বৃহস্পতিবার, ১৩ ডিসেম্বর, ২০১২

যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল নিয়ে ইকোনমিস্টের প্রতিবেদন: একটি জাতির জন্মকালের বিচার


যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল নিয়ে ইকোনমিস্টের প্রতিবেদন:
           একটি জাতির জন্মকালের বিচার
------------------------------------------------------------ 
বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এর বিদায়ী চেয়ারম্যান বিচারপতি মোহাম্মদ নিজামুল হকের সঙ্গে ব্রাসেলস প্রবাসী আইনজীবী আহমেদ জিয়াউদ্দিনের কথোপকথন ও ই-মেইল আদানপ্রদানের বিষয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে লন্ডনভিত্তিক অর্থনীতি-বিষয়ক প্রখ্যাত সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্ট। পত্রিকাটির সর্বশেষ ছাপা সংস্করণে প্রতিবেদটি প্রকাশের পাশাপাশি অনলাইনেও তা প্রকাশ করা হয়েছে।
প্রতিবেদনটি সঙ্গে সঙ্গে সম্পাদকের পক্ষ
থেকে একটা ব্যাখ্যাও দেওয়া হয়েছে। সেখানে ইকনমিস্ট হ্যাক করা ই মেইল বার্তা ও টেলিফোন আলাপের (স্কাইপে মাধ্যমে করা) ভিত্তিতে তৈরি এই প্রতিবেদন প্রকাশ করছে।
ইকনমিস্টের প্রতিবেদনটি পাঠকদের জন্য প্রায় হুবহু প্রকাশ করা হলো।

ব্যাপক সহিংসতার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের জন্ম। ১৯৭১ সালের শেষের দিনগুলোতে তত্কালিন পূর্ব পাকিস্তানে ব্যাপক নির্যাতন, ধর্ষণ, ব্যাপক গণহত্যা সংগঠিত হয়। ওই ঘটনার প্রধান পরিকল্পনাকারী পাকিস্তানি সেনারা ‘পশ্চিম পাকিস্থান’ থেকে পূর্ব পাকিস্তানের বিচ্ছিন্ন হওয়া ঠেকাতে চেয়েছিল। তবে জামায়াতে ইসলামীসহ পূর্ব পাকিস্তানের অনেক মৌলবাদী গোষ্ঠী (পাকিস্তান) সেনাবাহিনীকে সমর্থন করে। জামায়াত এখন বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ইসলামপন্থী দল। ওই সময় তিন লাখের মতো মানুষ নিহত হয়। তবে বর্তমান সরকারের হিসেবে প্রাণহানির সংখ্যা ৩০ লাখ, যা ছিল তখনকার জনসংখ্যার হিসাবে প্রতি ২০ জনে একজন।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে ২০১০ সালে বাংলাদেশ একটি ট্রাইব্যুনাল গঠন করে। এটাকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুানাল বলা হয়। তবে আন্তর্জাতিক আইনের দৃষ্টিতে এটি আন্তর্জাতিক আদালত নয়। ১৯৭৩ সালে পাস হওয়া এবং ২০০৯ ও ২০১২ সালে সংশোধিত আইনের ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা এ ট্রাইব্যুনাল একটা দেশীয় আদালত। অভিযুক্ত ও ক্ষতিগ্রস্ত উভয়পক্ষের জন্যই বেশ বিলম্বেই এ বিচার শুরু হয়েছে। তবে যুদ্ধাপরাধের বিচারের ক্ষেত্রে কোনো আইনগত সীমাবদ্ধতা নেই।
এই অপরাধের প্রধান হোতারা আদালতে নেই। তাঁরা কেউ মারা গেছেন, অথবা পাকিস্তানে বাস করছেন। তবে কিছু সন্দেহভাজন খ্যাতিমান ব্যক্তিত্ব এখনো বাংলাদেশে বাস করছেন। ১০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে এবং তাঁদের বিরুদ্ধে ধর্ষণ ও গণহত্যায় নির্দেশের ফৌজদারি অভিযোগ আনা হয়েছে। চলতি সপ্তাহে প্রথম মামলা হিসেবে সাবেক সংসদ সদস্য (১৯৯৬-২০০৮) এবং জামায়াতের নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মামলাটি শেষের দিকে এগোচ্ছে। অনেকেই ধারনা করছিলেন, ডিসেম্বরের মাঝামঝি নাগাদ তাঁর সাজা হবে, এমনকি মৃত্যুদণ্ড হতে পারে।
শেষ মুর্হূতে চেয়ারম্যান মোহাম্মদ নিজামুল হক ট্রাইব্যুনাল থেকে পদত্যাগ করেছেন। মূলত ইকনোমিস্ট ও বাংলাদেশের পত্রিকা তাঁকে প্রশ্নের মুখে ফেলে দেয়, যেখানে তাঁর (বিচারপতি মোহাম্মদ নিজামুল হক) ব্যক্তিগত ই-মেইল বার্তা তাঁর ভূমিকা ও আদালতের প্রক্রিয়া নিয়ে সন্দেহের জন্ম দেয়। তাঁর টেলিফোন কথোপকথনের ধারন করা অংশ ইউটিউবেও আছে। ইকনোমিস্ট এটা এবং অন্যান্য তথ্য-উপাত্ত দেখেছে এবং এর সত্যতা ও তাত্পর্য অনুন্ধান করছে। চলতি সপ্তাহে আমরা এই অনুসন্ধানের ফলাফল প্রকাশ করেছি।
যেসব ই-মেইল বার্তা ও ফোনালাপ আমরা (ইকোনমিস্ট) দেখেছি, তা এই বিচার নিয়ে গভীর প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। এসব তথ্য-উপাত্ত বলছে, সরকার নিজামুল হকের ওপর চাপ দেওয়ার চেষ্টা করেছে, যদিও তিনি তা ঠেকানোর চেষ্টা করেছেন বলে মনে হয়েছে। দেখা গেছে, তিনি ব্রাসেলসভিত্তিক একজন আইনজীবীর সঙ্গে এ বিষয়ে কাজ করেছেন, যা যথাযথ নয়। আর ওই আইনজীবী সরকারির কৌঁসুলিদের সঙ্গে সহযোগিতা করছেন। এই বিষয়টিই পরস্পর বিরোধিতাকে (কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট) সামনে নিয়ে এসেছে। সাঈদীর মামলার ক্ষেত্রে এমন আশঙ্কা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, বিবাদীদের সাক্ষী শুনানি শেষ করার আগেই নিজামুল অভিযুক্তকে দোষী সাব্যস্ত করে রায় দি েচলেছেন।
এই বিষয়টি খুবই উদ্বেগের যে, বিচারকের বিভ্রাট কেবল অভিযুক্তকেই প্রভাবিত করবে না, ট্রাইব্যুনালের ত্রুটি বাংলাদেশকেও ভোগাবে। এ বিষয়টি দেশটির পুরানো ক্ষতকে সারাবে না, বরং আরও গভীর বেদনা তৈরি করবে।
বাংলাদেশের বর্তমান রাজনীতিতে যুদ্ধাপরাধের বিচার অত্যন্ত গুরুত্ব বহন করে। ২০০৮ সালের সাধারণ নির্বাচনের সময় বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ওয়াদা করেছিলেন যে তিনি ক্ষমতায় আসলে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের লক্ষ্যে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করবেন। অভিযুক্ত যুদ্ধাপরাধীদের তালিকায় আছেন প্রধান বিরোধী দল বিএনপির রাজনৈতিক মিত্র বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর কয়েকজন সাবেক ও বর্তমান শীর্ষ নেতা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রধান রাজনৈতিক ‘শত্রু’ খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি জামায়াতের রাজনৈতিক সমর্থন ছাড়া কখনোই বাংলাদেশের রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হতে পারেনি।
অনেকেই মনে করেন ভবিষ্যতে বিএনপি যদি বাংলাদেশের রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হতে পারে, তাহলে খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী হবেন এবং তিনি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের লক্ষ্যে গঠিত এই বিশেষ ট্রাইব্যুনাল বাতিল করে দেবেন। বেগম জিয়া ইতিমধ্যেই যুদ্ধাপরাধীদের এই বিচার প্রক্রিয়াকে ‘প্রহসন’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের এই প্রক্রিয়া যাঁরা সমর্থন করেন, তারা তাই সর্বন্তকরণেই চান আগামী সাধারণ নির্বাচনের আগেই এই বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন হোক। ২০১৩ সালের শেষের দিকে বাংলাদেশে পরবর্তী সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা।
১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন সংক্রান্ত বিশেষ অধ্যাদেশে বলা হয়েছে, ‘যদি বিচারকাজ চলার সময় ট্রাইব্যুনালের কোনো সদস্য অনিবার্য কোনো কারণে বিচার কার্যক্রমে অংশ নিতে অপারগ হন, তার পরেও এই ট্রাইব্যুনালের অন্যান্য সদস্যরা এই বিচার প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন।’
তবে সাক্ষ্য-প্রমাণ যা পাওয়া গেছে, তার ভিত্তিতে বলা যায় এই বিচার প্রক্রিয়ায় পূর্নর্মূল্যায়ণ হয়তো দরকার হতে পারে।
‘রায়ের জন্য পাগল’
এই তথ্য-উপাত্তের প্রথম অংশ প্রশ্ন তুলতে পারে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়ার ব্যাপারে সরকারের আচরণ নিয়ে। এর মাধ্যমে বোঝা যাচ্ছে যে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য গঠিত এই বিশেষ ট্রাইব্যুনাল সরকারের চাপের মুখে রয়েছে। যদিও বাংলাদেশের সংবিধানে বিচার বিভাগের পূর্ণ স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হয়েছে।
গত ১৪ অক্টোবর বিচারপতি নিজামুল হক এবং ব্রাসেলস ভিত্তিক বাংলাদেশি আইনজীবী আহমেদ জিয়াউদ্দিনের মধ্যকার কথোপকথন থেকে জানা যায়, বিচারক নিজামুল হক আহমেদ জিয়াউদ্দিনকে বলছেন, ‘সরকার অস্থির, এরা পাগল হয়ে গেছে। আমি আপনাকে বলছি, তারা ১৬ ডিসেম্বরের মধ্যে রায় চায়…ব্যাপারটি এমনই।’ ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের ‘বিজয় দিবস’। ১৯৭১ সালের এই দিনে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের শেষ লগ্নে ঢাকায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী আত্মসমর্পণ করেছিল।
বিচার প্রক্রিয়া দ্রুত শেষ করার ব্যাপারে সরকারের বদ্ধ পরিকর হওয়ার বিষয়টি তো আছেই, বিচারপতি নিজামুল ও আহমেদ জিয়াউদ্দিনকে যে ব্যাপারটি (ইকোনমিস্টকে) চিন্তিত করে তুলেছে, তা হল, এ ব্যাপারে মন্ত্রীদের অতিরিক্ত চাপ। ‘আমাদেরকে একটি ব্যাপার তাদের বোঝাতে হবে, যে এটি কোনো পণ্য নয় যে আপনি হুকুম করবেন আর যন্ত্রের মাধ্যমে তা তৈরি হয়ে বেরিয়ে আসবে’— এই বলে আহমেদ জিয়াউদ্দিন আরও যোগ করেন, ‘আমরা বিষয়টি তাদের বোঝানোর অবস্থাতেও নেই। তারপরেও আমরা চেষ্টা করতে পারি, তাদের সঙ্গে কথা বলতে পারি।’
বিচারের রায় দ্রুত ঘোষণা করার অনুরোধ করা এক জিনিস আর বিচার-প্রক্রিয়ায় হস্তক্ষেপ করে রায় বের করে নিয়ে যাওয়া আরেক জিনিস। বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কার্যক্রমে পরের ব্যাপারটি ঘটেছে বলেই মনে করা হচ্ছে। পরের দিনের আরেক স্কাইপ কথোপকথনে বিচারপতি নিজামুল বলছেন কীভাবে সেদিন সন্ধ্যাতেই সরকারের একজন ব্যক্তি তাঁর কাছে এসে বিচারের রায় দ্রুত দিয়ে দেওয়ার কথা বলেছেন। নিজামুল বলেন, ‘আমি তাঁকে বললাম, সেটা কীভাবে সম্ভব?’ সরকারের সেই ব্যক্তি নিজামুলকে বলেন, ‘যত দ্রুত সম্ভব’ রায়টা দিয়ে দিন।
গত ৫ ডিসেম্বর এক টেলিফোন সাক্ষাত্কারে (ইকোনমিস্টের সঙ্গে) বিচারপতি নিজামুল এই বিচার প্রক্রিয়ায় তাঁর ওপর কোনো রাজনৈতিক চাপের কথা অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, তিনি এই আদালতের প্রধান ব্যক্তি। তাঁর ভাষায়, ‘এই আদালতে আমাদের নিজস্ব পদ্ধতি ও পছন্দ অনুযায়ী নিজেদের কার্যপ্রণালীই অনুসরণ করা হয়।’
তথ্য-উপাত্ত থেকে বোঝা যাচ্ছে যে এই আদালতের বিচারক হিসেবে নিজামুল হকের নিরপেক্ষতা প্রশ্নের সম্মুখীন। নিজামুল হক বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্টের (হাইকোর্ট বিভাগের) একজন বিচারপতি। যুদ্ধাপরাধের বিচার সংক্রান্ত ট্রাইবুন্যাল থেকে পদত্যাগের পরেও তিনি সুপ্রিম কোর্টের অন্যতম বিচারপতি পদেই অধিষ্ঠিত থাকবেন। ( তিন থেকে পাঁচজন বিচারক নিয়ে এই ট্রাইব্যুনাল গঠিত, এতে কোনো জুরি নেই)। বিচারপতি নিজামুল যাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন, সেই আহমেদ জিয়াউদ্দিন একজন প্রবাসী বাংলাদেশি। তিনি একজন আন্তর্জাতিক আইন বিশেষজ্ঞ। তিনি বেলজিয়ামে বাংলাদেশ সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিস নামের একটি সংস্থার পরিচালক। বিচারপতি নিজামুল হক ও আহমেদ জিয়াউদ্দিন একে অন্যকে চেনেন প্রায় ২৫ বছর ধরে। তাঁরা দুজনেই মানবাধিকার বিষয়ক বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত। জিয়াউদ্দিনের প্রয়াত ভাই বিচারপতি নিজামুল হকের ছাত্র অবস্থা থেকে বন্ধু ছিলেন।
উপদেষ্টা
তথ্য মতে, জনাব জিয়াউদ্দিনকে এ বিচারের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি বলে মনে করা হয়েছে। বিশেষ করে তাঁর পরামর্শ। বিচারপতি নিজামুলের করণীয় বিষয়ে নানা পরামর্শ, বিভিন্ন নথির জোগানদাতা হিসেবে তাঁকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হয়। স্বাভাবিকভাবে, কোনো মামলার বিষয় নিয়ে আলোচনা করার সময় বিচারককে প্রচুর সতর্কতা অবলম্বন করতে। বিশেষ করে, যদি সংশ্লিষ্ট মামলার বাইরে তৃতীয় কোনো পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করার সময়। কারণ, এটা অনেক সময় মামলার রায়, বিচারকাজকে প্রভাবিত করতে পারে। আর এ কথাটা বাংলাদেশের সংবিধানেও বলা হয়েছে। সংবিধানে বলা আছে যে. সংবিধানের বিধানাবলি-সাপেক্ষে প্রধান বিচারপতি এবং অন্যান্য বিচারক বিচারকার্য পালনের ক্ষেত্রে স্বাধীন থাকবেন। বিচারকদের কোড অব কনডাক্ট বা আচরণবিধিতে বলা হয়েছে, ‘একটি স্বাধীন বিচার ব্যবস্থা বাংলাদেশের বিচার পদ্ধতির জন্য অপরিহার্য।
বাংলাদেশের ক্ষেত্রে যুদ্ধাপরাধের মামলাটি একটি বিশেষ মামলা। বিশেষ ট্রাইবুনাল স্থানীয় আদালতের মতো হলেও এর কর্মকর্তারা ট্রাইব্যুনালের আন্তর্জাতিক মানদণ্ড বজায় রাখতে আগ্রহী। তবে সমস্যা হচ্ছে, এ ধরনের মামলার ক্ষেত্রে ট্রাইবুনালটির হাতে তেমন কোনো উদাহরণ নেই। ট্রাইবুনালের বিচারক জনাব নিজামুল ট্রাইবুনালের কাজের মানের উন্নয়ন নিয়ে আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলোচনা করেছেন। জনাব নিজামুল অবশ্য তাঁর পক্ষে এ যুক্তিটিই দাঁড় করিয়েছেন। ৬ ডিসেম্বরের নির্দেশ অনুসারে, এ ট্রাইবুনালটি নতুন আইন অনুযায়ী গঠন করা হয়েছে। যাতে বলা হয়েছে, ট্রাইবুনালের বিচারকরা দেশ ও দেশের বাইরের বিভিন্ন গবেষকদের সাহায্য নিতে পারবেন। এ আইন অনুযায়ী, জনাব জিয়াউদ্দিনকে একজন বিশেষজ্ঞ হিসেবে মানা হয়। বিচার চলার সময় ট্রাইবুনালের চেয়রাম্যান তাঁর (জিয়াউদ্দিন) পরামর্শ নিয়েছেন। ৪ ডিসেম্বর তারিখে ইকনমিস্টকে দেওয়া এক সাক্ষাত্কারে জনাব জিয়াউদ্দিনও একই ধরনের কথা বলেছিলেন। তাঁর কথায়, ‘বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে কোনো ধরনের গবেষণা বা অন্য সহযোগিতা নেবেন কি না সেটা একান্তই বিচারকের ওপর নির্ভর করে। তাঁরা এটা করতেই পারেন। তাদের কাছে যখন এসব বিষয়ে কোনো উদাহরণ থাকে না তখনই বিশেষজ্ঞদের কাছে যেতে হয়। যদি তাঁদের মনে হয়, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে নতুন এ বিষয়টি নিয়ে পরামর্শের প্রয়োজন আমি তাঁদের সাহায্য করতে রাজি।
ইকনমিস্টের পক্ষ ৫ ডিসেম্বর ট্রাইবুনাল বিচারপতির এক সাক্ষাত্কার নেওয়া হয়। জিয়াউদ্দিনের সঙ্গে বিচারকের কথার গরমিল দেখা দেয় এ সাক্ষাত্কারের পর। ওই দিন সন্ধ্যায় রায় দেওয়ার পূর্বে জনাব নিজামুল স্বীকার করেন যে, তিনি ও জনাব জিয়াউদ্দিন কথা বলেছেন। তবে মামলার বিষয়ে তাঁর মতামত নেওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করেন তিনি।
নিজামুল হক বলেন, ‘বিচারক হিসেবে আমরা তৃতীয় পক্ষ বা বাইরের কারও কাছ থেকে সাহায্য নিতে পারি না।’ তাঁকে যখন জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, ‘তাঁরা ট্রাইবুনাল বিষয়ে পরস্পর ই-মেইল আদান প্রদান করেছেন কি না? তখন তিনি উত্তর দিয়েছিলেন, ‘ না, না, না ট্রাইবুনাল সম্পর্কিত, বিচার বা বিচারকাজ পরিচালনা-সম্পর্কিত কোনো কথা হয়নি। তিনি এ সাক্ষাত্কারে আরও বলেছিলেন, ‘সুপ্রিম কোর্টের বিচারক হিসেবে আমরা বউয়ের সঙ্গেও এ ট্রাইবুনাল নিয়ে আলোচনা করতে পারি না।’
আগের দিনে দেওয়া সাক্ষাত্কারে জনাব জিয়াউদ্দিনও একই কথা বলেছিলেন যে, কোনো তৃতীয় পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করার সময় বিচারককে অবশ্যই সতর্ক হতে হবে। তিনি আরও জানান, এ সম্পর্কে (আদালতের) কোনো অবস্থান নেই। এ মামলার সঙ্গে জড়িতও নন। তবে তিনি (বিচারক) চাইলে এ সম্পর্কিত বার্তা তাঁকে পাঠাতে পারেন। যদিও আমি তা করি না। যতই হোক তিনি একজন বিচারপতি তো।
অবশ্য একজন বিচারক কারও পরামর্শ নিতেই পারেন। কিন্তু তখনই কেবল তা হতে পারে যদি কোনো পরামর্শক আনুষ্ঠানিকভাবে এ বিষয়ে দায়িত্ব পান বা দুই পক্ষের জেরার বিষয়গুলো অবগত থাকেন। সাধারণ নিয়ম অনুসারে, পরামর্শকরা তাদের নির্দিষ্ট বিষয়ের পরামর্শ দেন এবং আইনের বিষয়গুলো জানান।
জিয়াউদ্দিনের ক্ষেত্রে এসব নিয়ম মানা হয়নি। ৬ ডিসেম্বর ট্রাইবুনালের দেওয়া রায়ের আগে জিয়াউদ্দিনের ভূমিকা আদালতে বা জনসমক্ষে জানানো হয়নি। এমনকি তাঁর পরামর্শ নির্দিষ্ট আইনের বাইরেও চলে গেছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, অভিযোগের খসড়া তৈরি। আগস্ট মাসের ২৮ তারিখ থেকে অক্টোবর মাসের ২০ তারিখ পর্যন্ত দুজন ১৭ ঘণ্টারও বেশি কথা বলেছেন, যা প্রতিদিনের হিসেবে গড়ে প্রায় ২০ মিনিট। তাঁরা একে অপরের সঙ্গে ২৩০টিরও বেশি ইমেইল আদান প্রদান করেছেন। তাদের মধ্যে যেসব মেইল আদান প্রদান করা হয়েছে তাতে জিয়াউদ্দিনের যে ভূমিকা দেখা গেছে তা একজন বিশেষজ্ঞ বা পরামর্শকের ভূমিকার বাইরেও তিনি অনেকদূর গেছেন। প্রতিটি অভিযোগ যেখানে পরিশীলিত হতে হয় বা যথেষ্ট ব্যাখা দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে, তা গোলমেলে করা হয়েছে। প্রথমত জনাব জিয়াউদ্দিন এ ট্রাইবুনালের জন্য বিভিন্ন ডকুমেন্ট তৈরি করে দেন, যা এ বিচারকের কথাতেই, ঠিক কাজ নয়।
মে মাসের ১২ তারিখ ব্রাসেলসভিত্তিক আইনজীবী জিয়াউদ্দিন ট্রাইবুনালের বিচারক নিজামুল হককে ‘গোলাম আজম চার্জেস ফাইনাল ড্রাফট’ নামে একটি নথি পাঠান। এ নথিটি মাত্র ছয়দিন আগে পাঠানো নথির সঙ্গে সামান্য পরিবর্তন দেখা যায়। ১৩ মে তারিখে ট্রাইবুনাল গোলাম আযমের বিরুদ্ধে অভিযোগ দাখিল করে। তবে সাক্ষাত্কারে দুজনই সাহায্য নেওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করেন।
দ্বিতীয়ত, তাদের দুজনের কথোপকথন মামলা সংশ্লিষ্ট পরামর্শের বাইরেও অনেকদূর গেছে। ৬ সেপ্টেম্বর জনাব নাজমুল বলেন, ‘আমি শাহিনূরকে নিয়ে একটু ভয় পাচ্ছি (শাহিনুর ইসলাম, এ ট্রাইবুনালের বিচারক) কারণ সে আন্তর্জাতিক মান নিয়ে থাকতে চায়। ওই লোকের টার্গেটই হল যে, সে সবার চেয়ে বেশি বুঝে। প্রতিটি অর্ডারেই বিদেশি রেফারেন্স টেনে আনে সে।’
জবাবে জনাব জিয়া বলেন, ‘ওকে এটা করা থেকে থামাতে হবে বা তাকে ট্রাইবুনালের বাইরে রাখতে হবে। তাকে থামানো না গেলে বা সে এভাবে গেলে আমাদের জন্য ক্ষতির কারণ হতে পারে। এখানে জনাব জিয়াউদ্দিন একজন বিচারককে সরিয়ে দেওয়ার মত বিষয়ে কথা বলেছেন।
খুবই উদ্বিগ্ন
২০১১ সালের ২৬ নভেম্বর নিজামুল (অনানুষ্ঠানিকভাবে যিনি নাসিম হিসেবে পরিচিত) গুরুত্বপূর্ণ একটি আত্মরক্ষা আবেদন (ডিফেন্স পিটিশন) সম্বন্ধে জিয়াউদ্দিনকে আবার একটি ই-মেইল পাঠান। তাঁর পুরো বার্তাটি ছিল, ‘‘ বিষয়: আদেশ: এখনো পাইনি। খুবই উদ্বিগ্ন। দয়া করে বাংলাদেশ সময় আজ রাতের মধ্যেই পাঠান, অন্যথায় আমি আমার নিজেরটিই প্রয়োগ করব। নাসিম।’’
নিজামুলের ই-ইমেইল থেকে বোঝা যায়, তিনি জিয়াউদ্দিনের যুক্তিকেই নিজ বিবেচনার চেয়ে বেশি প্রাধান্য দিয়েছেন।
তৃতীয়ত, আমরা যেসব উপকরণ পেয়েছি তা থেকে মনে হয় জিয়াউদ্দিন একই সময়ে একই বিষয়ে বিচার প্রক্রিয়ায় নিয়োজিত কৌঁসুলি (প্রসিকিউশন) এবং বিচারকদের সঙ্গে যোগাযোগ করছিলেন।
২০১১ সালের ৮ নভেম্বর তিনি বিচারক বিচারপ্রক্রিয়া থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখছেন মর্মে একটি আত্মরক্ষা আবেদনে উত্থাপিত কয়েকটি বিষয় নিজামুলকে ই-মেইল করেন। ওই ই-মেইলে বলা হয়েছে, ট্রাইব্যুনালের প্রধান কৌঁসুলি জিয়াদ আল-মালুম ওই তালিকায় থাকা প্রথম পাঁচটি বিষয় (উপকরণ ও নথি) নিজামুলকে সরবরাহ করবেন।
একজন বিচারক এ ধরনের উপকরণ গ্রহণ করতে পারেন এবং এটি আদালতে বিতর্ক তৈরির কোন বিষয় ছিল না। এটিও সত্য যে, কৌঁসুলি এ ধরনের উপকরণ সরবরাহ করার ক্ষেত্রে সর্বোত্তম ব্যক্তি। উত্সাহব্যঞ্জক ব্যাপার হলো, প্রধান কৌঁসুলি যার সাহায্য চাচ্ছেন, সেই ব্যক্তি বিচারককেও পরামর্শ দিচ্ছেন।
বিচারক, কৌঁসুলি এবং উপদেষ্টার মধ্যে যোগাযোগ দৃশ্যত চলছিল। ২০১১ সালের ১১ ডিসেম্বর গোলাম আযমের বিরুদ্ধে মামলার বিষয়ে পরামর্শ ও যুক্তি উপস্থাপনে সাহায্য করতে মালুমসহ দুজন কৌঁসুলিকে একটি ই-মেইল পাঠান জিয়াউদ্দিন। একইদিনে ওই উপদেশবার্তা নিজামুল হককেও পাঠান জিয়াউদ্দিন।
আমাদের সঙ্গে আলাপে জিয়াউদ্দিন মালুমকে চেনেন বলে স্বীকার করেছেন। তবে ট্রাইব্যুনালের মামলা নিয়ে অযাচিত যোগাযোগ করেননি বলে জানান তিনি। এদিকে মালুম আমাদের প্রশ্নের কোনো জবাব দেননি।
আমরা যেসব উপকরণ পেয়েছি তা থেকে তিনটি বিষয় উঠে আসে। এগুলো হলো- কৌঁসুলি যেভাবে মামলা সাজিয়েছে এবং আদালত যেভাবে অভিযোগ উত্থাপন করেছে, তার ওপর জিয়াউদ্দিনের প্রভাব ছিল। জিয়াউদ্দিন ২০১১ সালের ডিসেম্বরে ই-মেইলে বিচারককে বলেছিলেন কীভাবে কৌঁসুলিরা তাদের মামলা সাজাতে পারেন। যখন কৌঁসুলিরা তাদের অভিযোগ উত্থাপন করল, তখন আনুষ্ঠানিক অভিযোগ সম্বন্ধে জিয়াউদ্দিনের নির্দেশনা সরাসরি অনুসরণ করলেন বিচারক।
সবশেষে সাঈদীর মামলা নিয়ে নিজামুলকে পাঠানো জিয়াউদ্দিনের একটি ই-মেইল ছিল ‘সাঈদী জাজমেন্ট’ নামক গুগলে শেয়ার করা একটি নথি। ওই নথিতে বলা হয়, ‘সর্বশেষ সম্পাদনা করা হয় ১৪ অক্টোবর’। এই সময়ে সাঈদীর আইনজীবীরা তাঁর সম্বন্ধে আদালতে আত্মপক্ষ সমর্থনের আবেদন জানিয়েছিলেন।
ওই নথিতে বেশ কয়েকটি বিষয় (সাক্ষীদের তালিকা, বিচারপ্রক্রিয়ার ইতিবৃত্ত, চ্যালেঞ্জ ইত্যাদি) ছিল। পরবর্তী সময়ে সত্য বলে ধরা যায়, এমন বিষয় নথিবদ্ধ করা হবে। চূড়ান্ত শিরোনাম ছিল বড় হাতে লেখা ‘‘কনভিকশন/বেসিস’’ (দোষী সাব্যস্তকরণ/মূলভিত্তি) এবং ‘‘সেনটেনসিং’’ (সাজা দেওয়া)।
একটি দীর্ঘ বিচারকাজের রায়ের অনেক আগ থেকেই কাজ শুরু করেন আদালত। নিজামুল হক কাউকে ‘দোষী সাব্যস্ত’ না করে ‘বেকসুর খালাস’ করে দিতে পারেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত তাঁর কাজকর্মে তেমনটি মনে হয়নি। তিনি অক্টোবরের নথি নিয়ে কাজ করার বিষয়টি অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, সে সময় দেলাওয়ার হোসাইনের বিচারকাজ শুরুই হয়নি।
যুক্তিসঙ্গত প্রশ্ন
বিচারক আমাদের অভিযোগকে ‘‘সম্পূর্ণভাবে উদ্ভট’’ এবং ‘‘সর্বৈব মিথ্যা’’ বলেছেন। জিয়াউদ্দিন বলেছেন আমাদের প্রাপ্ত তথ্যের ভিন্ন ব্যাখ্যা রয়েছে। তবে দ্য ইকোনমিস্টকে আদালত হাজির হতে বলার পর তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হয়নি। আমরা কোনো আইন লঙ্ঘন করেছি মনে করি না। উপরন্তু আমাদের তদন্তে ট্রাইব্যুনালে প্রতিপক্ষের দৃষ্টিভঙ্গিগত কোনো বিষয় উঠে আসেনি। তা সত্ত্বে আমাদের কাছে থাকা উপকরণগুলো যথাযথ বিচারপ্রক্রিয়া নিয়ে বেশ কিছু যুক্তিসঙ্গত প্রশ্নের উদ্রেক করেছে। বাংলাদেশের উচিত বিষয়গুলো নিয়ে যথাযথ তদন্ত করা। নিজামুলের পদত্যাগের আলোকে এ ধরনের তদন্ত খুবই জরুরি।
ইকোনমিস্ট সম্পাদকের কথা
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হক ও বেলজিয়াম প্রবাসী বাংলাদেশি আইন বিশেষজ্ঞ আহমেদ জিয়াউদ্দিনের মধ্যকার টেলিফোন আলাপ ও ২৩০টি ইমেইলের ওপর ভিত্তি করে এই নিবন্ধটি তৈরি করা হয়েছে।
সাধারণত ইকোনমিস্ট পত্রিকা ব্যক্তিগত ও গোপনীয় ইমেইল ও টেলিফোন কথোপকথন প্রকাশ করে না। কিন্তু এটি প্রকাশিত হল কারণ এ ব্যাপারে সাধারণ মানুষের আগ্রহ আছে। এর সঙ্গে বিচার বিভাগের সুনাম জড়িত।
হাতে পাওয়া এই কথোপকথন ও ই-মেইলগুলো সত্যতা যাচাই করতে ইকোনমিস্ট যতটা সম্ভব সব ধরনের উদ্যোগই গ্রহণ করেছে। আমরা বিচারপতি নিজামুল হক ও আহমেদ জিয়াউদ্দিনের সঙ্গেও কথা বলেছি। তাঁরা এই কথোপকথনের সত্যতা স্বীকার করেছেন। এমনকি এই বিষয়ে তাঁরা আরও কিছু মন্তব্য করতেও রাজি ছিলেন। কিন্তু গত ৬ ডিসেম্বর বিচারপতি নিজামুল হক (তিনি তখনো আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন।) আদেশ জারি করলেন, ইকোনমিস্টের দুই জন সদস্যকে আদালতে হাজির হয়ে জানাতে হবে যে আমরা কীভাবে এই কথোপকথনের তথ্য ও ইমেইলগুলো হাতে পেয়েছি। এর পরপরই আমরা বিচারপতি নিজামুল ও ও আহমেদ জিয়াউদ্দিনের সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দিই।
সাধারণত আমরা হাতে পাওয়া তথ্য-উপাত্তের সূত্র প্রকাশ করি। কিন্তু এক্ষেত্রে আমরা আশঙ্কা করেছি, তথ্য-উপাত্তের সূত্র প্রকাশ করলে হয় দুই ব্যক্তি অস্বীকার করবেন অথবা তাদের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে। বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের আকাশে ইতিমধ্যেই সহিংসতার কালো মেঘ জমেছে। গত ৫ নভেম্বর একজন অভিযুক্তের সাক্ষীকে সাক্ষ্য দেওয়া থেকে বিরত রাখা হয়, এবং সেই সাক্ষী এরপর থেকেই নিখোঁজ। আশঙ্কা করা হচ্ছে, ট্রাইব্যুনালের সদর দরজা থেকে অভিযুক্তের সেই সাক্ষীকে তুলে নিয়ে গেছে বাংলাদেশ পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ। সরকার ব্যাপারটি অস্বীকার করলেও সেই সাক্ষীর আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি।
একটি বিষয় বলা ভালো, এই কথোপকথনের রেকর্ড ও ইমেইলগুলো পাওয়ার জন্য আমরা কাউকে অনুরোধ করিনি। আমরা এজন্য একটি পয়সাও খরচ করিনি। এমনকি আমরা আমাদের সূত্রকেও নিশ্চিত করে বলিনি যে এটি ছাপা হবে। তবে হাতে পাওয়া তথ্য-উপাত্তগুলো যে মিথ্যা, সেটিও বলার মতো অবস্থায় নেই আমরা।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুন্যালে অভিযুক্তরা সত্যিই দোষী না নির্দোষ , এ ব্যাপারেও দ্য ইকোনমিস্ট কিছু জানে না। ইকোনমিস্ট এও জানে না যে, অভিযুক্তরা নিজেদের নির্দোষ প্রমাণে সত্যিই ন্যায়-বিচার পাবেন কি না।

http://www.economist.com/news/briefing/21568349-week-chairman-bangladeshs-international-crimes-tribunal-resigned-we-explain
বাংলাদেশ
ের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এর বিদায়ী চেয়ারম্যান বিচারপতি মোহাম্মদ নিজামুল হকের সঙ্গে ব্রাসেলস প্রবাসী আইনজীবী আহমেদ জিয়াউদ্দিনের কথোপকথন ও ই-মেইল আদানপ্রদানের বিষয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে লন্ডনভিত্তিক অর্থনীতি-বিষয়ক প্রখ্যাত সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্ট। পত্রিকাটির সর্বশেষ ছাপা সংস্করণে প্রতিবেদটি প্রকাশের পাশাপাশি অনলাইনেও তা প্রকাশ করা হয়েছে।
প্রতিবেদনটি সঙ্গে সঙ্গে সম্পাদকের পক্ষ
থেকে একটা ব্যাখ্যাও দেওয়া হয়েছে। সেখানে ইকনমিস্ট হ্যাক করা ই মেইল বার্তা ও টেলিফোন আলাপের (স্কাইপে মাধ্যমে করা) ভিত্তিতে তৈরি এই প্রতিবেদন প্রকাশ করছে।
ইকনমিস্টের প্রতিবেদনটি পাঠকদের জন্য প্রায় হুবহু প্রকাশ করা হলো।
ব্যাপক সহিংসতার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের জন্ম। ১৯৭১ সালের শেষের দিনগুলোতে তত্কালিন পূর্ব পাকিস্তানে ব্যাপক নির্যাতন, ধর্ষণ, ব্যাপক গণহত্যা সংগঠিত হয়। ওই ঘটনার প্রধান পরিকল্পনাকারী পাকিস্তানি সেনারা ‘পশ্চিম পাকিস্থান’ থেকে পূর্ব পাকিস্তানের বিচ্ছিন্ন হওয়া ঠেকাতে চেয়েছিল। তবে জামায়াতে ইসলামীসহ পূর্ব পাকিস্তানের অনেক মৌলবাদী গোষ্ঠী (পাকিস্তান) সেনাবাহিনীকে সমর্থন করে। জামায়াত এখন বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ইসলামপন্থী দল। ওই সময় তিন লাখের মতো মানুষ নিহত হয়। তবে বর্তমান সরকারের হিসেবে প্রাণহানির সংখ্যা ৩০ লাখ, যা ছিল তখনকার জনসংখ্যার হিসাবে প্রতি ২০ জনে একজন।

যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে ২০১০ সালে বাংলাদেশ একটি ট্রাইব্যুনাল গঠন করে। এটাকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুানাল বলা হয়। তবে আন্তর্জাতিক আইনের দৃষ্টিতে এটি আন্তর্জাতিক আদালত নয়। ১৯৭৩ সালে পাস হওয়া এবং ২০০৯ ও ২০১২ সালে সংশোধিত আইনের ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা এ ট্রাইব্যুনাল একটা দেশীয় আদালত। অভিযুক্ত ও ক্ষতিগ্রস্ত উভয়পক্ষের জন্যই বেশ বিলম্বেই এ বিচার শুরু হয়েছে। তবে যুদ্ধাপরাধের বিচারের ক্ষেত্রে কোনো আইনগত সীমাবদ্ধতা নেই।
এই অপরাধের প্রধান হোতারা আদালতে নেই। তাঁরা কেউ মারা গেছেন, অথবা পাকিস্তানে বাস করছেন। তবে কিছু সন্দেহভাজন খ্যাতিমান ব্যক্তিত্ব এখনো বাংলাদেশে বাস করছেন। ১০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে এবং তাঁদের বিরুদ্ধে ধর্ষণ ও গণহত্যায় নির্দেশের ফৌজদারি অভিযোগ আনা হয়েছে। চলতি সপ্তাহে প্রথম মামলা হিসেবে সাবেক সংসদ সদস্য (১৯৯৬-২০০৮) এবং জামায়াতের নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মামলাটি শেষের দিকে এগোচ্ছে। অনেকেই ধারনা করছিলেন, ডিসেম্বরের মাঝামঝি নাগাদ তাঁর সাজা হবে, এমনকি মৃত্যুদণ্ড হতে পারে।
শেষ মুর্হূতে চেয়ারম্যান মোহাম্মদ নিজামুল হক ট্রাইব্যুনাল থেকে পদত্যাগ করেছেন। মূলত ইকনোমিস্ট ও বাংলাদেশের পত্রিকা তাঁকে প্রশ্নের মুখে ফেলে দেয়, যেখানে তাঁর (বিচারপতি মোহাম্মদ নিজামুল হক) ব্যক্তিগত ই-মেইল বার্তা তাঁর ভূমিকা ও আদালতের প্রক্রিয়া নিয়ে সন্দেহের জন্ম দেয়। তাঁর টেলিফোন কথোপকথনের ধারন করা অংশ ইউটিউবেও আছে। ইকনোমিস্ট এটা এবং অন্যান্য তথ্য-উপাত্ত দেখেছে এবং এর সত্যতা ও তাত্পর্য অনুন্ধান করছে। চলতি সপ্তাহে আমরা এই অনুসন্ধানের ফলাফল প্রকাশ করেছি।

যেসব ই-মেইল বার্তা ও ফোনালাপ আমরা (ইকোনমিস্ট) দেখেছি, তা এই বিচার নিয়ে গভীর প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। এসব তথ্য-উপাত্ত বলছে, সরকার নিজামুল হকের ওপর চাপ দেওয়ার চেষ্টা করেছে, যদিও তিনি তা ঠেকানোর চেষ্টা করেছেন বলে মনে হয়েছে। দেখা গেছে, তিনি ব্রাসেলসভিত্তিক একজন আইনজীবীর সঙ্গে এ বিষয়ে কাজ করেছেন, যা যথাযথ নয়। আর ওই আইনজীবী সরকারির কৌঁসুলিদের সঙ্গে সহযোগিতা করছেন। এই বিষয়টিই পরস্পর বিরোধিতাকে (কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট) সামনে নিয়ে এসেছে। সাঈদীর মামলার ক্ষেত্রে এমন আশঙ্কা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, বিবাদীদের সাক্ষী শুনানি শেষ করার আগেই নিজামুল অভিযুক্তকে দোষী সাব্যস্ত করে রায় দি েচলেছেন।
এই বিষয়টি খুবই উদ্বেগের যে, বিচারকের বিভ্রাট কেবল অভিযুক্তকেই প্রভাবিত করবে না, ট্রাইব্যুনালের ত্রুটি বাংলাদেশকেও ভোগাবে। এ বিষয়টি দেশটির পুরানো ক্ষতকে সারাবে না, বরং আরও গভীর বেদনা তৈরি করবে।
বাংলাদেশের বর্তমান রাজনীতিতে যুদ্ধাপরাধের বিচার অত্যন্ত গুরুত্ব বহন করে। ২০০৮ সালের সাধারণ নির্বাচনের সময় বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ওয়াদা করেছিলেন যে তিনি ক্ষমতায় আসলে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের লক্ষ্যে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করবেন। অভিযুক্ত যুদ্ধাপরাধীদের তালিকায় আছেন প্রধান বিরোধী দল বিএনপির রাজনৈতিক মিত্র বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর কয়েকজন সাবেক ও বর্তমান শীর্ষ নেতা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রধান রাজনৈতিক ‘শত্রু’ খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি জামায়াতের রাজনৈতিক সমর্থন ছাড়া কখনোই বাংলাদেশের রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হতে পারেনি।

অনেকেই মনে করেন ভবিষ্যতে বিএনপি যদি বাংলাদেশের রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হতে পারে, তাহলে খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী হবেন এবং তিনি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের লক্ষ্যে গঠিত এই বিশেষ ট্রাইব্যুনাল বাতিল করে দেবেন। বেগম জিয়া ইতিমধ্যেই যুদ্ধাপরাধীদের এই বিচার প্রক্রিয়াকে ‘প্রহসন’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের এই প্রক্রিয়া যাঁরা সমর্থন করেন, তারা তাই সর্বন্তকরণেই চান আগামী সাধারণ নির্বাচনের আগেই এই বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন হোক। ২০১৩ সালের শেষের দিকে বাংলাদেশে পরবর্তী সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা।
১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন সংক্রান্ত বিশেষ অধ্যাদেশে বলা হয়েছে, ‘যদি বিচারকাজ চলার সময় ট্রাইব্যুনালের কোনো সদস্য অনিবার্য কোনো কারণে বিচার কার্যক্রমে অংশ নিতে অপারগ হন, তার পরেও এই ট্রাইব্যুনালের অন্যান্য সদস্যরা এই বিচার প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন।’
তবে সাক্ষ্য-প্রমাণ যা পাওয়া গেছে, তার ভিত্তিতে বলা যায় এই বিচার প্রক্রিয়ায় পূর্নর্মূল্যায়ণ হয়তো দরকার হতে পারে।
‘রায়ের জন্য পাগল’

এই তথ্য-উপাত্তের প্রথম অংশ প্রশ্ন তুলতে পারে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়ার ব্যাপারে সরকারের আচরণ নিয়ে। এর মাধ্যমে বোঝা যাচ্ছে যে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য গঠিত এই বিশেষ ট্রাইব্যুনাল সরকারের চাপের মুখে রয়েছে। যদিও বাংলাদেশের সংবিধানে বিচার বিভাগের পূর্ণ স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হয়েছে।
গত ১৪ অক্টোবর বিচারপতি নিজামুল হক এবং ব্রাসেলস ভিত্তিক বাংলাদেশি আইনজীবী আহমেদ জিয়াউদ্দিনের মধ্যকার কথোপকথন থেকে জানা যায়, বিচারক নিজামুল হক আহমেদ জিয়াউদ্দিনকে বলছেন, ‘সরকার অস্থির, এরা পাগল হয়ে গেছে। আমি আপনাকে বলছি, তারা ১৬ ডিসেম্বরের মধ্যে রায় চায়…ব্যাপারটি এমনই।’ ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের ‘বিজয় দিবস’। ১৯৭১ সালের এই দিনে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের শেষ লগ্নে ঢাকায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী আত্মসমর্পণ করেছিল।

বিচার প্রক্রিয়া দ্রুত শেষ করার ব্যাপারে সরকারের বদ্ধ পরিকর হওয়ার বিষয়টি তো আছেই, বিচারপতি নিজামুল ও আহমেদ জিয়াউদ্দিনকে যে ব্যাপারটি (ইকোনমিস্টকে) চিন্তিত করে তুলেছে, তা হল, এ ব্যাপারে মন্ত্রীদের অতিরিক্ত চাপ। ‘আমাদেরকে একটি ব্যাপার তাদের বোঝাতে হবে, যে এটি কোনো পণ্য নয় যে আপনি হুকুম করবেন আর যন্ত্রের মাধ্যমে তা তৈরি হয়ে বেরিয়ে আসবে’— এই বলে আহমেদ জিয়াউদ্দিন আরও যোগ করেন, ‘আমরা বিষয়টি তাদের বোঝানোর অবস্থাতেও নেই। তারপরেও আমরা চেষ্টা করতে পারি, তাদের সঙ্গে কথা বলতে পারি।’
বিচারের রায় দ্রুত ঘোষণা করার অনুরোধ করা এক জিনিস আর বিচার-প্রক্রিয়ায় হস্তক্ষেপ করে রায় বের করে নিয়ে যাওয়া আরেক জিনিস। বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কার্যক্রমে পরের ব্যাপারটি ঘটেছে বলেই মনে করা হচ্ছে। পরের দিনের আরেক স্কাইপ কথোপকথনে বিচারপতি নিজামুল বলছেন কীভাবে সেদিন সন্ধ্যাতেই সরকারের একজন ব্যক্তি তাঁর কাছে এসে বিচারের রায় দ্রুত দিয়ে দেওয়ার কথা বলেছেন। নিজামুল বলেন, ‘আমি তাঁকে বললাম, সেটা কীভাবে সম্ভব?’
সরকারের সেই ব্যক্তি নিজামুলকে বলেন, ‘যত দ্রুত সম্ভব’ রায়টা দিয়ে দিন।
গত ৫ ডিসেম্বর এক টেলিফোন সাক্ষাত্কারে (ইকোনমিস্টের সঙ্গে) বিচারপতি নিজামুল এই বিচার প্রক্রিয়ায় তাঁর ওপর কোনো রাজনৈতিক চাপের কথা অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, তিনি এই আদালতের প্রধান ব্যক্তি। তাঁর ভাষায়, ‘এই আদালতে আমাদের নিজস্ব পদ্ধতি ও পছন্দ অনুযায়ী নিজেদের কার্যপ্রণালীই অনুসরণ করা হয়।’
তথ্য-উপাত্ত থেকে বোঝা যাচ্ছে যে এই আদালতের বিচারক হিসেবে নিজামুল হকের নিরপেক্ষতা প্রশ্নের সম্মুখীন। নিজামুল হক বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্টের (হাইকোর্ট বিভাগের) একজন বিচারপতি। যুদ্ধাপরাধের বিচার সংক্রান্ত ট্রাইবুন্যাল থেকে পদত্যাগের পরেও তিনি সুপ্রিম কোর্টের অন্যতম বিচারপতি পদেই অধিষ্ঠিত থাকবেন। ( তিন থেকে পাঁচজন বিচারক নিয়ে এই ট্রাইব্যুনাল গঠিত, এতে কোনো জুরি নেই)। বিচারপতি নিজামুল যাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন, সেই আহমেদ জিয়াউদ্দিন একজন প্রবাসী বাংলাদেশি। তিনি একজন আন্তর্জাতিক আইন বিশেষজ্ঞ। তিনি বেলজিয়ামে বাংলাদেশ সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিস নামের একটি সংস্থার পরিচালক। বিচারপতি নিজামুল হক ও আহমেদ জিয়াউদ্দিন একে অন্যকে চেনেন প্রায় ২৫ বছর ধরে। তাঁরা দুজনেই মানবাধিকার বিষয়ক বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত। জিয়াউদ্দিনের প্রয়াত ভাই বিচারপতি নিজামুল হকের ছাত্র অবস্থা থেকে বন্ধু ছিলেন।
উপদেষ্টা

তথ্য মতে, জনাব জিয়াউদ্দিনকে এ বিচারের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি বলে মনে করা হয়েছে। বিশেষ করে তাঁর পরামর্শ। বিচারপতি নিজামুলের করণীয় বিষয়ে নানা পরামর্শ, বিভিন্ন নথির জোগানদাতা হিসেবে তাঁকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হয়। স্বাভাবিকভাবে, কোনো মামলার বিষয় নিয়ে আলোচনা করার সময় বিচারককে প্রচুর সতর্কতা অবলম্বন করতে। বিশেষ করে, যদি সংশ্লিষ্ট মামলার বাইরে তৃতীয় কোনো পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করার সময়। কারণ, এটা অনেক সময় মামলার রায়, বিচারকাজকে প্রভাবিত করতে পারে। আর এ কথাটা বাংলাদেশের সংবিধানেও বলা হয়েছে। সংবিধানে বলা আছে যে. সংবিধানের বিধানাবলি-সাপেক্ষে প্রধান বিচারপতি এবং অন্যান্য বিচারক বিচারকার্য পালনের ক্ষেত্রে স্বাধীন থাকবেন। বিচারকদের কোড অব কনডাক্ট বা আচরণবিধিতে বলা হয়েছে, ‘একটি স্বাধীন বিচার ব্যবস্থা বাংলাদেশের বিচার পদ্ধতির জন্য অপরিহার্য।

বাংলাদেশের ক্ষেত্রে যুদ্ধাপরাধের মামলাটি একটি বিশেষ মামলা। বিশেষ ট্রাইবুনাল স্থানীয় আদালতের মতো হলেও এর কর্মকর্তারা ট্রাইব্যুনালের আন্তর্জাতিক মানদণ্ড বজায় রাখতে আগ্রহী। তবে সমস্যা হচ্ছে, এ ধরনের মামলার ক্ষেত্রে ট্রাইবুনালটির হাতে তেমন কোনো উদাহরণ নেই। ট্রাইবুনালের বিচারক জনাব নিজামুল ট্রাইবুনালের কাজের মানের উন্নয়ন নিয়ে আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলোচনা করেছেন। জনাব নিজামুল অবশ্য তাঁর পক্ষে এ যুক্তিটিই দাঁড় করিয়েছেন। ৬ ডিসেম্বরের নির্দেশ অনুসারে, এ ট্রাইবুনালটি নতুন আইন অনুযায়ী গঠন করা হয়েছে। যাতে বলা হয়েছে, ট্রাইবুনালের বিচারকরা দেশ ও দেশের বাইরের বিভিন্ন গবেষকদের সাহায্য নিতে পারবেন। এ আইন অনুযায়ী, জনাব জিয়াউদ্দিনকে একজন বিশেষজ্ঞ হিসেবে মানা হয়। বিচার চলার সময় ট্রাইবুনালের চেয়রাম্যান তাঁর (জিয়াউদ্দিন) পরামর্শ নিয়েছেন। ৪ ডিসেম্বর তারিখে ইকনমিস্টকে দেওয়া এক সাক্ষাত্কারে জনাব জিয়াউদ্দিনও একই ধরনের কথা বলেছিলেন। তাঁর কথায়, ‘বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে কোনো ধরনের গবেষণা বা অন্য সহযোগিতা নেবেন কি না সেটা একান্তই বিচারকের ওপর নির্ভর করে। তাঁরা এটা করতেই পারেন। তাদের কাছে যখন এসব বিষয়ে কোনো উদাহরণ থাকে না তখনই বিশেষজ্ঞদের কাছে যেতে হয়। যদি তাঁদের মনে হয়, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে নতুন এ বিষয়টি নিয়ে পরামর্শের প্রয়োজন আমি তাঁদের সাহায্য করতে রাজি।

ইকনমিস্টের পক্ষ ৫ ডিসেম্বর ট্রাইবুনাল বিচারপতির এক সাক্ষাত্কার নেওয়া হয়। জিয়াউদ্দিনের সঙ্গে বিচারকের কথার গরমিল দেখা দেয় এ সাক্ষাত্কারের পর। ওই দিন সন্ধ্যায় রায় দেওয়ার পূর্বে জনাব নিজামুল স্বীকার করেন যে, তিনি ও জনাব জিয়াউদ্দিন কথা বলেছেন। তবে মামলার বিষয়ে তাঁর মতামত নেওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করেন তিনি।
নিজামুল হক বলেন, ‘বিচারক হিসেবে আমরা তৃতীয় পক্ষ বা বাইরের কারও কাছ থেকে সাহায্য নিতে পারি না।’ তাঁকে যখন জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, ‘তাঁরা ট্রাইবুনাল বিষয়ে পরস্পর ই-মেইল আদান প্রদান করেছেন কি না? তখন তিনি উত্তর দিয়েছিলেন, ‘ না, না, না ট্রাইবুনাল সম্পর্কিত, বিচার বা বিচারকাজ পরিচালনা-সম্পর্কিত কোনো কথা হয়নি। তিনি এ সাক্ষাত্কারে আরও বলেছিলেন, ‘সুপ্রিম কোর্টের বিচারক হিসেবে আমরা বউয়ের সঙ্গেও এ ট্রাইবুনাল নিয়ে আলোচনা করতে পারি না।’
আগের দিনে দেওয়া সাক্ষাত্কারে জনাব জিয়াউদ্দিনও একই কথা বলেছিলেন যে, কোনো তৃতীয় পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করার সময় বিচারককে অবশ্যই সতর্ক হতে হবে। তিনি আরও জানান, এ সম্পর্কে (আদালতের) কোনো অবস্থান নেই। এ মামলার সঙ্গে জড়িতও নন। তবে তিনি (বিচারক) চাইলে এ সম্পর্কিত বার্তা তাঁকে পাঠাতে পারেন। যদিও আমি তা করি না। যতই হোক তিনি একজন বিচারপতি তো।

অবশ্য একজন বিচারক কারও পরামর্শ নিতেই পারেন। কিন্তু তখনই কেবল তা হতে পারে যদি কোনো পরামর্শক আনুষ্ঠানিকভাবে এ বিষয়ে দায়িত্ব পান বা দুই পক্ষের জেরার বিষয়গুলো অবগত থাকেন। সাধারণ নিয়ম অনুসারে, পরামর্শকরা তাদের নির্দিষ্ট বিষয়ের পরামর্শ দেন এবং আইনের বিষয়গুলো জানান।
জিয়াউদ্দিনের ক্ষেত্রে এসব নিয়ম মানা হয়নি। ৬ ডিসেম্বর ট্রাইবুনালের দেওয়া রায়ের আগে জিয়াউদ্দিনের ভূমিকা আদালতে বা জনসমক্ষে জানানো হয়নি। এমনকি তাঁর পরামর্শ নির্দিষ্ট আইনের বাইরেও চলে গেছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, অভিযোগের খসড়া তৈরি। আগস্ট মাসের ২৮ তারিখ থেকে অক্টোবর মাসের ২০ তারিখ পর্যন্ত দুজন ১৭ ঘণ্টারও বেশি কথা বলেছেন, যা প্রতিদিনের হিসেবে গড়ে প্রায় ২০ মিনিট। তাঁরা একে অপরের সঙ্গে ২৩০টিরও বেশি ইমেইল আদান প্রদান করেছেন। তাদের মধ্যে যেসব মেইল আদান প্রদান করা হয়েছে তাতে জিয়াউদ্দিনের যে ভূমিকা দেখা গেছে তা একজন বিশেষজ্ঞ বা পরামর্শকের ভূমিকার বাইরেও তিনি অনেকদূর গেছেন। প্রতিটি অভিযোগ যেখানে পরিশীলিত হতে হয় বা যথেষ্ট ব্যাখা দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে, তা গোলমেলে করা হয়েছে। প্রথমত জনাব জিয়াউদ্দিন এ ট্রাইবুনালের জন্য বিভিন্ন ডকুমেন্ট তৈরি করে দেন, যা এ বিচারকের কথাতেই, ঠিক কাজ নয়।
মে মাসের ১২ তারিখ ব্রাসেলসভিত্তিক আইনজীবী জিয়াউদ্দিন ট্রাইবুনালের বিচারক নিজামুল হককে ‘গোলাম আজম চার্জেস ফাইনাল ড্রাফট’ নামে একটি নথি পাঠান। এ নথিটি মাত্র ছয়দিন আগে পাঠানো নথির সঙ্গে সামান্য পরিবর্তন দেখা যায়। ১৩ মে তারিখে ট্রাইবুনাল গোলাম আযমের বিরুদ্ধে অভিযোগ দাখিল করে। তবে সাক্ষাত্কারে দুজনই সাহায্য নেওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করেন।

দ্বিতীয়ত, তাদের দুজনের কথোপকথন মামলা সংশ্লিষ্ট পরামর্শের বাইরেও অনেকদূর গেছে। ৬ সেপ্টেম্বর জনাব নাজমুল বলেন, ‘আমি শাহিনূরকে নিয়ে একটু ভয় পাচ্ছি (শাহিনুর ইসলাম, এ ট্রাইবুনালের বিচারক) কারণ সে আন্তর্জাতিক মান নিয়ে থাকতে চায়। ওই লোকের টার্গেটই হল যে, সে সবার চেয়ে বেশি বুঝে। প্রতিটি অর্ডারেই বিদেশি রেফারেন্স টেনে আনে সে।’
জবাবে জনাব জিয়া বলেন, ‘ওকে এটা করা থেকে থামাতে হবে বা তাকে ট্রাইবুনালের বাইরে রাখতে হবে। তাকে থামানো না গেলে বা সে এভাবে গেলে আমাদের জন্য ক্ষতির কারণ হতে পারে। এখানে জনাব জিয়াউদ্দিন একজন বিচারককে সরিয়ে দেওয়ার মত বিষয়ে কথা বলেছেন।
খুবই উদ্বিগ্ন
২০১১ সালের ২৬ নভেম্বর নিজামুল (অনানুষ্ঠানিকভাবে যিনি নাসিম হিসেবে পরিচিত) গুরুত্বপূর্ণ একটি আত্মরক্ষা আবেদন (ডিফেন্স পিটিশন) সম্বন্ধে জিয়াউদ্দিনকে আবার একটি ই-মেইল পাঠান। তাঁর পুরো বার্তাটি ছিল, ‘‘ বিষয়: আদেশ: এখনো পাইনি। খুবই উদ্বিগ্ন। দয়া করে বাংলাদেশ সময় আজ রাতের মধ্যেই পাঠান, অন্যথায় আমি আমার নিজেরটিই প্রয়োগ করব। নাসিম।’’

নিজামুলের ই-ইমেইল থেকে বোঝা যায়, তিনি জিয়াউদ্দিনের যুক্তিকেই নিজ বিবেচনার চেয়ে বেশি প্রাধান্য দিয়েছেন।
তৃতীয়ত, আমরা যেসব উপকরণ পেয়েছি তা থেকে মনে হয় জিয়াউদ্দিন একই সময়ে একই বিষয়ে বিচার প্রক্রিয়ায় নিয়োজিত কৌঁসুলি (প্রসিকিউশন) এবং বিচারকদের সঙ্গে যোগাযোগ করছিলেন।
২০১১ সালের ৮ নভেম্বর তিনি বিচারক বিচারপ্রক্রিয়া থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখছেন মর্মে একটি আত্মরক্ষা আবেদনে উত্থাপিত কয়েকটি বিষয় নিজামুলকে ই-মেইল করেন। ওই ই-মেইলে বলা হয়েছে, ট্রাইব্যুনালের প্রধান কৌঁসুলি জিয়াদ আল-মালুম ওই তালিকায় থাকা প্রথম পাঁচটি বিষয় (উপকরণ ও নথি) নিজামুলকে সরবরাহ করবেন।
একজন বিচারক এ ধরনের উপকরণ গ্রহণ করতে পারেন এবং এটি আদালতে বিতর্ক তৈরির কোন বিষয় ছিল না। এটিও সত্য যে, কৌঁসুলি এ ধরনের উপকরণ সরবরাহ করার ক্ষেত্রে সর্বোত্তম ব্যক্তি। উত্সাহব্যঞ্জক ব্যাপার হলো, প্রধান কৌঁসুলি যার সাহায্য চাচ্ছেন, সেই ব্যক্তি বিচারককেও পরামর্শ দিচ্ছেন।
বিচারক, কৌঁসুলি এবং উপদেষ্টার মধ্যে যোগাযোগ দৃশ্যত চলছিল। ২০১১ সালের ১১ ডিসেম্বর গোলাম আযমের বিরুদ্ধে মামলার বিষয়ে পরামর্শ ও যুক্তি উপস্থাপনে সাহায্য করতে মালুমসহ দুজন কৌঁসুলিকে একটি ই-মেইল পাঠান জিয়াউদ্দিন। একইদিনে ওই উপদেশবার্তা নিজামুল হককেও পাঠান জিয়াউদ্দিন।
আমাদের সঙ্গে আলাপে জিয়াউদ্দিন মালুমকে চেনেন বলে স্বীকার করেছেন। তবে ট্রাইব্যুনালের মামলা নিয়ে অযাচিত যোগাযোগ করেননি বলে জানান তিনি। এদিকে মালুম আমাদের প্রশ্নের কোনো জবাব দেননি।
আমরা যেসব উপকরণ পেয়েছি তা থেকে তিনটি বিষয় উঠে আসে। এগুলো হলো- কৌঁসুলি যেভাবে মামলা সাজিয়েছে এবং আদালত যেভাবে অভিযোগ উত্থাপন করেছে, তার ওপর জিয়াউদ্দিনের প্রভাব ছিল। জিয়াউদ্দিন ২০১১ সালের ডিসেম্বরে ই-মেইলে বিচারককে বলেছিলেন কীভাবে কৌঁসুলিরা তাদের মামলা সাজাতে পারেন। যখন কৌঁসুলিরা তাদের অভিযোগ উত্থাপন করল, তখন আনুষ্ঠানিক অভিযোগ সম্বন্ধে জিয়াউদ্দিনের নির্দেশনা সরাসরি অনুসরণ করলেন বিচারক।

সবশেষে সাঈদীর মামলা নিয়ে নিজামুলকে পাঠানো জিয়াউদ্দিনের একটি ই-মেইল ছিল ‘সাঈদী জাজমেন্ট’ নামক গুগলে শেয়ার করা একটি নথি। ওই নথিতে বলা হয়, ‘সর্বশেষ সম্পাদনা করা হয় ১৪ অক্টোবর’। এই সময়ে সাঈদীর আইনজীবীরা তাঁর সম্বন্ধে আদালতে আত্মপক্ষ সমর্থনের আবেদন জানিয়েছিলেন।
ওই নথিতে বেশ কয়েকটি বিষয় (সাক্ষীদের তালিকা, বিচারপ্রক্রিয়ার ইতিবৃত্ত, চ্যালেঞ্জ ইত্যাদি) ছিল। পরবর্তী সময়ে সত্য বলে ধরা যায়, এমন বিষয় নথিবদ্ধ করা হবে। চূড়ান্ত শিরোনাম ছিল বড় হাতে লেখা ‘‘কনভিকশন/বেসিস’’ (দোষী সাব্যস্তকরণ/মূলভিত্তি) এবং ‘‘সেনটেনসিং’’ (সাজা দেওয়া)।
একটি দীর্ঘ বিচারকাজের রায়ের অনেক আগ থেকেই কাজ শুরু করেন আদালত। নিজামুল হক কাউকে ‘দোষী সাব্যস্ত’ না করে ‘বেকসুর খালাস’ করে দিতে পারেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত তাঁর কাজকর্মে তেমনটি মনে হয়নি। তিনি অক্টোবরের নথি নিয়ে কাজ করার বিষয়টি অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, সে সময় দেলাওয়ার হোসাইনের বিচারকাজ শুরুই হয়নি।
যুক্তিসঙ্গত প্রশ্ন
বিচারক আমাদের অভিযোগকে ‘‘সম্পূর্ণভাবে উদ্ভট’’ এবং ‘‘সর্বৈব মিথ্যা’’ বলেছেন। জিয়াউদ্দিন বলেছেন আমাদের প্রাপ্ত তথ্যের ভিন্ন ব্যাখ্যা রয়েছে। তবে দ্য ইকোনমিস্টকে আদালত হাজির হতে বলার পর তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হয়নি। আমরা কোনো আইন লঙ্ঘন করেছি মনে করি না। উপরন্তু আমাদের তদন্তে ট্রাইব্যুনালে প্রতিপক্ষের দৃষ্টিভঙ্গিগত কোনো বিষয় উঠে আসেনি। তা সত্ত্বে আমাদের কাছে থাকা উপকরণগুলো যথাযথ বিচারপ্রক্রিয়া নিয়ে বেশ কিছু যুক্তিসঙ্গত প্রশ্নের উদ্রেক করেছে। বাংলাদেশের উচিত বিষয়গুলো নিয়ে যথাযথ তদন্ত করা। নিজামুলের পদত্যাগের আলোকে এ ধরনের তদন্ত খুবই জরুরি।
ইকোনমিস্ট সম্পাদকের কথা

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হক ও বেলজিয়াম প্রবাসী বাংলাদেশি আইন বিশেষজ্ঞ আহমেদ জিয়াউদ্দিনের মধ্যকার টেলিফোন আলাপ ও ২৩০টি ইমেইলের ওপর ভিত্তি করে এই নিবন্ধটি তৈরি করা হয়েছে।
সাধারণত ইকোনমিস্ট পত্রিকা ব্যক্তিগত ও গোপনীয় ইমেইল ও টেলিফোন কথোপকথন প্রকাশ করে না। কিন্তু এটি প্রকাশিত হল কারণ এ ব্যাপারে সাধারণ মানুষের আগ্রহ আছে। এর সঙ্গে বিচার বিভাগের সুনাম জড়িত।
হাতে পাওয়া এই কথোপকথন ও ই-মেইলগুলো সত্যতা যাচাই করতে ইকোনমিস্ট যতটা সম্ভব সব ধরনের উদ্যোগই গ্রহণ করেছে। আমরা বিচারপতি নিজামুল হক ও আহমেদ জিয়াউদ্দিনের সঙ্গেও কথা বলেছি। তাঁরা এই কথোপকথনের সত্যতা স্বীকার করেছেন। এমনকি এই বিষয়ে তাঁরা আরও কিছু মন্তব্য করতেও রাজি ছিলেন। কিন্তু গত ৬ ডিসেম্বর বিচারপতি নিজামুল হক (তিনি তখনো আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন।) আদেশ জারি করলেন, ইকোনমিস্টের দুই জন সদস্যকে আদালতে হাজির হয়ে জানাতে হবে যে আমরা কীভাবে এই কথোপকথনের তথ্য ও ইমেইলগুলো হাতে পেয়েছি। এর পরপরই আমরা বিচারপতি নিজামুল ও ও আহমেদ জিয়াউদ্দিনের সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দিই।

সাধারণত আমরা হাতে পাওয়া তথ্য-উপাত্তের সূত্র প্রকাশ করি। কিন্তু এক্ষেত্রে আমরা আশঙ্কা করেছি, তথ্য-উপাত্তের সূত্র প্রকাশ করলে হয় দুই ব্যক্তি অস্বীকার করবেন অথবা তাদের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে। বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের আকাশে ইতিমধ্যেই সহিংসতার কালো মেঘ জমেছে। গত ৫ নভেম্বর একজন অভিযুক্তের সাক্ষীকে সাক্ষ্য দেওয়া থেকে বিরত রাখা হয়, এবং সেই সাক্ষী এরপর থেকেই নিখোঁজ। আশঙ্কা করা হচ্ছে, ট্রাইব্যুনালের সদর দরজা থেকে অভিযুক্তের সেই সাক্ষীকে তুলে নিয়ে গেছে বাংলাদেশ পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ। সরকার ব্যাপারটি অস্বীকার করলেও সেই সাক্ষীর আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি।
একটি বিষয় বলা ভালো, এই কথোপকথনের রেকর্ড ও ইমেইলগুলো পাওয়ার জন্য আমরা কাউকে অনুরোধ করিনি। আমরা এজন্য একটি পয়সাও খরচ করিনি। এমনকি আমরা আমাদের সূত্রকেও নিশ্চিত করে বলিনি যে এটি ছাপা হবে। তবে হাতে পাওয়া তথ্য-উপাত্তগুলো যে মিথ্যা, সেটিও বলার মতো অবস্থায় নেই আমরা।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুন্যালে অভিযুক্তরা সত্যিই দোষী না নির্দোষ , এ ব্যাপারেও দ্য ইকোনমিস্ট কিছু জানে না। ইকোনমিস্ট এও জানে না যে, অভিযুক্তরা নিজেদের নির্দোষ প্রমাণে সত্যিই ন্যায়-বিচার পাবেন কি না।

http://www.economist.com/news/briefing/21568349-week-chairman-bangladeshs-international-crimes-tribunal-resigned-we-explain

কোন মন্তব্য নেই: