহান।
জয় হলো ন্যায় বিচারের, জয় হলো সুশাসনের।
ইসলামে সবাই সমান, এক আল্লাহর বান্দা। ধনী গরিব, আমির ফকির বিচারে বিবেচ্য নয়, ন্যায় বিচারই ইসলামের মর্মকথা। ইসলামের বাহারী গুলবাগের অন্যতম মনকাড়া সুবাসিত ফুলের নাম ন্যায়বিচার। অথচ আজ বিশ্বের সর্বত্র বিচারের বানী নিভৃতে কাঁদে। সাধারণ মানুষ আজ আর ইহলোকিক কোন রাষ্ট্রযন্ত্রের কাছে ন্যায় বিচারের মিছে আশা করে না, ন্যয় বিচারের জন্য তারা আল্লাহর দরবারে ফরিয়াদ করে করে কাঁদে।
আমাদের শাসকেরা আজ ইসলাম থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে ন্যায়বিচার শিখছি তাদের কাছ থেকে যারা মনে করতেন সমাজের উচুশ্রেণীর নাগরিকেরা আইনের উর্ধ্বে। সম্রাট জাহাঙ্গীরের সমসাময়িক ব্রিটিশ শাসক ১ম জেমস মনে করতেন তিনি আইন উর্ধ্বের প্রভূ, তার কথাই আইন , তার হুকুমই শেষ কথা।  আমরা তাদের কাছে মানবতাবাদ শিখছি, যারা সেকেন্ডেই ধ্বংস করেছে হিরোশিমা নাগাসাকির মতো বড় বড় শহর, গণবিধ্বস্তী অস্ত্রের ধুয়ো তুলে যারা হাজার হাজার মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করে।
নিশ্চয় আল্লাহ সব কিছু জানেন এবং সব কিছুই শ্রবণ করেন। নিশ্চয়ই অবহেলিত সাধারণ মানুষের ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠায় কায়েম হবে ইসলামী হুকুমাত। আমরা সেদিনেরই অপেক্ষায়।