বুধবার, ৮ ডিসেম্বর, ২০১০

মহাবিশ্বের শুরু

অজানাকে জানার ব্যাপারে মানুষের মনে রয়েছে এক উদগ্র নেশা। তাই সৌরজগতের সীমানা ছাড়িয়ে পাড়ি জমালো মহাকাশের সীমাহীন পথে। জানতে পারল সূর্যের মত কোটি কোটি নক্ষত্রের বাস আমাদের সাথে এ মহাবিশ্বে। আবিস্কৃত হলো গ্যালাক্সি (যার একটিতেই রয়েছে লক্ষ লক্ষ নক্ষত্র), ক্লাষ্টার গ্যালাক্সি, নিউট্রন স্টার, কোয়াসার, কৃষ্ণ গহব্বর ও আরো অনেক মহাকাশীয় বস্তু। মানুষ তার অত্যাধুনিক বৈজ্ঞানিক সরঞ্জাম নিয়ে যতই এগুতে থাকল মহাবিশ্বের বিশালত্ব যেন ততই বাড়তে থাকল। এ যেন শেষ হবার নয়। বিশাল এ মহাবিশ্বকে নিয়ে কৌতুহলের শেষ ছিলনা অতীতে, বর্তমানে নেই এবং ভবিষ্যতেও থাকবেনা এটা অবধারিত। অজানাকে জানার কৌতুহল থেকেই বিজ্ঞান আজ চরম উৎকর্ষতা লাভ করেছে। তারপরও মানুষ আজ অবধি আদি অথচ মৌলিক একটি প্রশ্নের সঠিক উত্তর পায়নি। আর তা হলো আমাদের এ মহাবিশ্ব, যা নানা মূল্যবান পদার্থ দিয়ে ভরপুর তার সৃষ্টি হলো কিভাবে? এটা মহান সৃষ্টিকর্তার নিপুন হাতের সৃষ্টি তা সকল ধর্মে এক বাক্যে স্বীকার করে নিলেও যুক্তিবাদী ও বিজ্ঞানীরা সম্মিলিতভাবে সকলের জন্য গ্রহণীয় একক উত্তর দিতে পারেননি এখনও। কারো কারো মতে অনাদিকাল থেকেই আমাদের মহাবিশ্ব এরকমই। এটাকে কেউ সৃষ্টি করেনি আর ধ্বংসও নেই এর। আবার কেউ বলেন হঠাৎ এক বিষ্ফোরণের মাধ্যমে এর যাত্রা শুরু।
কলেবর বৃদ্ধি হওয়ার আশংকায় মহাবিশ্বের সৃষ্টির বিভিন্ন তত্ত্বের মধ্য থেকে শুধু এখানে মাত্র একটি তত্ত্ব নিয়ে আলোচনা করব, যা বর্তমান বিশ্বে সর্বাধিক গ্রহণযোগ্যতা লাভ করেছে। সেটি হলো 'মহা-বিষ্ফোরণ তত্ত্ব'। এ তত্ত্ব অনুযায়ী আজ থেকে ১৫০০ কোটি বছর পূর্বে মহাবিশ্ব তার সমস্ত পদার্থ নিয়ে কল্পনাতীত ঘনত্ব ও তাপে এক অতি ক্ষুদ্র অদ্বৈত বিন্দুতে (বিজ্ঞানীদের মতে পরমাণুর মধ্যে অবস্থিত একটি প্রোটনকে কয়েক কোটি ভাগে ভাগ করলে যে ক্ষুদ্র অংশ পাওয়া যাবে তার চেয়েও ছোট) পুঞ্জিভূত হয়ে ছিল। এক মহা-বিষ্ফোরণের মাধ্যমে অতি ঘন উত্তপ্ত আর অসীম ঘনত্ব এ অদ্বৈত বিন্দু (Singularity point) সম্প্রসারিত হতে হতে আজকের অবস্থায় পৌঁছেছে। এ বিষ্ফোরণটিই বিখ্যাত 'মহা-বিষ্ফোরন তত্ত' (Big Bang Theory) নামে পরিচিত।

এখন প্রশ্ন হলো ১৫০০ কোটি বছর আগে সংঘটিত হওয়া বিষ্ফোরণ বিজ্ঞানীদের চিন্তায় এলো কি করে? ব্যাপারটা তো আর এ রকম নয় যে বিষ্ফোরণ ঘটার পূর্ব মুহুর্তে একজন ব্যক্তি ঐ জায়গাটাতে ওত পেতে বসে ছিল কি ঘটে তা দেখার জন্য। আর ঐ ব্যক্তি এত কাল পর বিষ্ফোরণের ঘটনাটি জানিয়ে দিল বিজ্ঞানীকে চুপিসারে। বর্তমান বিশ্বে যে কোন তত্ত্ব উপস্থাপন করলে বিনা প্রমাণে তা গৃহীত হওয়া অসম্ভব ব্যাপার। কাজেই এই তত্ত্বের প্রবক্তাদেরকেও পেশ করতে হয়েছে উপযুক্ত প্রমাণ।


এবারে আমরা বিজ্ঞানীদের বিভিন্ন তত্ত্ব নিয়ে সংক্ষেপে আলোচনা করব মহা-বিষ্ফোরণ তত্ত্ব সম্পর্কে ধারণা অর্জনের জন্যে। আলবার্ট আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার তত্ত্ব (Theory of Relativity) থেকে আভাস পাওয়া যাচ্ছিল আমাদের এই মহাবিশ্ব ক্রমশ সম্প্রসারিত হচ্ছে। অপর পক্ষে আইনস্টাইন নিজেই স্থিতিশীল মহাবিশ্বের উপর আস্থাশীল ছিলেন। কাজেই মাধ্যাকর্ষণের প্রভাবে গ্যালাক্সি গুলো যাতে একে অপরের সাথে ধাক্কা না লাগে সে জন্য তিনি তাঁর গাণিতিক সমীকরণে একটি মহাজাগতিক ধ্রুবক (Cosmological constant) যোগ করলেন। আইনস্টাইন পরবর্তিতে অবশ্য স্বীকার করেছিলেন এই ধ্রুবক যোগ করাটা ছিল তাঁর জীবনে বিরাট এক ভূল।


১৯২০ থেকে ১৯৩০ এই দশকটি জ্যোতির্বিদদের জন্য ছিল স্বর্ণ-দশক। কারণ এই দশকে আধুনিক জ্যোতির্বিদ্যার প্রভূত উন্নতি সাধিত হয়েছিল। ১৯২২ সালে রাশিয়ার একজন বিজ্ঞানী আলোন্ডার ফ্রেডম্যান, আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার তত্ত্ব নিয়ে ব্যাপক গবেষণার মাধ্যমে গণনা করে দেখালেন এই মহাবিশ্ব সম্প্রসারিত হচ্ছে। সম্প্রসারিত হওয়ার অন্তর্নিহিত অর্থটা কি তা একজন বেলজিয়ান পদার্থবিদ জর্জেস লেমেইটর প্রথম বুঝতে সক্ষম হয়েছিলেন। তিনি ১৯২৭ সালে স্বাধীন ভাবে ফ্রেডম্যানের দেয়া ফলাফল নিয়ে গণনা করে দেখালেন এবং পূনরায় ঘোষণা করলেন এই মহাবিশ্ব নিশ্চিত ভাবে সম্প্রসারিত হচ্ছে। আমেরিকার জ্যোতির্বিজ্ঞানী এডউইন হাবল লেমেইটরের তত্ত্বকে সমর্থন করলেন। ১৯২৯ সালে এডউইন হাবল তাঁর বিশাল দুরবীন যন্ত্রের মাধ্যমে মহাকাশের দূরবর্তী গ্যালাক্সিগুলোর দিকে তাকিয়ে প্রত্যক্ষ করলেন গ্যালাক্সি গুলোর একটি থেকে আর একটি দ্রুত দূরে সরে যাচ্ছে। অর্থাৎ মহাবিশ্ব স্থিতিশীল নয়। জর্জেস লেমেইটর যে ভবিষ্যত বাণী করেছিলেন তা হুবহু সত্য বলে প্রমাণিত হলো। সাথে সাথে 'সম্প্রসারণশীল বিশ্ব তত্ত্ব'টি প্রতিষ্ঠা লাভ করল।


১৯৩১ সালে জর্জেস লেমেইটর তাঁর নিজের দেয়া ভবিষ্যত বাণী নিয়ে আবারো কাজ শুরু করলেন। তিনি চিন্তা করলেন সময় বাড়ার সাথে সাথে মহাবিশ্ব সম্প্রসারিত হচ্ছে। কিন্তু আমরা যদি উল্টোটা করি অর্থাৎ সময়ের চাকা পিছনে দিকে ঘুরিয়ে দিই তাহলে মহাবিশ্ব সম্প্রসারিত না হয়ে সংকুচিত হতে থাকবে। আর এভাবে যদি আমরা দুর অতীতে ফিরে যাই তাহলে যা ঘটবে তা হলো মহাবিশ্ব সংকুচিত হতে হতে অসীম তাপ ও ঘনত্ব প্রাপ্ত হয়ে কোন এক সময়ে একটি পরমাণুর চেয়েও ক্ষুদ্র বিন্দুতে পুঞ্জিভূত হয়ে পড়বে। এ বিন্দুকে বিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয় অদ্বৈত বিন্দু (Singularity point)। বর্তমানে পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে আমরা জানতে পেরেছি মহাবিশ্ব সম্প্রসারিত হচ্ছে। আর এটা হচ্ছে অদ্বৈত বিন্দুতে কোন এক সময় প্রচন্ড বেগে আঘাতের ফল। এ ধারণা থেকে তিনি ঘোষণা করলেন এই মহাবিশ্বের শুরু ছিল।


মহাবিশ্বের মহা সম্প্রসারণ থেকে উল্টো দিকে গিয়ে মহা সংকোচনের মাধ্যমে অদ্বৈত বিন্দুতে পৌঁছার পর না হয় বুঝা গেল সেখান থেকে মহাবিশ্বের শুরু। কিন্তু মহা-বিষ্ফোরণ সম্বন্ধে তো কিছুই বুঝা গেলনা। ১৯৪০ এর দশকে আর একজন রাশিয়ার বিজ্ঞানী জর্জ গ্যামো ও তাঁর ছাত্র রালফ আলফার এবং রবার্ট হ্যারম্যানের সাথে কাজ করতে গিয়ে 'বিগ ব্যাঙ' এর ধারণা প্রথমে তাঁর মাথায় আসে। মজার কথা হলো 'বিগ ব্যাঙ' তত্ত্বের বিপরীতে মহাবিশ্ব সৃষ্টির ব্যাপারে ΄Steady State' নামে আর একটি তত্ত্বের প্রবক্তা এবং বিখ্যাত জ্যোতির্বিদ ফ্রেড হয়েল 'বিগ ব্যাঙ' শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেন। সেই থেকেই 'বিগ ব্যাঙ' শব্দটি বিজ্ঞানের জগতে আস্তে আস্তে স্থান করে নেয়। আমরা অদ্বৈত বিন্দু সম্বন্ধে আগেই জেনেছি। গ্যামো চিন্তা করলেন যদি অদ্বৈত বিন্দুতে একটা উত্তপ্ত মহা বিষ্ফোরণের মাধ্যমে মহা বিশ্বের সৃষ্টি হয়ে থাকে তাহলে সেই ভয়ঙ্কর তেজস্ক্রিয়তার (radio-activity - এক প্রকার রশ্মি বা কণা আপনা হতে বিকীর্ণ হয় এমন) চিহ্ন এখনও বজায় থাকা উচিত। তিনি গণনা করে দেখালেন, বিশ্বের সৃষ্টির আদিতে যে তেজস্ক্রিয়তার উদ্ভব হয়েছিল, মহাবিশ্বের সম্প্রসারণের ফলে তার বর্ণালী (microwave spectrum ) হ্রাস পেয়ে এখন পরম শুন্য তাপমাত্রার উপরে ৫ ডিগ্রীর মত হওয়ার কথা। এটাকে বলা হয় মহাজাগতিক পশ্চাদপট তেজস্ক্রিয়তা বা (Cosmic background radiation)। জার্মান পদার্থবিদ আর্নো পেনজিয়াস এবং আমেরিকান পদার্থবিদ রবার্ট উইলসন ১৯৬৪ সাল নাগাদ মহাজাগতিক পশ্চাদপট তেজস্ক্রিয়তা মেপে যে ফলাফল পেলেন তা ছিল গ্যামোর ফলাফলের মোটামুটি কাছাকাছি - পরম শুন্যের উপর প্রায় ৩ ডিগ্রী। এটা'বিগ ব্যাঙ' এর পরের তেজস্ক্রিয়তারই প্রতিধ্বনি হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হলো। আর এর পরেই Big Bang Theory মহাবিশ্বের সৃষ্টির ব্যাপারে স্থান পাকা করে নিল বিশ্ব দরবারে। ১৯৭৮ সালে আর্নো পেনজিয়াস এবং রবার্ট উইলসন উক্ত কাজের জন্য নোবেল পুরস্কার লাভ করেছিলেন।


উপরের আলোচনা থেকে এটা স্পষ্ট করে বলা যায় 'বিগ ব্যাঙ' তত্ত্বটি আরিস্কার এবং তার সত্যতা প্রমাণের জন্য অন্য আরো কতগুলো তত্ত্বের সহযোগিতার প্রয়োজন পড়েছিল। অন্যভাবে বলা যায় একটি তত্ত্ব অন্য আর একটি তত্ত্বকে আবিস্কার করতে উৎসাহিত করে ছিল। 'বিগ ব্যাঙ' নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে অনেক গুলো বিষয়ের মধ্য থেকে দুটো বিষয়ের প্রতি দৃষ্টিকে আবদ্ধ করতে চাই। একটি হলো সম্প্রসারণশীল বিশ্ব যা 'বিগ ব্যাঙ' তত্ত্ব আবিস্কারের ব্যাপারে বড় ভূমিকা পালন করেছে। আর দ্বিতীয়টি বিষ্ফোরণের আগে মহা বিশ্বের সকল পদার্থ একত্রে ছিল।


সবশেষে মহাগ্রন্থ আল-কুরআনের দিকে মনোযোগ আকর্ষণ করতে চাই। সাধারণ ভাবে বলতে গেলে পবিত্র কুরআন কোন বিজ্ঞানের বই নয়। তবে বিজ্ঞানের এমন অনেক তত্ত্ব আছে যে গুলি কুরআনের আয়াতের সাথে মিলে যায়। এখান থেকে এটাই প্রমাণ হয় প্রায় ১৫০০ শত বছর পূর্বে পবিত্র কুরআনে যা লিপিবদ্ধ হয়েছিল বহু সাধনার ফলে বিজ্ঞানীরা আজ তা আবিস্কার করতে সমর্থ হয়েছে। এবারে দেখা যাক 'বিগ ব্যাঙ' আবিস্কারের ব্যাপারে কুরআনে কি আছে।
لَمُوسِعُونَ وَالسَّمَاء بَنَيْنَاهَا بِأَيْدٍ وَإِنَّا


আমি স্বীয় ক্ষমতাবলে আকাশ নির্মাণ করেছি এবং নিশ্চয় আমরা এটাকে সম্প্রসারণ করছি। (৫১ঃ আয-যারিয়াত - ৪৭)


أَوَلَمْ يَرَ الَّذِينَ كَفَرُوا أَنَّ السَّمَوَاتِ وَالْأَرْضَ كَانَتَا رَتْقًا فَفَتَقْنَاهُمَا وَجَعَلْنَا مِنَ الْمَاءِ كُلَّ شَيْءٍ حَيٍّ أَفَلَا يُؤْمِنُونَ
যারা কুফরী করে তারা কি ভেবে দেখে না যে, আকাশমন্ডলী ও পৃথিবী মিশে ছিল ওতপ্রোতভাবে; অতঃপর আমি উভয়কে পৃথক করে দিলাম; এবং প্রাণবান সমস্ত কিছু সৃষ্টি করলাম পানি হতে; তবুও কি তারা বিশ্বাস করবে না? (২১ঃ সুরা আম্বিয়া - ৩০)


উল্লেখিত আয়াত দুটির একটি থেকে মহাকাশের সম্প্রসারণ এবং অপরটি থেকে আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীকে একত্রিত হয়ে থাকার কথা জানতে পারি। বিজ্ঞানীদের পর্যবেক্ষণ থেকেও আমরা দেখতে পেয়েছি মহাবিশ্ব সম্প্রসারিত হচ্ছে এবং আসমান-জমিনসহ মহা বিশ্বের সকল পদার্থ একটি ছোট্ট বিন্দুতে পুঞ্জিভূত ছিল। 'বিগ ব্যাঙ' নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে বিজ্ঞানীদের তত্ত্বে কুরআনের আয়াতের প্রতিধ্বনি দেখেছি আমরা। কুরআনে এই কথাগুলি উল্লেখ করা হয়েছে তাদের উদ্দেশ্যে যারা আল্লাহ্‌র বিধান মেনে চলার জন্য নিজেদেরকে প্রস্তুত করতে পারেনি এখনও। কাজেই আল্লাহর দেয়া সত্য ও সুন্দরকে অবলম্বন করে আলোকিত মানুষ হিসাবে নিজেদেরকে তৈরি করে তাঁরই সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে দৃঢ় প্রত্যয়ে এগিয়ে যেতে হবে আমাদের সকলকে।

লেখকঃ আব্দুল মান্নান

কোন মন্তব্য নেই: