শনিবার, ১ জানুয়ারী, ২০১১

শহীদ নং-১১ : মো: রবিউল ইসলাম

শহীদ নং-১১
নাম : মো: রবিউল ইসলাম
সাংগঠনিক মান: সদস্য প্রার্থী
শহীদ হওয়ার তারিখ: ৬ ফেব্রুয়ারী ১৯৯৩
পিতার নাম: মরহুম মোসলেম উদ্দনি মিয়া।
সর্বশেষ পড়াশুনা: এম.এস.সি শেষবর্ষ পরীক্ষার্থী, উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগ।
জীবনের লক্ষ্য: অধ্যাপনা।
শহীদ হওয়ার স্থান: রাবি জোহা হলের সামনে।
আঘাতের ধরন: থ্রি নট থ্রি গুলি।
কাদের আঘাতে শহীদ: ছাত্রদলের নেতৃত্বে সর্বদলীয় ছাত্রঐক্য।
স্থায়ী ঠিকানা: গ্রাম: ছোট নিজামপুর, ডাক: লক্ষণপুর, থানা: শার্শা, জেলা: যশোর।
ভাইবোন : ৬ জন।
ভাই-বোনদের মাঝে অবস্থান: ৩য়।
পরিবারের মোট সদস্য: ৮ জন।
পিতা: মৃত।
মাতা: জীবিত, পেশা: গৃহিণী।
শহীদ হওয়ার পূর্বে স্মরণীয় বাণী: শাহাদাতের ২ দিন পূর্বে মাকে লেখেন “আমি শহীদ হলে তুমি কেঁদো না মা, তোমার সাথে আমার দেখা হবে জান্নাতের সিঁড়িতে।”
শাহাদতের পর শহীদের পিতা-মাতার প্রতিক্রিয়া: “তোরা কে কোথায় আছিস বেরিয়ে আয়। আমার রবিউল আর এ পৃথিবীতে নেই।” এরপর জ্ঞান হারান।

১৯৯৩ সালের ৬ ফেব্রুয়ারী প্রতিদিনের ন্যায় আজও সূর্য উদিত হলো উপমহাদেশের অনন্য নৈসর্গিক ছায়াঘেরা ক্যাম্পাস রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। সূর্যের তীক্ষ্ম রশ্মিকে মলিন করে দিয়েছিল সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের দুর্বৃত্তদের মুহুর্মুহু বোমা বারুদ আর ককটেলের কালো ধোয়ায়। পরিবেশকে ভারী করেছিল জাতির দু’জন তরতাজা তরুন যুবশক্তির প্রাণ কেড়ে নিয়ে ইতিহাসের ধারাবাহিকতার অনন্য মাইলস্টোন ৬ ফেব্রুয়ারী। দিশেহারা তরূণ সমাজের পাঞ্জেরী বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী । মতিহারের এই সবুজ চত্বর দাবি রাখে প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী উপলক্ষ্যে অনেক কর্মসূচীর। কিন' গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে গণতন্ত্রকে হত্যা করে কর্মসূচীর ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করলেন তৎকালীন প্রশাসন। তাই ইসলামী আন্দোলনের জিন্দাদিল মুজাহিদরা তখন বসে থকতে পারে না। ভর্তিচ্ছু ছাত্রদের সেবায় নিয়োজিত করলেন নিজেদের আত্মাকে। অগ্রণী ব্যাংকের সম্মুখে তাদের সেবার হাত সমপ্রসারিত হলো। শহীদ মুস-াফিজুর রহমান সহ ১০/১২ জন অত্যন- আন-রিকতার সহিত ভর্তিচ্ছুদের সার্বিক সহযোগিতা সহ সংগঠন প্রকাশিত ভর্তি গাইড বিক্রি করছেন। প্রশাসন ভবনের পশ্চিম চত্বরে ভর্তিচ্ছুদের সহযোগিতায় অবস'ান করছিলেন শহীদ মুস-াফিজুর রহমান আর শহীদ রবিউল ইসলামের উত্তরসূরী ২৫/৩০ জন। রাজনৈতিক তৎপরতা নিষিদ্ধ, ক্যাম্পাস অত্যন- শান-। হাজার হাজার ভর্তিচ্ছু’র আগমনে ক্যাম্পাস মুখরিত। কর্মে ব্যস- প্রশাসন যন্ত্র। সকল শান- পরিবেশ আর নবীনদের হাসিমুখ মুহূর্তের মধ্যে মলিন আকার ধারণ করল। কর্তৃপক্ষের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে যখন অতর্কিতে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ “আবার এলো ফেব্রুয়ারী, চলো যাই শিবির মারি, আমরা সবাই অস্ত্র চাই, শিবির মারলে পাপ নাই, ধর ধর শিবির ধর, ধরে ধরে জবাই কর,” ইত্যদি উস্কানীমূলক শ্লোগান আর হত্যার নেশায় মত্ত হয়ে তৎকালীন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের সভাপতি হারুনের নেতৃত্বে কাটা রাইফেল, স্টেনগান, পিস-ল, রামদা, চাইনিজ কুড়াল, বোমা ইত্যাদি অত্যাধুনিক অস্ত্রে সুসজ্জিত হয়ে ইসলামী ছাত্রশিবিরের কর্মীদের ্‌ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। চলতে লাগলো বৃষ্টির মতো গুলি আর বোমা বিষ্ফোরন।
শিবির কর্মীদের আহাজারি আর করুণ আর্তনাদে মতিহারে নির্মল বাতাস ভারী হয়ে রক্তের গন্ধ পৌঁছিয়ে দিয়েছিল হলে হলে অবস'ানরত ভাইদের নাকে। জানবাজ কর্মীরা বেরিয়ে এলো খুনীদের প্রতিরোধে। ইতোমধ্যে লাইব্রেরীর উত্তর পার্শ্বে নির্মমভাবে আহত করা হয়েছে নিরস্ত্র অসহায় শিবির নেতা মোবাশ্বেরকে। তার কোমরের পার্শ্ব দিয়ে গুলি প্রবেশ করে কষ্ঠনালী দিয়ে বেরিয়েছে। সাধারণ ছাত্রদের প্রতিরোধের মুখে শিবিরকে হত্যা করতে না পেরে ‘যেখানে পাও শিবির খাও’ এই মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে খুনীরা ওঁৎপেতে ছড়িয়ে পড়েছে ক্যাম্পাসের আনাচে কানাচে। সংগ্রহ করেছে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র। টার্গেট শিবির মারতেই হবে। তারই অংশ হিসাবে হবিবুর রহমান হলের সম্মুখ মাঠে খুনীরা নির্মম ভাবে অতি কাছ থেকে ব্রাশ ফায়ার করে হত্যা করেছে শহীদ মুস-াফিজুর রহমানকে। হত্যা করা হয়েছে জোহা হলের সম্মুখের রাস-ায় শহীদ রবিউল ইসলামকে। হাজার হাজার জনগণের সাথে তথাকথিত পুলিশ বাহিনীও নিরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে সন্ত্রাসীদের উৎসাহ জুগিয়েছে। যার ফলশ্রুতিতে সন্ত্রাসীরা হত্যার নেশায় আরো উম্মত হয়ে শহীদ শামসুজ্জোহা হলে আক্রমণ করে সাধারণ ছাত্রসহ সকল শিবির কর্মীদের বের করে দিয়ে প্রতিটি রুমে গান পাউডার দিয়ে আগুন ধরিয়ে গোটা হলকে ভস্মিভূত করে অস্ত্র উচিয়ে হলের ছাদে উল্ল্লাস করতে থাকে।


শহীদ রবিউলের স্মৃতিকথা

মোঃ রেজাউল করিম

রবিউল ১৯৭১ সালে পাক সেনাদের গোলাগুলিতে আব্বা মারা যাওয়ার পর রবিউল চাচাদের নিয়ন্ত্রণে রাজশাহীর উপশহর স্যাটেলাইন টাউন স্কুলে ১ম শ্রেণীতে লেখাপড়া শুরু করে। তারপর নিজামপুর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের (শার্শা, যশোর) ২য় শ্রেণীতে ভর্তি হয় এবং এখানেই প্রাথমিক শিক্ষাজীবন শেষ করে। প্রাথমিক শিক্ষাজীবন থেকেই তার মেধা শক্তি ছিল অত্যন- প্রখর। বুরজবাগান বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়, শার্শা, যশোর থেকে ১৯৮২ ইং সালে বিজ্ঞান গ্রুপে ৩ (তিন) বিষয়ে লেটারসহ ১ম বিভাগে উত্তীর্ণ হয়। রেজাউল, রবিউল ও রফিকুল আমরা তিন ভাই একই সাথে এক সাইকেলে এবং বর্ষার সময় পায়ে চার মাইল রাস-া হেঁটে স্কুলে যাতায়াত করি। তিন ভাইয়ের মধ্যে সে ছিল সবচেয়ে তীক্ষ্মবুদ্ধি সম্পন্ন। ১ম শ্রেণী থেকে দশম শ্রেণী পর্যন- প্রতি ক্লাসে তার ফলাফল ১ম অথবা ২য় হত।
তিন ভাইয়ের মধ্যে তার ফলাফর ভাল বিধায় মা সিদ্ধান- নিলেন তাকে ভাল কলেজে লেখাপড়া করাবে। এজন্য প্রথমে কলেজে ভর্তির জন্য ঢাকায় যায়, খরচ খরচা খুব বেশি বিধায় বাড়ি চলে আসে এবং শহীদ মশিউর রহমান ডিগ্রী কলেজ, ঝিকরগাছা, যশোর-এ ভর্তি হয়। মাস তিনেক কলেজ করার পর চাচাদের নিয়ন্ত্রণে রাজশাহী নিউ গভঃ ডিগ্রী কলেজে স'ানান-রিত হয়ে সেখানে লেখাপড়া করে আর উপশহরে চাচাদের বাসায় থাকে। এই কলেজ থেকে ১৯৮৪ সালে ২ (দুই) বিষয়ে লেটার মার্কসহ ১ম বিভাগে উত্তীর্ণ হয়। মায়ের স্বপ্ন-সাধ তার এই ছেলেকে ডাক্তারী অথবা ইঞ্জিনিয়ারিং পড়াবে। কিন- সেই বছর তার আশা পূরণ হলো না।তাই মনের দুঃখে পূর্ব বাসাবো, ঢাকায় এক ভদ্র লোকের বাসায় লজিং হিসাবে থাকে। এখান থেকেই সে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরে যোগদান করে এবং ১৯৮৬ ইং সালে আবারও ইঞ্জিনিয়ারিং এবং ডাক্তারী পড়ার জন্য ভর্তি হতে ব্যর্থ হয়। অতপর আমার অনুরোধে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ বিদ্যা বিভাগে ভর্তি হয়। আমরা তিন ভাই একই বাসায় একই রুমে অবস'ান করে রাজশাহীর হাজরা পুকুর নিউ কলোনীতে লেখাপড়া করতাম। লেখাপড়ার পাশাপাশি প্রতিদিন ২/৩ ঘন্টা রাজনৈতিক আলাপ আলোচনা হত।
ছাত্র জীবন থেকেই সে রাজনৈতিক জীবনে জড়িয়ে পড়ে। প্রথমে সে ছাত্রলীগ করতো। পরে ছাত্রশিবিরের সাথে জড়িয়ে পড়ে।
তার চরিত্র ছিল অত্যন- সুন্দর ও পবিত্র। আমার জানা মতে আমি কখনো তার চরিত্রে এতোটুকু ত্রুটি খুঁজে পাইনি। তার চরিত্রের বিভিন্ন দিকগুলি নিম্নরূপ:
# কুরআন-হাদিসের আলোকে কথাবার্তা বলা।
# আল্লাহ ও রাসূলের বিধি-বিধান মেনে চলার জন্য মানুষকে তাগিদ দেওয়া।
# সদালাপী ও স্পষ্টভাষী।
# অন্যের সমস্যা সমাধানে সহযোগী মনোভাব।
# সর্বপোরি মা-ভাইবোনদের প্রতি শ্রদ্ধা, মায়া-মমতা তার মধ্যে ছিল বেশি।
# বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে প্রতি শুক্রবার, রোজা রাখা।
# পায়খানা-প্রস্রাবের পর পরই ওজু করে পাক পবিত্র থাকা।
মানুষের সমস্যা দেখলে সে সি'র থাকতে পারতো না। তাই আমি দেখেছি যখনই কোথাও কোন সমস্যা দেখা দিত সেখানে সে এগিয়ে যেত। যেমনঃ বন্যার সময় অসহায় মানুষদের জন্য খাদ্য- বস্ত্র সংগ্রহ করে তাদের মধ্যে বিতরণ, মসজিদ-মাদ্রাসা নির্মাণের জন্য অর্থ সংগ্রহ ইত্যাদি কাজে সে নিজেকে ব্যস- রাখতো। গরীব, দুঃখী এবং অসহায় মানুষ কখনই বাসায় আসলে খালি হাতে ফিরে যেত না।
হাদিস-কুরআন পড়া এবং তা সুযোগ পেলেই অন্যকে তরজমা করে বুঝানো তার একটা অভ্যাস ছিল। তার দৈনন্দিন কাজ কর্ম ছিল সম্পূর্ণ রুটিন মাফিক। পূর্ব পরিকল্পনা মোতাবেক আমি তাকে সব সময় দেখেছি প্রতি শুক্রবারে শহীদ সাব্বির অঞ্চলের ছেলেদের নিয়ে আমাদের বাসায় কুরআন শিক্ষার অনুষ্ঠান করতো। সে তখন সাব্বির অঞ্চলের কুরআন শিক্ষার আসরের দায়িত্বে ছিল।
রাজনৈতিক জীবনে তাকে বহুবার নানান সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছে। আমার জানা মতে একবার রমজান মাসে ছাত্রঐক্য পরিষদের সাথে শিবিরের দ্বন্দ্বে বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করে। সমস- হল বন্ধ হয়ে যায় কিন' শহীদ রবিউল ইসলামকে খুঁজে পাওয়া না যাওয়ায় অবশেষে তার সংগঠনের ভাইয়েরা শের-ই-বাংলা হলের এক রুমে তাকে তালাবদ্ধ অবস'ায় পায়। ৩ দিন না খেয়ে রোজা রেখেছে সেখানে। তারপর ১৯৯২ সালের দিকে ৩ মাস রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে ৮৬ জনের সাথে একত্রে সেও আটক ছিল।
তার জীবন-যাপন ছিল অত্যন- সাধা-সিদা। পাঞ্জাবী-পায়জামা আর ফুলপ্যান্ট ও ফুল সার্ট ছিল তার প্রধান পোশাক পরিচ্ছদ। বিলাসিতা সে মোটেই পছন্দ করতো না। তার জীবনে আরাম-আয়েস আমি দেখিনি।
১৯৯৩ সালের ঘটনা: জেল থেকে ছাড়া পেয়ে নিজ বাড়িতে আসার পর মা-ভাইবোনদের আহাজারী, ‘তোমাকে আর রাজশাহী যেতে দেব না, লেখাপড়া আমাদের প্রয়োজন নাই, কবে কখন আমরা শুনবো তুমি মরে গেছ।’ মা-ভাইবোনদের একথার উত্তরে সে বলেছে, ‘মা তোমার ছেলে কি কোন খারাপ কাজ করে? নাকি কোন চুরি ডাকাতি করে? তোমার ছেলে যদি মারা যায় তবে কফিন করে তোমার ছেলেকে বাড়িতে নিয়ে আসবে। সুতরাং মা তুমি আমার জন্য চিন-া করবে না, তুমি শুধু আমার জন্য দোয়া করো।’ আরও একটি কথা সে বলে গেছে, ‘মা তোমরা শুধু ভাবছ আমি সংগঠন করি বলে মরে যাব। কিন' আমিতো বাড়িতে আসার পথেও বাস দুর্ঘটনায় মরে যেতে পারি। সুতরাং আমি জ্বরে-সর্দিতে কিংবা শিয়াল কুকুরের মত ঘরে বসে মরতে চাইনা। আল্ল্লাহ ও আলল্ল্লাহর রাসুলের কথা বলতে গিয়ে যদি আমার মৃত্যু হয় তবে আমি মনে করবো এটাই আমার জন্য শ্রেয়।’ এভাবে বিভিন্ন উদাহরণ আর কুরআন হাদীসের উদ্ধৃতি দিয়ে সকলকে বুঝিয়ে আবার রাজশাহীতে চলে যায়।
১৯৯৩ সালের ৬ই ফেব্রুয়ারীর ঘটনা: শহীদ রবিউল ইসলাম থাকতো আমার ফুফুর বাসায়। ফুফুর মুখ থেকে শোনা এই বক্তব্য। ৬ ফেব্রুয়ারী সকালে ভোরে উঠে গোসল করে ফজরের নামাজ আদায় করে। তারপর ঘণ্টা খানেক কুরআর তিলাওয়াত করে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীর জন্য বাহিরে যায় তারপর বাসায় ফিরে দেখে এখনও নাস-া তৈরি হয়নি। তখন এক দোকান থেকে বিস্কুট চানাচুর এনে খেয়ে ছাত্র-ছাত্রী পড়াতে যায়। ছাত্র-ছাত্রী আবদার জানালো- স্যার আজকে পড়বো না। শব-ই-বরাতের জন্য আমরা দুইদিন পড়বোনা। তাই বাসায় এসে সাইকেল নিয়ে ইউনিভার্সিটিতে রওনা হয়। কিছু দূর যাওয়ার পর সাইকেল নষ্ট হয়ে যায়। বাসায় ফিরে আসে। ফুফু বলে, আগামী কাল ০৭-২-৯৩ তোমার পরীক্ষা। বিশ্ববিদ্যালয়ে আজ যাওয়ার প্রয়োজন নেই, বাসায় বসে পড়াশুনা কর। বাসায় বসে বসে কী যেন চিন-া করছিল। তার কিছুক্ষণ পরে তার এক বন্ধু মটর সাইকেল যোগে এসে তাকে নিয়ে যায়। ফুফুর কাছে বলে যায় ‘ফুফু আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে যাচ্ছি।’ সারাদিন বাসায় না আসার কারণে বিকাল ৫টার দিকে তার সন্ধানে ফুফা বাজারে যায় এবং তার শাহাদাৎ এর সংবাদ জানতে পায়।
পর দিন বিকাল ৪টার সময় মা রবিউলের শাহাদাতের সংবাদ জানতে পারে। মা-ভাই-বোনদের করুণ আহাজারী ভাষায় বর্ণনা করা যায় না। জীবনে এমন শোকে শোকাভিভূত আর কখনও আমরা হইনি।
(লেখক: শহীদ রবিউলের শ্রদ্ধেয় বড় ভাই)
সত্য মুক্তি স্বাধীন জীবন
লক্ষ্য শুধু যাদের,
খোদার রাহায় প্রাণ দিতে আজ
ডাক পড়েছে তাদের।
কাজী নজরুল ইসলাম


শহীদ রবিউল: শাহাদাতের তামান্না

হেলাল উদ্দীন

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করতে সকল প্রকার অশ্ল্লীলতা, বেহায়াপনার মূলোচ্ছেদ করতে সর্বোপরি তরুণ ছাত্র সমাজের মাঝে ইসলামের সুমহান আদর্শের দাওয়াত তুলে ধরার জন্য যে সকল তরুণ নিজেদের জীবন দিয়ে সর্বোচ্চ নিদর্শন স'াপন করেছেন, তাদেরই একজন উজ্জল আলোকবর্তিকা হচ্ছেন শহীদ রবিউল ইসলাম।
পদ্মা বিধৌত হযরত শাহ্‌ মখদুম (রহ:) এর স্মৃতি বিজড়িত মতিহার সবুজ চত্বরে বিধবা মা বুকভরা আশা নিয়ে উচ্চ শিক্ষার জন্য রবিউল ইসলামকে পাঠিয়েছিলেন। কিন' রবিউল ইসলামের মায়ের সে আশা পূরণ হয়নি। সকল স্বপ্ন, সাধকে ধূলিস্মাৎ করে দিয়েছে এদেশেরই ছাত্র নামের কলঙ্ক, যারা ইসলামকে সহ্য করতে পারে না সে সকল গুন্ডা বাহিনী।
রবিউল ইসলাম সেতো ব্যক্তির নাম নয়, সে যেন পরশ পাথর। প্রতিটি মুহূর্তে তার বিরোচিত ভূমিকা, রেখে যাওয়া আদর্শই মূলত আমাকে একাফেলায় অগ্রসর করেছে। শুধু আমাকে কেন, শতশত তরুণ আজ এ কাফেলায় অংশগ্রহণ করেছে।
১৯৯৩ সালের ৬ ফেব্রুয়ারী। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে একটি বেদনাদায়ক ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। সেদিন সকল ইসলাম বিরোধী ছাত্র সংগঠন ঐক্যবদ্ধ হয়ে এদেশের ইসলাম প্রিয় ছাত্র জনতার প্রাণের প্রিয় সংগঠন ইসলামী ছাত্র শিবিরকে সমূলে উৎখাত করার পরিকল্পনা নেয়। পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ছাত্রদল ও ছাত্রমৈত্রীর সন্ত্রাসীরা বহিরাগতদের নিয়ে মারাত্মক আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে শিবিরের টেন্টে ঝাঁপিয়ে পড়ে। প্রথমেই গুলিবিদ্ধ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে শিবির নেতা মোবাশ্বের হোসেন খন্দকার ও হারুন-অর-রশিদ সরকার। সন্ত্রাসীদের লেলিহান থাবা এখানেই থেমে থাকেনি। তারা ক্যাম্পাস থেকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে শিবির কর্মীদের প্রাণপ্রিয় হল শহীদ
শামসুজ্জোহা হলে আক্রমণ পরিচালনা করে। তাদের আক্রমণ এতই ভয়াবহ ছিল যে, সন্ত্রাসীদের বুলেট আর বোমার ধোঁয়ায় সেদিন জোহা হলের পুকুর সহ পশ্চিম পাশ অন্ধকারে নিমজ্জিত ছিল দীর্ঘ সময়। উপসি'ত শিবির কর্মীরা আপ্রাণ প্রচেষ্টা চালায় সন্ত্রাসীদের সাঁড়াশী আক্রমণ প্রতিরোধ করার জন্য। এই মুষ্টিমেয় শিবির কর্মীদের একজন ছিলেন শহীদ রবিউল ইসলাম। শহীদ রবিউল ইসলাম সেদিন যে সাহসী ভূমিকা রেখেছেন তা শুধু রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় নয় সমগ্র বিশ্বের ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের জন্য আদর্শ হয়ে থাকবে কিয়ামত পর্যন-। যখন সন্ত্রাসীদের বুলেটের আঘাতে আহত হয়ে পিছিয়ে আসছিলেন আমাদের ভাইয়েরা ঠিক সেই মুমূর্তে রবিউল ইসলাম ভাই ওহুদ প্রান-রের শহীদ, রাসূল (সা:) এর প্রিয় সাহাবীর ন্যায় চিৎকার করে বলেছিলেন “হে আমার ভাইয়েরা তোমরা পিছিয়ে যাচ্ছ কেন? আমিতো বাতাসে বেহেশতের সুঘ্রাণ পাচ্ছি, আল্লাহর কসম তোমরা পিছপা হয়ো না।” এরই মাঝে সন্ত্রাসীদের একটি বুলেট এসে তার তলপেটে বিদ্ধ হয় এবং সঙ্গে সঙ্গেই তিনি শাহাদাতের অমীয় পেয়ালা পান করে মহান আল্লাহর দরবারে হাজির হন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)।
শিবির কর্মীরা তখন শহীদের লাশ ধরাধরি করে নিয়ে এসে জোহা হলের গেস্ট রুমে রেখেছিলেন। এক পর্যায়ে আমাদের অধিকাংশ ভাই যখন সন্ত্রাসীদের বুলেটের আঘাতে আহত হয়ে যান তখন ঐ হায়েনার দল জোহা হল দখল করে নেয়। শুরু হয় তাদের উম্মত্ততা, তারা উল্লাস করে আর শিবির কর্মীদের রুম লুট পাট, ভাংচুর ও অগ্নি সংযোগ করতে থাকে। তাদের পৈশাচিক থাবা এখানেই থেমে থাকেনি, তারা গেস্ট রুমে কাগজ জড়ো করে তাতে আগুন ধরিয়ে শহীদ রবিউলের পবিত্র লাশ পোড়াতে চেয়েছিল এবং চিৎকার করে বলছিল, ‘হে শিবির! তোদের কোন আল্ল্লাহ আজ রক্ষা করে তা আমরা দেখতে চাই। এ ধরণের লোমহর্ষক ঘটনা যদি কোন পাষন্ডও সেদিন দেখতো তবে তার হৃদয়েও সহানুভূতি আসতে বাধ্য হত। আর হয়তো বা মহান প্রভু এ কারণেই নিশ্চুপ থাকতে পারলেন না, সাথে সাথেই রহমতের বারিধারা নাযিল করে দিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর বিশেষ করে শহীদ শামসুজ্জোহা হলে। মুহূর্তের মধ্যে চারিদিক থেকে শিবির কর্মীরা ‘নারায়ে তাকবীর’ ধ্বনি সহকারে জোহা হলে প্রবেশ করে আমাদের ভাইদের উদ্ধার করে।
রবিউল ভাই রাজশাহী মহানগরীর জনশক্তি ছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে সব সময় টেনশন বেশি থাকে আর উনার শহীদ হওয়ার প্রবল ইচ্ছা তাই তিনি সার্বক্ষণিক বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাথে যোগাযোগ রাখতেন। ছুটি নেয়ার সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের সভাপতির নিকট আগে ছুটি নিতেন তারপর মহনগরীর সভাপতির নিকট যেতেন।
শাহাদাতের কয়েক দিন পূর্বের ঘটনা। বাড়ি থেকে শহীদ রবিউল ভাইয়ের আম্মা চিঠি লিখেছেন বাড়ি যাওয়ার জন্য। তিনি সেই চিঠি নিয়ে তৎকালীন বিশ্ববিদ্যালয় সভাপতি মতিউর রহমান আকন্দ ভাইয়ের নিকট যান এবং বলেন, “আকন্দ ভাই, আম্মা বাড়ি যাওয়ার জন্য চিঠি লিখেছেন এবং আমার মাস্টার্স শেষ পরীক্ষা আগামী ৭ ফেব্রুয়ারী। পরীক্ষার পর আমার বাড়ি যাওয়ার দরকার, বিধবা আম্মার দুঃখ ঘুচানোর জন্য চাকুরী করা দরকার।” তার উত্তরে আকন্দ ভাই বলেছিলেন, “রবিউল ভাই, যে ইসলামী আন্দোলনকে আপনি প্রাণের চেয়ে অধিক ভালবাসেন সেই সংগঠনের বিরুদ্ধে আজ সহস্রাধিক ষড়যন্ত্র চলছে, ক্যাম্পাসের এহেন মুহূর্তে কি আপনার ছুটি নেয়া ঠিক হবে? সাথে সাথেই শহীদ রবিউল, আকন্দ ভাইয়ের নিকট থেকে এক পাতা কাগজ চেয়ে নিয়ে আকন্দ ভাইয়ের উপসি'তিতেই মায়ের নিকট একটি পত্র লিখেছিলেন, যার ভাষা ছিল এরূপ, “মা, তোমার পত্র আমি পেয়েছি, আমার পরীক্ষা আগামী ৭ ফেব্রুয়ারী শেষ, বর্তমানে ক্যাম্পাসের অবস'া ভাল না, তাই কয়েক দিন পরই চলে আসব ইন্‌শাআল্ল্লাহ। তারপর চাকুরী নিয়ে তোমার মনে সকল আশা পূরণ করতে চেষ্টা করব ইন্‌শাল্ল্লাহ। আর যদি আমি শহীদ হই তাহলে আমার জন্য যেন কেঁদোনা মা। তোমার সাথে আমার দেখা হবে জান্নাতের সিঁড়িতে।” এই কথা গুলি যখন পরবর্তীতে আকন্দ ভাই বলছিলেন তখন তিনি আবেগ ধরে রাখতে পারেননি, ডুকরে কেঁদে ফেলেছিলেন।
দুঃখজনক হলেও সত্য এই চিঠি যেদিন শহীদ রবিউল-এর আম্মার হাতে পৌঁছে সেদিন ছিল ৬ ফেব্রুয়ারী, এই একই দিনে জোহা হলের সামনে রবিউল ইসলাম শাহাদাত বরণ করে আল্লাহর দরবারে হাজির হন। সকল মানুষই তার লক্ষ্যপানে ছুটে যায়। শাহাদাতই যার, উদ্দেশ্য, শাহাদাতই যার প্রেরণা, কে তাকে সেই পথের গতি রোধ করতে পারে? প্রতিদিন সেই শহর থেকে হলে এসে শিবির কর্মীদের সাথে হলে অবস'ান করতেন। তাঁর একটাই টেনশন, ‘আমি যদি শহরে থাকি আর রাত্রে শিবির কর্মীদের ওপর হামলা হয় তাহলে তো আমার শাহাদাত ভাগ্যে জুটবেনা।’ শাহাদাতের জন্য তিনি এরকম পাগলপরা ছিলেন।
শাহাদাতের পূর্বের ঘটনা- ১৭ মার্চ ১৯৯২। সে দিন ছিল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামী আন্দোলন ২য় বার ওপেন হওয়ার পর প্রথম সম্মুখ প্রতিরোধ। এই দিনও শহীদ রবিউল কিন' অনুপসি'ত ছিলেন না। তিনি সংবাদ একটু দেরীতে পান যার কারণে হলে আসতে পিছনে পড়ে যান। দুঃখের বিষয় ঐ সময় শের-ই-বাংলা হলে শিবিরকর্মী কেউ ছিলেন না। ছাত্র মৈত্রীর সন্ত্রাসীরা রবিউল ভাইকে পেয়েতো মহা খুশি। উনাকে ধরে নিয়ে পূর্ব ৩১ নং রুমে তালাবদ্ধ করে রাখে এবং বলে, ‘একটু পরে আসছি মজা দেখাবো।’ সেই দিনই রবিউল ভাই মনে করেছিলেন আজই হয়তো শাহাদাত বরণ করতে হবে। তিনি দ্বীনের জন্য শহীদ হবেন। এই কথা স্মরণ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মহা আনন্দে নফল নামাজ পড়তে থাকেন। সারা দিন রুমে অটক রোজা অবস'ায় তিনি নফল নামাজ আদায় করতে থাকেন। ঠিক সন্ধ্যার পূর্ব মুহূর্তে শিবির কর্মীরা যখন গোটা ক্যাম্পাস বাতিলের হাত থেকে উদ্ধার করে পরিসি'তি নিয়ন্ত্রণে এনেছে তখন খবর পাওয়া গেল যে, শের-ই-বাংলা হলে রবিউল ভাই এক রুমে আটক রয়েছেন। তখন আমাদের ভাইয়েরা রবিউল ভাইকে উদ্ধারের জন্য ছুটে আসেন। আমাদের ভাইয়েরা যখন সেই রুমের তালা ভাঙছিলেন তখন রবিউল ভাই আল্ল্লাহর দরবারে মুনাজাত করছিলেন আর ভাবছিলেন আর অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই হয়তো মহান প্রভুর সাথে সাক্ষাৎ হবে। কিন' দরজা খুলে শিবির কর্মীদের দেখার পর তার হাস্যজ্জল মুখ মলিন হয়ে যায়, ‘হায় শাহাদাত আর ভাগ্যে নেই।’ ১৭ মার্চের পর থেকে তিনি মাঝে মধ্যেই বলতেন “এখনতো আমি বোনাস জীবন কাটাচ্ছি। কারণ ১৭ মার্চেই তো আমার শাহাদাত বরণ করার কথা।”
তারপর থেকে আমার দীর্ঘ দিনের একটি সাধ ছিল যদি কোন দিন শহীদ রবিউল পবিত্র আত্মার পাশে দাঁড়িয়ে দু’হাত তুলে আল্ল্লাহর দরবারে নিজের মাগফিরাত কামনা করতে পারতাম তাহলে নিজেকে ধন্য মনে করতাম।
দীর্ঘ দিনের সেই সাধ পূরণ হলো গত ’৯৭ সালের ৬ ফেব্রুয়ারী শহীদের ৫ম শাহাদাতও বার্ষিকী উপলক্ষ্যে মিলাদ মাহফিল ও আলোচনা সভায় তৎকালীন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংগঠনিক সম্পাদক আলমগীর হাসান রাজু ভাইয়ের সাথে শহীদের বাড়িতে গিয়েছিলাম। শহীদের বাড়ির উদ্দেশ্যে যখন যাচ্ছিলাম তখন বিভিন্ন ধরনের চিন-া এসে ঘুরপাক খাচ্ছিল মাথায়। যশোর জেলা শিবির অফিস থেকে মটর সাইকেল যোগে আমরা শহীদের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছিলাম। ইফতারের পূর্ব মুহূর্তে আমরা সেই কাঙ্ক্ষিত ছোট নিজামপুর গ্রামে উপসি'ত হলাম। শহীদের বাড়ি যাওয়ার আগেই একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আমরা নামলাম। বিদ্যালয়টি মাঠের পশ্চিমে থাকাতেই ইটের প্রাচীরে ঘেরা একটি কবর দেখতে পেলাম। লাল ফুলে ভর্তি একটি জবা গাছ কবরটির শোভা বর্ধন করছে। কবরটি দেখেই আমার মনে হচ্ছিল হে শহীদ রবিউল! তোমার পড়া এখনো শেষ হয়নি? কবরে শুয়ে শুয়ে কচি কাঁচাদের সাথে এখনও কী তুমি পড়ছো?
শহীদ রবিউল ভাইয়ের আম্মার সাথে যখন কথা বলছিলাম, তখন শহীদের আম্মার মুখের কথাগুলি গোগ্রাসে গিলছিলাম আর মনে অজানে-ই দু'চোখ দিয়ে আনন্দাশ্রু গড়িয়ে যাচ্ছিল। আম্মার কথা শুনে তো আমি অবাক! শেষ বার বাড়ি থেকে আসার সময় মায়ের নিকট থেকে দোয়া চেয়েছেন, তিনি যেন শহীদ হতে পারেন। তার উত্তরে আম্মা যখন বললেন, “বাবা তোমাকে লেখা পড়ার জন্য রাজশাহীতে পাঠিয়েছি, তোমাকে তো শহীদর হওয়ার জন্য পাঠাইনি, দেখ বাবা তোমার আব্বা ৭১ সালে পাকিস-ানী সৈন্যদের গুলিতে শাহাদাত বরণের পর থেকে তোমাকে নিয়েই স্বপ্ন দেখেছি। তুমি চাকুরী করে আমার মুখে হাসি ফোটাবে। আমি সব দুঃখ বেদনা ভুলে যাব।” তখন রবিউল ভাই তাঁর মা আর ছোট বোনকে অনেক সময় বুঝালেন, বলেন, দেখ মা, আমি যদি বাড়ি আসার সময় রাস-ায় গাড়ি দুর্ঘটনায় মারা যাই তাহলে কি তুমি আমাকে মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করতে পারবে?” আম্মা আরো বললেন- “রবিউলের কথা কি বলব, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ, কুরআন-হাদীস নিয়েই বেশি ব্যস- থাকতো, কারো সাথে ঝগড়া বা দুর্ব্যবহারের তো প্রশ্নই ওঠেনা। ওর দাদা হাঁপানী রোগী ছিলেন। বাড়ির অন্য ছেলে মেয়েরা তেমন কাছে যেতনা, কিন' রবিউলকে নিষেধ করলেও থাকতো না। ও দাদার সাথে বসে খেতেও কুণ্ঠাবোধ করতো না।”
বাড়ি থেকে সর্বশেষ বার আসার ঘটনা শুনে আমার মনে হয়েছিল, বরিউল ভাই সম্ভবত বুঝতে পেরেছিলেন এবারেই তার শেষ বিদায়। মহান আল্ল্লাহ এরূপ গোলাপ ব্যতিরেকে কিভাবেই বা তার বেহেসে-র শোভা বর্ধন করবেন? আমাদের মতো পাপী রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় তো দূরে থাক, গোটা দুনিয়ায় পরিপূর্ণ থাকলেও মহা সুখময় বেহেসে-র কী আসে যায়। শয়নে, স্বপনে, জাগরণে সকল সময় যার মুখ দিয়ে একটিই বাক্য বের হত শাহাদাত, সেই শাহাদাত থেকে কিভাবে মহান প্রভু তাকে বঞ্চিত করবেন? রাব্বুল আলামীনের নিকট দোয়া করি, তিনি যেন রবিউল ভাইকে শহীদ হিসাবে কবুল করে নেন এবং আমরাও যেন শহীদ রবিউলের পথ ধরে এগিয়ে যেতে পারি রক্তপিচ্ছিল শহীদের সিঁড়ি বেয়ে জান্নাতের খোশবাগে, যেখানে সাক্ষাৎ হবে আবারও রবিউল ভাইয়ের মত শত শহীদের সাথে।

(* সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির, রাবি)
শাহাদাতের প্রেক্ষাপট: শহীদ রবিউল ও মুস্তাফিজ

কোন মন্তব্য নেই: