রবিবার, ২৬ জুন, ২০১৬

মুসলিম জীবনে রোযার সফলতা কতটুকু?

কতটুকু অর্জিত হচ্ছে তাকওয়া?
রোযার লক্ষ্য কি শুধু এটুকু, রোযাদার ব্যক্তিটি সকাল থেকে সন্ধা অবধি শুধু পানাহার বন্ধ রাখবে? তারাবিহ পড়বে এবং কোরআন তেলাওয়াত করবে? এবং রমযান শেষে মহা ধুমধামে ঈদ উদযাপন করবে? কত হাজার মাইল পথ চললো সেটিই কি পথিকের জন্য গুরুত্বপূর্ণ? বরং গুরুত্বপূর্ণ হলো, সে তার কাঙ্খিত লক্ষ্যে আদৌ পৌঁছলো কিনা। রোযার মূল লক্ষ্য, তাকওয়া অর্জন। মহান আল্লাহতায়ালা সে লক্ষ্যটি ব্যক্ত করেছেন এভাবেঃ ‘‘হে ঈমানদারগণ! তোমাদের উপর রোযা ফরয করা হয়েছে, যেরূপ ফরয করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের উপর, যেন তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পার।’’ (সুরা বাকারা, আয়াত ১৮৩)। উপরুক্ত আয়াতে সুস্পষ্ট করা হয়েছে,তাকওয়া অর্জনই রোযার মূল কথা। এক মাসের রোযায় রোযাদারের জীবনে কতটা তাকওয়া সৃষ্টি হলো তা থেকেই সেটিই রোযার সফলতা মাফকাঠি। আগুনের উত্তাপ যেমন প্রকাশ পায়,তেমনি প্রকাশ পায় তাকওয়ার উত্তাপও। সে উত্তাপে মানুষ মহামানবে পরিণত হয়। এমন মহাব মানবদের সংখ্যাবৃদ্ধিতে দেশ তখন ধর্মকর্ম, নেককর্ম, শিক্ষাদীক্ষা, মানবতা ও উচ্চতর সংস্কৃতিতে এক মহান সভ্যতা গড়ে তোলে। যেমনটি হয়েছিল সাহাবায়ে কেরামদের আমলে। অপর দিকে যে মুসলিম দেশ দুর্বৃত্তিতে বিশ্ব রেকর্ড গড়ে, তখন কি বুঝতে অসুবিধা হয় সে দেশে মসজিদ-মাদ্রাসা ও রোযাদারের সংখ্যা বাড়লেও মানুষের তাকওয়া বাড়েনি। এবং তাদের জীবনে রোযাও সফল হয়নি।

ব্যক্তির চিন্তুা-চেতনা ও আমলে বিপ্লব আসে তাকওয়ার গুণে। ইসলাম কবুলের সাথে সাথে ব্যক্তি মুসলমান হয় বটে, তবে তাতে সে বিপ্লবটি আসে না। কারণ ঈমান আনার সাথে সাথেই তাকওয়া সৃষ্টি হয় না। তাকওয়ার জন্য তাকে আরো সামনে এগুতে হয়। সে জন্য চাই আধ্যাত্মীক উন্নয়ন, সে আধ্যাত্মীকতার জন্য চাই কোরআনের জ্ঞান বা ইলম।চাই আল্লাহপ্রদত্ত লাগাতর ইবাদত ও প্রশিক্ষণ। সে কাজগুলির মহা আয়োজন নিয়েই রমযানের মাসের মাসব্যাপী রোযা। রমযানের মাসেই আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআন নাযিল করেছেন। এই কোরআনই হলো মানব জাতির জন্য মহান আল্লাহর সর্বশ্রেষ্ঠ নেয়ামত।তেল-গ্যাস,সোনারূপা,হিরা-জহরত বা অন্য কোন সম্পদ নয়।কোরআন থেকে মানুষ সরাসরি ওহীর জ্ঞান পায়।সে জ্ঞান যেমন চিন্তার রাজ্যে মহাবিপ্লব আনে, তেমনি প্রতিপদে ব্যক্তিকে পথও দেখায়। আলোকিত করে ব্যক্তির সমগ্র সত্ত্বা। সে আলোকিত মনে জন্ম নেয় তাকওয়াও।
 
তাকওয়া কীরূপে সম্ভব?
মহান আল্লাহতায়ালা শুধু তাঁর প্রিয় নবীর সাথেই কথা বলেননি,বরং তাঁর প্রতিটি প্রিয় বান্দাহর সাথেও কথা বলেন। সেটি পবিত্র কোরআনের মাধ্যমে।তাই কোরআন পাঠ কোন মামূলী বিষয় নয়। প্রকৃত মুমিনের লক্ষণ হলো,যখন সে এ কোরআন পাঠ করে তখন তার ঈমান আরো বেড়ে যায়। আর যখন মহান আল্লাহর নাম শুনে তখন তার আত্মা ভয়ে কেঁপে উঠে। সে সত্যটি পবিত্র কোরআনে বর্নিত হয়েছে এভাবেঃ নিশ্চয়ই ঈমানদার তো তারাই যাদের অবস্থা এমন যে, যখন তাদের সামনে আল্লাহর নাম উচ্চারণ করা হয় তখন তাদের অন্তর ভয়ে কেঁপে উঠে। এবং যখন তাদের সামনে তাঁর আয়াত পাঠ করে শুনানো হয় তখন তাদের ঈমান বেড়ে যায়।  এবং তারা নিজ প্রতিপালকের উপর তারা ভরসা পোষণ করে।”–(সুরা আনফাল আয়াত ২)।কোরআন তাই মানুষের চিন্তার ভূমিতে ভূমিকম্পের কম্পন তোলে, এবং গুড়িয়ে দেয় তার পূর্বের ধারণকৃত ধ্যান-ধারণাগুলো। এবং নির্মান করে তাকওয়া বা আল্লাহভীতির ইমারত। এভাবেই গড়ে উঠে ইসলামি সংস্কৃতি ও সভ্যতা। কোরআনের মাধ্যমেই তিনি পথ দেখান এবং তার সাথে অতি একান্ত সংযোগটি গড়ে তোলেন। সে সংযোগের মাধ্যমে আত্মার গভীরে তিনি এ বাণীটি তিনি স্পষ্ট করে পৌছে দেন যে, বান্দাহ থেকে তিনি আসলে কি চান। জানিয়ে দেন, এ জীবনের সঠিক পথ কোনটি এবং কোন আমলটি তাঁর কাছে অধীক মূল্যবান ও গ্রহনযোগ্য। ফলে যার মধ্যে কোরআনের জ্ঞান নাই,তার জীবনে হেদায়েত ও সত্যপথ প্রাপ্তিও নাই। তাকওয়া ও আধ্যাত্মীকতাও নাই। এ কোরআনী জ্ঞান থেকে বঞ্চিত হওয়ার অর্থ শুধু ঈমানের অপূর্ণতা নয়, তাকওয়ার অপূর্ণতাও। মাহে রমযান,আল কোরআন, তাকওয়া, মহান আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে রহমত ও মাগফেরাত এবং পরকালে নাযাত এ গুলিকে আলাদা ভাবে দেখার সুযোগ নাই। একে অপরের সাথে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত। মাহে রমযানের ফজিলত অন্য যে কোন মাসের চেয়ে শ্রেষ্ঠতর এ কোরআনের জন্যই।লায়লাতুল ক্বাদরের রাতে কোরআন নাযিলের কারণে হাজার মাসের চেয়েও এ রাতটি শ্রেষ্ঠ।
 
মহান আল্লাহর সাথে সরাসরি সংযোগ থাকতে পীরের খানকায় বা কবরে গিয়ে আধ্যাত্মীকতা খোঁজা ইসলামের শিক্ষা নয়। সাহাবায়ে কেরামের জীবনে তাই কোন পীরের খানকাহ বা কবর ছিল না। সে জন্য তারা মহান আল্লাহর নসিহতের দ্বারস্থ্য হয়েছেন। তারা মুসলমান হওয়ার সাথে কোরআনের দিকে ধাবিত হয়েছেন। কোরআনের ভাষা জানা না থাকলে সেটি শেখায় আত্মনিয়োগ করেছেন। আর সে নসিহত তো এসেছে খোদ আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছেঃ মাই ইয়াতাছিম বিল্লাহ ফাকাদ হুদিয়া ইলা সিরাতিল মোস্তাকীম অর্থঃ যারার আল্লাহর সাথে বন্ধন গড়লো তারাই সিরাতুল মোস্তাকীমের পথে নির্দেশনা পেল। আর মহান আল্লাহর সাথে বন্ধন গড়ার মাধ্যম তো আল্লাহর সৃষ্ট চন্দ্র-সূর্য,পাহাড়-পর্বত যেমন নয় তেমনি দেব-দেবীও নয়। বরং খোদ আল্লাহর কালাম আল কোরআন। পবিত্র কোরআনকে আল্লাহতায়ালা সংজ্ঞায়ীত করেছেন, মোয়েজাতুল হাসানা অর্থাৎ উত্তম ওয়াজ বা নসিহত রূপে। মহান আল্লাহর চেয়ে শ্রেষ্ঠ নসিহত দাতা আর কে হতে পারে? মহান করুণাময় আল্লাহ তার মুমিন বান্দাহর কাছে তাঁর প্রতি কর্মে নির্দেশনাময় সে নসিহতটি পৌঁছে দিয়ে থাকেন পবিত্র কোরআনের মাধ্যমেই। এজন্যই কোরআনের জ্ঞানার্জন প্রতিটি মুসলমান নরনারীর উপর ফরয। কারণ এ জীবনে যত জ্ঞান লাভই হোক, কোরআনের পাঠটি বাঁকি থাকলে হেদায়াত লাভ, সিরাতুল মোস্তাকীম লাভ,তাকওয়া লাভ ও পরকালে চুড়ান্ত সফলতা লাভ এসবই নাগালের বাইরে থেকে যাবে। নামায-রোযা আদায় করা ছাড়া যেমন মুসলমান হওয়া যায় না তেমনি কোরআনী জ্ঞানার্জনের ফরয আদায় ছাড়াও তাকওয়া অর্জন সম্ভব হয় না। বস্তুত মুসলমান হওয়ার অর্থই যে আলেম হওয়া -সেটিই তো পবিত্র কোরআনের মূল শিক্ষা। অজ্ঞতার পরিনাম যে কতটা ভয়াবহ সে কথাও ওহীর মাধ্যমে বার বার ঘোষিত হয়েছে। মহান আল্লাহতায়ালার ঘোষণাঃ ইন্নামা ইয়াখশাল্লাহা মিন ইবাদিহিল উলামা অর্থঃ সমগ্র সৃষ্টিকুলের মাঝে একমাত্র আলেমগণ  আল্লাহকে ভয় করে। আল্লাহভীরু হওয়ার জন্য আলেম হওয়া যে কতটা জরুরী সেটিই তো এ আয়াতে ঘোষিত হয়েছে।
 
তবে আলেম হওয়ার অর্থ মাদ্রাসার সার্টিফিকেটধারি হওয়া নয়, বরং কোরআনের জ্ঞানে জ্ঞানবান হওয়া। নবীজী (সাঃ)র আমলে সার্টিফিকেট বিতরণ হয়নি, বরং মসজিদের জায়নামাজে বসে জ্ঞানের বিতরণ হয়েছে। তাই নবীজী (সাঃ)র জামানায় এমন কোন সাহাবা পাওয়া যাবে কি যার মধ্যে কোরআনের জ্ঞান ছিল না? সে আমলে সাহাবীই হওয়ার অর্থই ছিল কোরআনী জ্ঞানের আলেম হওয়া। ওহীর জ্ঞান ছাড়া পিরামিড নির্মান, কম্পিউটার নির্মান, রেলগাড়ি বা উড়োজাহাজ নির্মান বা পারমাণবিক বোমার আবিস্কার এসবই সম্ভব। এরূপ হাজারো আবিস্কারে বহু দুর্বৃত্তও বিপুল সক্ষমতা দেখিয়েছে। কিন্তু তাদের কজন তাকওয়া সম্পন্ন মহামানব হতে পেরেছে? সে জন্য তো কোরআনের জ্ঞান চাই। মানব সমাজে এর চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কোন কাজই নাই। তাই মুসলমান যেখানেই ঘর বাঁধে সেখানে শুধু ঘরবাড়ি, চাষাবাদ, পশুপালন, ব্যবসাবাণিজ্যই বাড়ায় না, কোরআন চর্চার মহা-আয়োজনও করে। মানুষ কতটা মহামানব হবে সেটি বুঝা যায় সমাজে কোরআন চর্চার সে আয়োজন দেখে। রমযানের মাসে সে আয়োজনটিই তো বেশী বেশী হয়। এ মাসেই তারাবিহর নামাযে হাফেজদের মুখ থেকে পুরা কোরআন শুনার সুযোগ সৃষ্টি হয়।কিন্তু কোরাআন বুঝার সামর্থ না বাড়িয়ে শুধু তেলাওয়াত শুনে কি সেটি সম্ভব? জ্ঞান তো মগজে তখনই বিপ্লব আনে যখন  জ্ঞানের সে কথাগুলো মগজে নাড়া দেয়। সেটি কি না বুঝে তেলাওয়াত করা বা শ্রবন করার মধ্য দিয়ে সম্ভব? সম্ভব নয় বলেই মিশর, ইরাক, সিরিয়া, সূদান, আলজিরিয়া, মরক্কো, তিউনিসিয়া, লিবিয়া, মৌরতানিয়াসহ বিশাল এলাকার মানুষ নিজ নিজ মাতৃভাষা দাফন করে কোরআনের ভাষা শিখেছে এবং নিজ দেশ সে ভাষার প্রতিষ্ঠাও দিয়েছে।
 
ব্যর্থতা যেখানে কোরআন না বুঝার
আজকের মুসলমানদের বড় ব্যর্থতাটি মূলত কোরআন না বুঝার। মুসলমানের সংখ্যা বাড়ছে, মসজিদ-মাদ্রাসাও বাড়ছে, বাড়ছে ঘরে ঘরে কোরআন পাঠও। কিন্তু বাড়ছে না কোরআনের জ্ঞান। ফলে বাড়ছে না মহান আল্লাহর সাথে বান্দার সংযোগ। ফলে আসছে না চেতনা রাজ্যে ও চরিত্রে বিপ্লব। ফলে বার বার মাহে রমযান এলেও মুসলিম সমাজে গড়ে উঠছে না তাকওয়া সম্পন্ন মানুষ। কোরআন না বুঝার কারণে আল্লাহতায়ালা যে কি চান -সেটিই তাদের কাছে অজানা থেকে যাচ্ছে। ফলে কোটি কোটি মানুষ রোযা রাখলেও তাদের জীবন চলছে জাহিলিয়াতের পথ বেয়ে। একারণেই মুসলিম দেশেগুলিতে সৃষ্টি হচ্ছে না উন্নত মুসলমান ও নির্মিত হচ্ছে না উচ্চতর সমাজ ও সভ্যতা। বরং যা বাড়ছে তা হলো আল্লাহর দ্বীন থেকে সীমাহীন ভ্রষ্টতা ও পাপাচার। বাংলাদেশের মত দেশগুলোতে তাই রোযাদারের সংখ্যা বিপুল ভাবে বাড়লেও দূর্নীতিতে বিশ্বরেকর্ডও নির্মিত হচ্ছে। অথচ তাদের জীবনে তাকওয়া সৃষ্টি হলে কি এরূপ হতো? তাকওয়া যেমন আল্লাহভীরু মানুষের জন্ম দেয় তেমনি উচ্চতর সভ্যতারও জন্ম দেয়। অথচ বাংলাদেশে সেরূপ সভ্যতা নির্মিত হয়নি। ইসলামের বিজয় আসার আগে আরব ভূমিতে মহান আল্লাহ ও তাঁর বিধানের বিরুদ্ধে যেরূপ বিদ্রোহ হত সেরূপ বিদ্রোহ আজ এ দেশটিতেও।আল্লাহর বিরুদ্ধে সে বিদ্রোহ ও অবাধ্যতাগুলো ধরে পড়ে দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি,আইন-আদালত,প্রশাসন ও সংস্কৃতিতে। বরং সমগ্র দেশ ও তার রাজনীতি, শিক্ষাসংস্কৃতি, অর্থনীতি ও আইন-আদালতের প্রতিটি অঙ্গন অধিকৃত আল্লাহর বিরুদ্ধে বিদ্রোহীদের হাতে। তাই বাংলাদেশের মত শতকরা ৯১ ভাগ মুসলিমের দেশে আল্লাহতায়ালার সার্বভৌমত্ব ও তাঁর শরিয়তি বিধানের পরাজয়ে কোন কাফের বাহিনীর প্রয়োজন পড়ছে না, সেটি ঘটছে মুসলমানদের হাতেই। অথচ প্রাথমিক যুগের মুসলমানগণ যখন দেশে দেশে আল্লাহর শরিয়তি বিধানের বিজয় এনেছেন তখন সেসব দেশে শতকরা ৯০ ভাগ মুসলিমের বাস ছিল না। নিদারুন এ ব্যর্থতা যে আযাবের পথ তা নিয়ে কি কোন সন্দেহ আছে? তাকওয়ার বিপ্লব আনতে মুসলমানের রোযা-পালন যে কতটা ব্যর্থ হচ্ছে সেটি কি এরপরও বুঝতে বাঁকি থাকে? রোযা পরিণত হযেছে বিপ্লবহীন এক উপবাসে।
 
প্রশ্ন হল,আজকের মুসলিম সমাজে তাকওয়ার ধারণাই বা কীরূপ? তাকওয়া অর্থ ভয়। তবে সে ভয় এমন নয় যে,হঠাৎ বাঘের সামনে পড়া ভীতিগ্রস্থ ব্যক্তির ন্যায় তা বাকশূণ্য করবে। সে ভয় এমনও নয় যে, হঠাৎ গভীর সমুদ্রে পড়া ব্যক্তির ন্যায় আতংকিত ও বিচলিত করবে। তাকওয়া হল আল্লাহ-সচেতনতার এমন এক মানসিক অবস্থা যা প্রতি পদে পাপ থেকে ফেরায় এবং সদাসর্বদা প্রেরণা জোগায় নেক-আমলে। তখন বেড়ে উঠে পরকালের ভয় এবং জন্ম নেয় আল্লাহকে খুশী করার সার্বক্ষণিক ব্যস্ততা। সৃষ্টি করে আল্লাহর দরবারে জবাবদেহীতার চেতনা। এমন চেতনায় জীবনের প্রতিটি দিন ও প্রতিটি মুহুর্ত মনে হয় আল্লাহর অমূল্য নেয়ামত, গণ্য হয় গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষাপর্ব রূপে। তখন বিরামহীন ব্যস্ততা বাড়ে সে পরীক্ষায় কি করে কৃতকার্য হওয়া যায় তা নিয়ে। কোন ব্যক্তি হাই্ওয়েতে যখন দ্রুত গাড়ি চালায় তখনও একটি ভয় তার মনে সব সময়ে কাজ করে। সেটি হলো,সামান্য নিমিষের অসতর্কতা ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটাবে। মুহুর্তের মধ্য সে দুর্ঘটনা তার নিজের ও অন্যান্য আরোহীর জীবনে মৃত্যু ডেকে আনতে পারে। এমন একটি ভয়াবহ দূর্ঘটনার জন্য এক মিনিট বা আধা মিনিট মেয়াদী ভূলেরও প্রয়োজন পড়ে না। নিমিষের ভূল বা ঘুমই সে জন্য যথেষ্ট। চালককে তাই প্রতিটি মুহুর্ত চোখ ও মন খোলা রাখতে হয়। মৃত্যূর ভয়ে তাকে সর্বমুহুর্ত সতর্ক থাকতে। চালকের জন্য এটাই হলো তার তাকওয়া।
 
আর মুমিনের জীবনে তাকওয়া বা ভয়টি হলো সিরাতুল মোস্তাকীম থেকে বিচ্যুত হওয়ার সার্বক্ষণিক ভয়। যে কোন মুহুর্তে সেও বিচ্যুত হতে পারে মহান আল্লাহর নির্দেশিত পথ থেকে। সে বিচ্যুতি অনিবার্য করবে জাহান্নামের আয়াব। রোযার মূল কাজ এমন তাকওয়ার বৃদ্ধি। তাই তাকওয়া নিছক ক্ষুধা,তৃষ্ণা ও যৌনতাকে দমিয়ে রাখার সামর্থ নয়,বরং সর্ব প্রকার জৈবিক,আত্মীক ও আর্থিক কুপ্রবৃত্তি দমনের ঈমানী শক্তি। এমন তাকওয়া থেকেই প্রেরণা আসে আল্লাহপাকের হুকুমগুলি জানার এবং সে সাথে সেগুলির পুর্ণাঙ্গ অনুসরণের। কোরআনের জ্ঞানার্জনকে তাকওয়া-সমৃদ্ধ সে ব্যক্তিটি তখন নিজ জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ রূপে গ্রহণ করে। কারণ সে বুঝে, অজ্ঞতা নিয়ে সিরাতুল মোস্তাকীমে চলা অসম্ভব। কারণ কোনটি সিরাতুল মোস্তাকীমের পথ আর কোনটি ভ্রষ্টতার পথ সেটি জানতে বা বুঝতে হলেও তো জ্ঞান চাই। নবীজীর সাহাবাদের মাঝে ইসলামের জ্ঞানে তাই কোন অজ্ঞব্যক্তি ছিল না। তাদের শতকরা শতভাগই ছিলেন আলেম। ইসলামে তাই নামায-রোযার আগে কোরআনের জ্ঞানার্জনকে ফরয করা হয়েছে। সাহাবাদের জীবনে একসময় নামায-রোযা,হজ-যাকাত ছিল না। জিহাদও ছিল না। ইবাদত বলতে বুঝাতো রাত জাগা এবং রাতে দাঁড়িয়ে বার বার কোরআনের সদ্য নাযিলকৃত আয়াতগুলোকে ধীরে ধীরে আবৃত করা এবং আল্লাহর সে হেদায়েতের বাণীগুলোকে মনের গভীরে বসিয়ে দেয়া। সে সময় তাদের কাছে সমগ্র কোরআন ছিল না। তখন অর্পিত দায়িত্বটি ছিল,কোরআনের সে স্বল্প আয়াতগুলোর পূর্ণ অনুসরণ এবং অন্যদের কাছে সেগুলো পৌছিয়ে দেয়া। নবুয়তের শুরুতে নাযিলকৃত সুরা মোজাম্মেলে তো তেমনি একটি চিত্র পাওয়া যায়। ইসলামের ১৪ শত বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় আলেম তো গড়ে উঠেছে কোরআনেকে বুঝা ও কোরআন অনুসরণের অদম্য প্রেরণা থেকে।
 
ভ্রষ্টতা যেখানে ইবাদতে
ঘোড়ার আগে যেমন গাড়ী জোড়া যায় না তেমনি কোরআনী জ্ঞানার্জনের আগে ইবাদতও যথার্থ হয়না। নামায-রোযার আগে জ্ঞানার্জনকে ফরয করার কারণ তো এটাই। পবিত্র কোরআনের প্রথম শব্দটি তাই ইকরা অর্থ পড়ো। অথচ আজকের মুসলিম সমাজে কোরআন শিক্ষার সে দায়ভার চাপানো হয়েছে স্রেফ মসজিদের ইমাম বা মাদ্রাসার ছাত্রদের উপর। জ্ঞানার্জন যে প্রতিটি মুসলমান নরনারীর উপর ফরয সেটিও ভূলিয়ে দেয়া হয়েছে। সিরাতুল মোস্তাকীম থেকে ভ্রষ্টতার শুরু মূলত এমন এক চেতনাগত ভ্রষ্টতা থেকেই। ফলে প্রচণ্ড ভ্রষ্টতা বেড়েছে ইবাদতে। রোযা রেখে দোকানে বসে যে ব্যক্তিটি দ্রব্যমূল্য বাড়ায় বা পণ্যে ভেজাল মেশায় বা অফিসে বসে ঘুষ খায় বা মানুষের সাথে ঝগড়া করে -এমন ব্যক্তি যে তাকওয়াশূণ্য এবং রোযা থেকে কোন কিছুই লাভ করেনি তা নিয়ে কি কোন সন্দেহ আছে? সে তো তার জীবনে পথ চলায় ভ্রষ্টতার পথ বেছে নিয়েছে। এখানে কাজে তাকে ধাবিত করছে তার অজ্ঞতা। এমন অজ্ঞ ব্যক্তির জীবনে রোযা কি নিছক উপবাস ছাড়া অন্য কিছু উপহার দেয়? অথচ তাকওয়া-সম্পন্ন ব্যক্তির অদম্য অনুপ্রেরণা হলো, প্রতি মুহুর্তে সিরাতুল মোস্তাকীমে চলায়। তার জীবনের মূল লক্ষ্যটি আখেরাতের সফলতা অর্জন। আর সে লক্ষ্যকে সামনে রেখেই তার পার্থিব জীবনের সকল পরিকল্পনা ও সাধনা। ফলে এ জীবনের সর্ব মুহুর্তে তাঁর সতর্কতা হলো সর্বপ্রকার হারাম কাজ থেকে দূরে থাকায়। এবং সর্বমুহুর্তের ব্যস্ততাটি হয় বেশী বেশী নেক আমল করায়। তখন তার জীবনে নেমে আসে পবিত্রতা। অথচ যার মনে হারাম থেকে বাঁচার সে সতর্কতা নাই এবং নেক আমলে ব্যস্ততা নাই -বুঝতে হবে তার মনে তাকওয়াও নাই। অনেক গাছই ফল দেয় না। তেমনি অনেকের নামায-রোযা এবং হজ-যাকাতও জীবনে কোন পরিবর্তন আনে না। এরা নামায রোযা আজীবন করেও বাঁচে পথভ্রষ্টতা ও পাপকর্ম নিয়ে। নামে মুসলমান হলেও কর্মজীবনে এরা ফাসেক,জালেম ও মুনাফিক। এদের কারণেই মুসলিম দেশগুলোতে আল্লাহর শরিয়তী বিধান আজ পরাজিত এবং মুসলিম ভূমি অধিকৃত হয়েছে ইসলামে শত্রুপক্ষের হাতে। অথচ তাকওয়া সম্পন্ন ব্যক্তি গভীর দায়িত্ববোধ পায় আল্লাহর সৈনিক রূপে ইসলামের বিজয়ে পূর্ণ আত্ম-বিণিয়োগে। নবীজীর (সাঃ) আমলে সে সামর্থ পেয়েছিলেন প্রতিটি সাহাবা। তাদের জীবনে সর্বক্ষণের তাড়াহুড়া ছিল যেমন হারাম থেকে বাঁচার,তেমনি প্রচন্ড ব্যস্ততা ছিল বেশী বেশী নেক আমলের ও আল্লাহর দ্বীনকে বিজয়ী করার।
 
মুমিনের জীবনে ঈমান বলবান হলে যেটি অনিবার্য রূপে দেখা দেয় সেটি নেক আমলের প্রতি দুর্বার মোহ। ঈমানদার ব্যক্তি তখন প্রস্তুত হয়ে যায় শুধু মালের কোরবানীতে নয়, জানের কোরবানীতেও। অপর দিকে বদ আমল তা যত ক্ষুদ্রই হোক তার মাঝে তাকওয়া সম্পন্ন ব্যক্তি জাহান্নামের আগুণের ভয় পায়। ফলে তার সর্বক্ষণের সাধনা হয় তা থেকে বাঁচার। যে ব্যক্তির মাঝে বদ আমল থেকে বাঁচার ও বেশী বেশী নেক আমলের তাড়াহুড়া নাই,বুঝতে হবে তার মাঝে তাকওয়াও নাই্।এবং পরকালের উপর ঈমানও নাই। ঈমানের দাবীতে সে যত সোচ্চারই হোক, তার সে ঈমানদারি নিতান্তই মেকী। নেক আমলের প্রেরণায় সাহাবাগণ এতটাই অস্থির থাকতেন যে, মাঝ রাতে না ঘুমিয়ে আটার বস্তা কাঁধে নিয়ে গরীবের ঘরে পৌঁছে দিয়েছেন। চাকরকে উঠের পিঠে চড়িয়ে নিজে রশি ধরে টেনেছেন। সে কাজ করেছেন এমন কি বিশাল রাষ্ট্রের প্রধান তথা আমীরুল মোমিনুনও। তারা নিজেরা অভূক্ত থেকে মেহমানকে খাইয়েছেন। অসংখ্য ফলবান গাছের বিশাল বাগানকে আল্লাহর রাস্তায় তারা বিলিয়ে দিয়েছেন। জিহাদের ময়দানে আহত ও অতিতৃষ্ণার্ত হয়ে পানি নিজে না পান করে পাশের তুষ্ণার্ত মুজাহিদকে দিতে বলেছেন। সর্বোপরি তারা ছটফট করতেন অর্থের পাশাপাশি নিজের জীবনকে আল্লাহর পথে জিহাদে বিলিয়ে দেয়ায়। এবং তারা সেটি করতেন অনন্ত ও অসীম কালের জান্নাত পাওয়ার লক্ষ্যে। এর চেয়ে বড় প্রজ্ঞা আর কি হতে পারে? মহান আল্লাহতায়ালা তাঁর মুমিন বান্দাহ থেকে সে প্রজ্ঞাটাই আশা করেন। তাই পবিত্র কোরআনে আল্লাহপাক বলেছেন, তোমরা তাড়াহুড়া করো আল্লাহর মাগফেরাত  ও জান্নাত লাভে যা প্রশস্ত হলো আসমান ও জমিনের সমান। মুমিনের জীবনে সে তাড়াহুড়াটি সৃষ্টি হয় মূলতঃ কোরআনের জ্ঞানে। এরাই হলেন তেমন ব্যক্তি যাদের উদ্দেশ্যে মহান আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনে বলেছেন, নিশ্চয়ই মুমিনদের থেকে তাদের জান ও মাল আল্লাহতায়ালা ক্রয় করে নিয়েছেন জান্নাতের বিনিময়ে, তারা আল্লাহর রাস্তায় যুদ্ধ করে এবং তারা যেমন (আল্লাহর শত্রুদের) হত্যা করে তেমনি নিজেরাও নিহত হয়। এমন মানুষদের আধিক্যের কারণেই তখন নেক আমলের প্রচন্ড প্লাবন এসেছিল সমগ্র মুসলিম সমাজ জুড়ে। আসে রাজনৈতীক ও সামরিক বিজয়। তাকওয়ার সে গুণেই ইসলাম সেদিন গড়ে তুলেছিল যেমন মানব ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ, তেমনি সর্বশ্রেষ্ঠ সভ্যতা। আজ সে কোরআনী জ্ঞান যেমন নাই, তেমনি সে চারিত্রিক বিপ্লবও নাই। এরপরও কি বুঝতে বাঁকি থাকে আজকের মুসলমানদের মূল ব্যর্থতাটি কোথায়?
 
আল্লাহতায়ালার শ্রেষ্ঠ দান ও প্রত্যাশা
মাহে রমযান হল রহমত ও মাগফেরাতের মাস। আর সে সর্বশ্রেষ্ঠ রহমতটি হলো,এ মাসে নাযিলকৃত মহান আল্লাহর নিজস্ব বাণী পবিত্র কোরআন। এভাবে মানব জাতি পেয়েছিল মহান আল্লাহর সবচেয়ে বড় নেয়ামত - মূক্তি ও সফলতার একমাত্র এবং সর্বশেষ পথ। ইসলামী পরিভাষায় যা হল সিরাতুল মোস্তাকিম। এর চেয়ে বড় ঘটানো মানব ইতিহাসে আর দ্বিতীয়টা নেই। মানব ইতিহাসে সর্বশ্রেষ্ঠ উম্মাহ এবং সর্বশ্রেষ্ঠ সভ্যতা গড়ে উঠেছিল এ কোরআনের বরকতেই। এই একটি মাত্র ঘটনাই রমযানের এই মাসটিকে অন্য যে কোন মাসের তুলনায় সম্মানিত করেছে। এ ঘটনাটির বরকতেই এ মাসে আল্লাহতায়ালা ভালবাসেন তাঁর বান্দাহর প্রার্থণা কবুল করাকে। এভাবে এ মহান মাসটি সর্বোচ্চ সম্মান পেয়েছে খোদ মহান আল্লাহতায়ালা থেকে। এ মাসেই রয়েছে হাজার মাসের চেয়েও শ্রেষ্ঠ রাত লায়তুলু ক্বদর। দোয়া কবুলের এটিই শ্রেষ্ঠ রাত।
 
তবে দোয়া কবুলটিও নিঃশর্ত নয়। মহান আল্লাহর কাছে সে শর্তটি হল,কোরআনে বর্নীত নির্দেশাবলীর পূর্ণ অনুসরণ। পবিত্র কোরআনে সে শর্তটি বলা হয়েছে এভাবে, ..এবং যখন আমার বান্দাহরা আমার ব্যাপারে তোমার কাছে জিজ্ঞেস করে, (তাদেরকে বলে দাও) বস্তুতঃ আমি রয়েছি অতি সন্নিকটে। যারা প্রার্থণা করে, তাদের প্রার্থণা আমি কবুল করি। অতএব তাদের অবশ্য পালনীয় হলো, আমার হুকুম পালন করা এবং আমার উপর ঈমান আনা। (-সুরা বাকারা, আয়াত ১৮৬)। এ আয়াতে মহান আল্লাহতায়ালার ঘোষণা, তিনি প্রতিটি বান্দাহর অতি নিকটে। তিনি যে শুধু বান্দাহর প্রতিটি দোয়া শুনেন তাই নয়, সে দোয়া কবুলও করেন। সে ওয়াদাটিই অতি সুস্পষ্ট ভাবে ঘোষিত হয়েছে এ আয়াতে। তবে সে সাথে তিনি সুস্পষ্ট শর্তও রেখেছেন। শর্ত হলো, তাঁর হুকুম পালন করা এবং তাঁর উপর পরিপূর্ণ ঈমান আনা। বান্দাহর বহু প্রত্যাশার জবাবে এটি হলো মহান আল্লাহর ন্যূনতম প্রত্যাশা। আল্লাহর প্রত্যাশা পূরণে যে কোন ব্যর্থতা যে বান্দাহর জীবনে মহা আযাব ডেকে আনে - শুধু এ দুনিয়ায় নয়, অনন্ত-অসীম আখেরাতের জীবনেও - সে ঘোষণাটি পবিত্র কোরআনে এসেছে বার বার। কথা হলো, আজকের মুসলমানগণ কতটুকু সফল হচ্ছে সে শর্ত পূরণে। আল্লাহতায়ালার যে কোন হুকুমের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ হল কুফরি। ঈমানদার তো তারাই যারা আল্লাহর যে কোন হুকুম শোনা মাত্রই বলবে ‘‘সামেনা ওয়াতানা’’ - ‘‘শুনলাম এবং মেনে নিলাম’’। আল্লাহর হুকুমের বিরুদ্ধাচরন আযাব ডেকে আনে। একটি মাত্র হুকুম অমান্য করায় অভিশপ্ত হয়েছে ইবলিস। মহান আল্লাহর নীতি বা ন্যায় বিচার এ নয় যে, তিনি তাঁর বিদ্রোহী বান্দাহর দোয়া কবুল করবেন এবং তার ঘরে কল্যাণ পৌঁছে দিবেন। কল্যাণ যে হচ্ছে না সে প্রমাণ কি কম? পরাজয়, ধ্বংস, অপমান, শত্রুর আধিপত্যসহ নানা রূপ পতিত-দশা নেমে এসেছে শুধু ফিলিস্তিন, আফগানিস্তান, ইরাক, কাশ্মির, চেচনিয়া বা সোমলিয়ায় নয়, অধিকাংশ মুসলিম দেশে।
 
রেকর্ড দুর্বৃত্তি ও বিদ্রোহে
নামায-রোযা নিয়মিত আদায় করে এমন মুসলমানদের সংখ্যা আজকের পৃথিবীতে কোটি কোটি। কিন্তু সে তুলনায় তাকওয়া অর্জিত হচ্ছে কতটুকু? কতটুকু বেড়েছে নেক আমল? মুসলিম দেশ হওয়ার বরকতে এটাই  কি কাঙ্খিত ছিল না যে, এ দেশগুলি সুনীতি ও সৎকর্মে বিশ্বে রেকর্ড গড়বে? সৃষ্টি হবে নেক আমলের প্লাবন। কিন্তু বাস্তবে হচ্ছে তার উল্টোটি। দূর্নীতিতে তারা কাফেরদেরও হারিয়ে দিচ্ছে।নেক-আমলের বিপরীত হলোঃ মিথ্যা, সন্ত্রাস, চুরি-ডাকাতি, ব্যাভিচার, ঘুষ ও ধোকাবাজির ন্যায় নানাবিধ পাপাচার বা দুর্বৃত্তি। ইসলামী পরিভাষায় এ গুলো হলো মুনকার। অথচ মুসলিম দেশগুলিতে এগুলিই আজ প্রবলতর হচেছ না? ফলে রোযা যে তার কাঙ্খিত লক্ষ্য অর্জনে সফল হচ্ছে না এ হলো তার প্রমাণ। কিন্তু এ বিফলতা নিয়েই বা কজন ভাবছে? আল্লাহর নির্দেশের বিরুদ্ধে প্রতিটি বিদ্রোহই তো শয়তানের অনুসরণ। এমন বিদ্রোহে বিজয়ী হয় ও খুশি হয় শয়তান ও তার অনুসারিরা। অথচ প্রায় প্রতিটি মুসলিম দেশের শাসন ক্ষমতায় তো এ বিদ্রোহীরাই। প্রায় প্রতি দেশে চলছে শয়তানকে খুশি করার লাগাতর আয়োজন। আল্লাহর বিরুদ্ধে সে বিদ্রোহ প্রকাশ পাচ্ছে তাদের মিথ্যা,পাপ ও দূর্নীতির মধ্য দিয়ে। প্রতিটি মুসলিম দেশে এমন বিদ্রোহীরাই ব্যর্থ করে দিচেছ আল্লাহর হুকুম তথা শরিয়ত প্রতিষ্ঠার প্রতিটি উদ্যোগ।
 
শুরুতে মুসলমানদের একাধিক রাষ্ট্র ছিল না, কিন্তু যেটি ছিল সেটি শরিয়ত তথা আল্লাহর আইনের উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল। কোরআনে বর্নীত আল্লাহর হুকুমকে তারা শুধু পাঠই করত না, সমাজ ও রাষ্ট্রে প্রয়োগও করত।  কিন্তু আজ শুধু পাঠই হয়, প্রয়োগ নেই। মুসলিম রাষ্ট্রের সংখ্যা বেড়েছে। বেড়েছে নানা ভাষা ও নানা জাতীয়তার নামে বহু জাতীয় ঝান্ডা। মুসলিম উম্মাহর সংহতি ও স্বাধীনতাকে ধ্বংস করা হচ্ছে জাতীয়তাবাদের নামে। এবং সে সাথে বেড়েছে আল্লাহর হুকুমের তথা শরিয়তের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের ঝান্ডাও। সে ঝান্ডা উড়িয়েছে মুসলিম দেশের ব্যাংকগুলো সূদকে হালাল করে। বিদ্রোহের ঝান্ডা উড়িয়েছে মুসলিম দেশের আদালতগুলোও, সেটি কোরআনী আইনের স্থলে কাফেরদের প্রণীত আইন প্রয়োগ করে। যে আইনে ব্যভিচার, পতিতাবৃত্তি এবং সমকামিতা কোন শাস্তিযোগ্য অপরাধ নয়। এই কি রোযার সফলতা? কোথায় সে তাকওয়া? আল্লাহর বিরুদ্ধে বিদ্রোহের ঝান্ডা তুলতে মহিলারাও পিছিয়ে নেই। তারা সে ঝান্ডা তুলেছে পর্দার হুকুম অমান্য করে এবং নারী-পুরুষের মাঝে অবাধ মেলামেশার মধ্য দিয়ে। বেপর্দাগী নিজেই আল্লাহর বিরুদ্ধে বিদ্রোহের ঝাণ্ডা। আর যারা সে ঝাণ্ডা উড়িয়ে প্রকাশ্যে চলাফেরা করে তাদেরকে এসব নামাযী ও রোযাদারগণ বিপুল ভোটে নির্বাচিতও করে। তাদের পিছনে রাজপথে মিছিলও করে। আল্লাহর বিধানের বিরুদ্ধে যারা বিদ্রোহী তাদের ভোট দিলে বা তাদের রাজনীতিকে সমর্থন করলে কি নামায-রোযা পালনের কোন অর্থ থাকে?
 
মুসলিম দেশগুলিতে রোযাদারের সংখ্যা কোটি কোটি,কিন্তু কতটা বেড়েছে আল্লাহর পথে নিবেদিত প্রাণ সৈনিক? বরং অধিকাংশ মুসলমান যেন তাদের কর্ম,লেন-দেন, রাজনীতি,পোষাক-পরিচ্ছদ ও সংস্কৃতির মধ্য দিয়ে ঘোষণা দিচ্ছে, আল্লাহর হুকুমের প্রতি তাদের পরওয়া না্ই। তাদের কর্ম, রাজনীতি ও চাল-চলনে যেটি অধিকতর গুরুত্ব পাচ্ছে সেটি হল তাদের ব্যক্তিগত, জাতিগত ও গোষ্ঠীগত স্বার্থচিন্তা; আল্লাহর হুকুম নয়। আল্লাহর হুকুমকে তারা সীমাবদ্ধ করেছে জায়নামাযে, বিয়ে-শাদী ও মুর্দাদাফনে, মসজিদে এবং নামায-রোযা-হজ্ব পালনে। নিজেদের সংস্কৃতি,অর্থনীতি,রাজনীতি ও আইন-আদালতের অঙ্গণে নিষিদ্ধ করেছে আল্লাহর বিধানের প্রয়োগ। মুসলমানের এমন আচরণ কি আল্লাহর বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট বিদ্রোহ নয়? এমন বিদ্রোহী বান্দাহরা - পোষাক-পরিচ্ছদ ও নামে যতই মুসলমান হোক - যদি সারা বছররোযা রাখে, যদি সারা রাত নামায পড়ে ও কেঁদে কেঁদে যদি সারা রাত মোনাজাত করে তবে সে ইবাদত ও মোনাজাত কি রাব্বুল আলামিনের কাছে কবুল হয়? কবুল যে হচ্ছে না সে প্রমাণই কি কম? কবুল হওয়ার নমুনা কি এই - মুসলিম দেশে আগ্রাসী বিদেশী শক্তি আধিপত্য পাবে,নানা রূপ দুঃখদশা দিন দিন গভীতর হবে,এবং মুসলমান নর-নারি প্রতিদিন নিহত,আহত, ধর্ষিতা ও পদপিষ্ট হবে?
 
দোয়া কবুলের শর্ত
তিরমীযি শরিফের হাদীসে আছেঃ তিন ব্যক্তির দোয়া কখনই বৃথা যায় না। সে তিন প্রকার ব্যক্তি হলঃ রোযাদার, ন্যায় পরায়ন শাসক এবং যিনি মজলুম। কিন্তু এ হাদীসটির পাশাপাশি এ হাদীসও এসেছে, দোয়া কবুলের শর্ত হল তার রিযিক হালাল হতে হবে। ফলে যে ব্যক্তির সেহরী ও ইফতার যদি হয় ঘুষ, সূদ, মদবিক্রয়, জুয়া, ধোকাবাজি ও নানা দূনীতির মধ্য দিয়ে উপার্জিত অর্থে এবং বসবাস যদি হয় সূদী অর্থে কেনা বা সন্ত্রাস ও দূর্নীতির মধ্য দিয়ে অর্জিত গৃহে, তবে তার দোয়া কি কবুল হয়? দোয়া কবুলের জন্য রোযাদার হওয়ার পাশাপাশি ঈমানদার হওয়াটিইও তো শর্ত। পবিত্র কোরআনে একবার নয়, বহুবার বলা হয়েছে, যারা ফাসেক ও জালেম তাদের দোয়া কবুল দূরে থাক, মহান আল্লাহতায়ালা তাদের হেদায়েতই দেন না। হেদায়েত লাভের শর্ত হল,পাপের পথ তথা দূর্নীতি থেকে প্রথমে ফিরতে হবে। দৈহীক সুস্থ্যতার জন্য ঔষধের আগে বিষ-পান ত্যাগ যেমন জরুরী, তেমনি হেদায়াত লাভের জন্য জরুরী হলো পাপের পথ পরিহার। মহান আল্লাহতায়ালার সবচেয়ে বড় দান ধন-দৌলত,সন্তান-সন্ততি বা প্রতিপত্তি নয়, বরং সেটি হেদায়াত। সে হেদায়াত লাভের জন্যই প্রতি নামাজের প্রতি রাকাতে ইহদিনাস সিরাতুল মোস্তাকীম বলে দোয়া  করতে হয়। এর চেয়ে বড় দোয়া যেমন নেই, তেমনি হেদায়াত প্রাপ্তির চেয়ে মহান আল্লাহতায়ালা থেকে বড় প্রাপ্তিও নাই। এই হেদায়াত প্রাপ্তিই ঈমানদারকে একজন কাফের থেকে আলাদা করে। হেদায়াত লাভের ফলেই সম্ভব হয় সিরাতুল মোস্তাকিমে চলা। কাফের, জালেম ও ফাসেকের জীবনে সে হেদায়াত নাই বলেই তাদের জীবনে যেটি বাড়ে সেটি নিছক বিভ্রান্তি। এমন বিভ্রান্তিতে কেবল জাহান্নামে পৌঁছাই সম্ভব, জান্নাতে নয়। কারণ, জান্নাতের জন্য তো চাই সিরাতুল মোস্তাকিম। আর ফাসেক ও জালেম তো তারাই যারা দুবৃর্ত্ত এবং আল্লাহর হুকুমের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী। ফলে যে দেশটি দূর্নীতিতে বিশ্বে প্রথম হয় সে দেশের মসজিদ গুলো যতই মুসল্লি দ্বারা পূর্ণ হোক না কেন তারা কি রহমত পায়? হেদায়াত লাভের জন্য শুধু মুখে কালেমা পড়লেই চলে না। শুধু মূর্তিপুঁজা ছাড়াটাই যথেষ্ট নয়। দূর্নীতি ছেড়ে সুনীতি এবং দুষ্কর্ম ছেড়ে নেক আমলের পথও ধরতে হয়। দোয়া কবুল তো এ পথেই আসে।
 
রোযার পরিপূর্ণ ফায়দা নিতে হলে পরিপূর্ণ ঈমানদার হওয়াটি জরুরী। রোযা পালনের কোরআনী আহবান তো এসেছে ঈমানদারদের উদ্দেশ্য করেই, জালেম-ফাসেক ও কাফের-মোনাফিকদের উদ্দেশ্যে নয়। মূল লক্ষ্য, ঈমানদারের তাকওয়া বৃদ্ধি। প্রাসাদ গড়তে ভিতটা প্রয়োজন, তাকওয়ার নির্মানে ঈমান হলো সেই ভিত। তবে ঈমানদারির অর্থ শুধু আল্লাহকে বিশ্বাস করা নয়। মক্কার কাফেরগণও আল্লাহকে বিশ্বাস করত। তাদের সন্তানদের নাম নবীজীর (সাঃ) জন্মের পূর্বেও আব্দুল্লাহ ও আব্দুর রহমান রাখত। কিন্তু কাফেরদের এ বিশ্বাস  বেশীদূর এগুয়নি। এ বিশ্বাসে তাই তাকওয়া সৃষ্টি হয়নি, ফলে ব্যক্তি ও সমাজ কোনটাই বিশুদ্ধ হয়নি। আল্লাহর উপর ঈমান আনাতে ব্যক্তির জীবনে পরিশুদ্ধি শুরু হয় মাত্র,পরিপূর্ণ মুসলমান রূপে বেড়ে উঠার জন্য মুসলমানকে পরিপূর্ণ অংশ নিতে হয় মহান আল্লাহতায়ালার পরিকল্পিত প্রশিক্ষণে। শুধু একদিন দুদিন নয়, প্রতিদিন এবং জীবনের সবগুলো দিন ধরে। নামায, রোযা, হজ্ব,যাকাত, জ্বিহাদ হল সে প্রশিক্ষণ কার্যক্রম।
 
রোযার ট্রেনিং এত অপরিহার্য কেন?
ভালো মানের কৃষক,শ্রমিক,ডাক্তার বা ইঞ্জিনীয়ার গড়ার জন্যও লাগাতর ট্রেনিং চাই। তেমনি ট্রেনিং চাই নিষ্ঠাবান মুসলমান গড়ার জন্যও। সে ট্রেনিংয়ের মূল কথা হলো জিহ্বা, পেট ও যৌনতার উপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রন। ব্রেক ছাড়া কোন গাড়ী নির্মাণ ও সে গাড়ীকে রাস্তায় নামানোর বিপদ ভয়াবহ। তাতে অনিবার্য হয় দুর্ঘটনা। তেমনি জিহ্বা, পেট ও যৌনতার উপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রন ছাড়া সভ্য সমাজ নির্মিত করা যায় না। জিহ্ববার উপর নিয়ন্ত্রন না থাকলে মিথ্যাচার,গিবত ও কলহ-বিবাদ থেকে নাযাত মেলে না। পরিবার,সমাজ ও রাষ্ট্র জুড়ে অশান্তির মূল কারণ হলো লাগামহীন জিহ্ববা। তেমনি পেটের লালসার উপর নিয়ন্ত্রন না থাকলে পানাহারে অবাধ্যতা হয় শরিয়তি বিধানের। মানুষ তখন উপার্জনে দূর্নীতির আশ্রয় নেয়। তেমনি যৌন লালসার উপর নিয়ন্ত্রন না থাকলে মানুষ ব্যাভিচারের দিকে ধাবিত হয়। পাশ্চাত্য সমাজের ব্যাভিচারি মানুষগুলো তার নজির। নবীজী (সাঃ) বলেছেন, অধিকাংশ মানুষ জাহান্নামে যাবে জিহ্ববা ও যৌনাঙ্গের উপর নিয়ন্ত্রন না থাকার কারণে। রমযানের মাস ব্যাপী রোযা মূলত সে নিয়ন্ত্রনকেই প্রতিষ্ঠা করে। রমযানের রোযা যদি সে নিয়ন্ত্রন স্থাপনেই ব্যর্থ হয় তবে বুঝতে হবে রোযাদারের মাসব্যাপী ট্রেনিং সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়ে গেছে।রোযা তাকে দিনভর উপবাসের কষ্ট ছাড়া আর কিছু্ই দেয়নি। বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষের রোযা যে তাদের জীবনে কোনরূপ নিয়ন্ত্রন আনতে পারিনি তা শুধু রমযানের মাসে দ্রব্যমূল্যের উর্দ্ধগতিতে ধরা পড়ে না, প্রকট ভাবে ধরে দূর্নীতির মধ্য দিয়েও।
 
কোন প্রশিক্ষণই নিছক শারীরীক কসরতের বিষয় নয়। শরীরের সাথে চাই মনের সংযোগ।চিন্তার রাজ্যে বিপ্লব আনতে পারে চাই এমন জ্ঞান। রমযানের দৈহীক প্রশিক্ষণের সাথে কোরআনের সে জ্ঞান আনে মনোজগতে বিপ্লব। পশু পশুরূপে জন্ম নেয়, মারাও যায় পশু রূপে। এদের জীবনে জন্ম থেকে মৃত্যু অবধি কোনরূপ চারিত্রিক বিপ্লব নেই। তাই পশুকুলে সমাজ গড়ে উঠে না,সভ্যতাও নির্মিত হয় না। কারণ পশু সমাজে পানাহার থাকলেও জ্ঞানের আয়োজন নেই। কিন্তু মানুষকে পশু থেকে ভিন্নতর ও উন্নততর হতে হয়। এবং সেটি জ্ঞান আহরনের মধ্য দিয়ে। এটিই জীবনের মূল সাধনা। নইলে মানুষরূপে জন্ম নিয়েও সে মারা যেতে পারে পশুর চেয়ে নিকৃষ্ট হয়ে। পবিত্র কোআনে এদের বিষয়েই বলা হয়েছে ‘‘উলায়িকা কাআল আনয়াম,বাল হুম আদাল’’ তারাই পশুর ন্যায় বরং পশুর চেয়েও নিকৃষ্ট’’। অর্থাৎ এদের জীবনে উপরে উঠার কাজটাই হয়নি। বয়স বাড়ার সাথে তাদের ঈমান ও আমল বাড়েনি, বরং বেড়েছে নীচে নামাটি। অপর দিকে জ্ঞানসাধনায় অর্জিত উচ্চতর গুণে মানুষ ফেরেশতাদের চেয়েও শ্রেষ্ঠতর হতে পারে। এবং সে ��

কোন মন্তব্য নেই: